সহযাত্রী: নবান্নে বৈঠকের পর চন্দ্রবাবু নাইডু ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: প্রদীপ সান্যাল
মমতার ব্রিগেড সমাবেশের প্রস্তুতি এ বার পুরোদমে শুরু হল। চার মাস আগে ২১ জুলাইয়ের সভা থেকে ব্রিগেডের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উৎসবের মরসুম শেষ হওয়ার পরে গত সপ্তাহে দলীয় বৈঠকে তিনি ব্রিগেড সফল করার বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন। আগামী লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই ব্রিগেডকে তিনি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসাবে দেখাতে চান। সর্বভারতীয় বিরোধী নেতাদের হাজির করে ‘বিজেপি হটাও’ স্লোগান দিয়ে এখান থেকেই হাওয়া তুলতে চান সরকার বদলের।
বিজেপি-বিরোধী জোট গড়তে মমতার আগুয়ান ভূমিকা দেশবাসীর নজর এড়ায়নি। তিনিই সর্বাগ্রে বিরোধীদের ফেডারেল ফ্রন্ট গঠন এবং একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিয়ে বিজেপিকে হারানোর ডাক দিয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে বেশ তৎপরও হয়েছিলেন তিনি। এখনও তাতে অবিচল।
কিন্তু ঘটনা হল, বিরোধী রাজনীতির ছবি ঘনঘন বদলে যাচ্ছে। জাতীয় ক্ষেত্রেই হোক বা রাজ্য রাজনীতিতে, সেই পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে। ফলে ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রেও সামনে আসছে বিবিধ জটিল ও কুশলী অঙ্ক। তেমনই এক সময় মমতার ব্রিগেড সমাবেশ আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন তৎপর্যপূর্ণ হল, বিরোধী-মঞ্চ বড় এবং শক্ত করতে চন্দ্রবাবু নায়ডুর সহসা অতি-তৎপর হয়ে ওঠা।
চার দিন আগে কলকাতায় মমতার সঙ্গে বৈঠক করে গেলেন চন্দ্রবাবু। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার তাগিদ চন্দ্রবাবুর পক্ষেই বেশি ছিল। বস্তুত বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। পাশাপাশি আবার এই কাজে কংগ্রেস তাঁকে ব্যবহার করছে—এমন একটি ধারণাও রাজনৈতিক মহলে জোরদার হয়েছে। ফলে শুরু হয়েছে কাঠি-চর্চা!
কিন্তু চন্দ্রবাবু যা করছেন, তা তো অন্যায্য বা গোপন কিছু নয়। লক্ষ্য যখন বিরোধীদের সকলকে একজোট করে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা, তখন চন্দ্রবাবুর এই ভূমিকা অবশ্যই সদর্থক। এ নিয়ে কেউ যদি ক্ষোভ উস্কে দিতে চান, আখেরে হয়তো তাতে প্রস্তাবিত বিরোধী-ঐক্যেরই ক্ষতি হবে। কিন্তু মমতা তা চান না। তাই কলকাতায় অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন তিনি। বিরোধী মঞ্চের ভবিষ্যৎ কর্মসূচিতেও সমর্থন জানিয়েছেন।
তাঁদের আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে ১৯ জানুয়ারির ব্রিগেড-প্রসঙ্গ। নায়ডু নিজে তো আসবেনই। রাহুল গাঁধী-সহ বিরোধী শীর্ষনেতাদের যত জনকে সম্ভব, সেখানে উপস্থিত করানোর জন্য উদ্যোগী হবেন, এমন কথাও সে দিন হয়েছে। ঠিক যেমন মমতা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন, অন্যান্য রাজ্যে বিরোধীদের সমাবেশে তিনি যোগ দেবেন।
মমতার তরফ থেকেও ইতিমধ্যে বিভিন্ন দলের শীর্ষনেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি নিজে তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। দলীয় বৈঠকে তৃণমূল নেত্রী নিজেই জানিয়েছেন, দু’এক জন ছাড়া প্রায় সকলেই ব্রিগেডে আসতে সম্মত। সেই দু’এক জন কারা, তা এখনও প্রকাশ্য নয়। তবে চন্দ্রবাবু, শরদ পওয়ার, অখিলেশ, কুমারস্বামী, তেজস্বী যাদবেরা আসবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। মায়াবতী কোন দিকে, এখনও বোঝা এবং বলা শক্ত।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কংগ্রেস। অন্য যে সব দল ব্রিগেডের সভায় আসবে, তারা কেউ এ রাজ্যে ভোটে লড়বে না। তাদের উপস্থিতি মূলত বিজেপি-বিরোধী সর্বভারতীয় মঞ্চে মমতার গুরুত্ব আরও বাড়াবে। আর, ওই মঞ্চে কংগ্রেসের থাকা, না-থাকা হবে রাজনৈতিক ভাবে সবচেয়ে অর্থবহ। কারণ
এই রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ রুখতে গেলে কংগ্রেসের কিছুটা দায় থাকবেই। কংগ্রেস আসবে কি না, এলে কোন স্তরের নেতা আসবেন এবং প্রদেশ কংগ্রেসের ভূমিকা কী হবে, সব কিছুই এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়।
রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এই ব্যবধান উভয়ত এবং সকলেরই জানা। মমতা যেমন গোড়া থেকে বলে আসছেন, তিনি একা ভোটে লড়বেন, প্রদেশ কংগ্রেসও তেমনই মমতার সঙ্গে ভোট-জোটে যেতে নারাজ। অধীর চৌধুরী সভাপতি থাকাকালীন যা বলতেন, সোমেন মিত্রও এখন তা-ই বলছেন। তাঁরা বরং সিপিএমের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির পক্ষে।
তা বলে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সঙ্গে মমতার যোগাযোগ নেই, তা নয়। শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনঘন কথা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে মতামত আদানপ্রদান হয়। সনিয়া গাঁধীর সঙ্গেও মমতার ফোনে বা এসএমএসে সংযোগ রয়েছে। এটা ঠিক যে রাহুলের সঙ্গে খুব নিয়মিত কথা মমতার হয় না। তা সত্ত্বেও তাঁদের সম্পর্কে কোনও শীতলতা নেই। ব্রিগেড-সমাবেশের কথা সনিয়া, রাহুল দু’জনকেই ব্যক্তিগত ভাবে জানিয়ে এসেছেন তৃণমূল নেত্রী। ডিসেম্বরে দিল্লি গিয়ে আবার আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা আছে তাঁর।
এ ক্ষেত্রে কংগ্রেস কী করবে? এখানেই কার্যত তাদের পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছেন মমতা। এক দিকে জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা, অন্য দিকে এই রাজ্যে কংগ্রেসের তৃণমূল-বিরোধী ভূমিকা—এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করা হবে কী করে?
ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার ডাক দিয়েই মমতা ঘোষণা করেছিলেন, বিজেপির বিরুদ্ধে যেখানে যে দল শক্তিশালী, সেখানে তারা লড়বে এবং বাকিরা তাকে সমর্থন করবে। একের বিরুদ্ধে এক ফমুর্লা। সেই অঙ্কে এই রাজ্যে লোকসভার ৪২টি আসনেই তৃণমূলের লড়ার কথা।
কারণ এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি যা, তাতে একা লড়লেও পশ্চিমবঙ্গে মমতাই যে বিপুল ব্যবধানে জিতবেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ কম। ফলে তাঁর পক্ষে একা লড়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়া অনায়াসে সম্ভব। কিন্তু কংগ্রেস নিজের জোরে একটি আসনও পাবে বলে ভরসা হয় না। বামেদের করুণ হাল তো বলাই বাহুল্য। সেটা বোঝেন বলে স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূল নেত্রী নিজের জমি যত দূর সম্ভব শক্ত করতে বদ্ধপরিকর। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট একা ধরে রাখার এমন সুযোগ হাতছাড়া করার মতো আহাম্মকও তিনি নন। সেই ভোটের ভাগ তিনি যেচে কংগ্রেসকে দিতে যাবেন কেন!
কিন্তু জাতীয় রাজনীতির নিরিখে কংগ্রেসের পক্ষে এখন মমতাকে বাদ দিয়ে ভাবা কঠিন। প্রস্তাবিত বিরোধী জোটের নেতা কে হবেন, সেই প্রশ্নের জবাব যতই উহ্য রাখা হোক, বড় দল হিসাবে কংগ্রেসকে মমতার ভোট-ভাণ্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবেই। ফলে মমতার ব্রিগেডের আহ্বান একেবারে এড়িয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে ঝুঁকি হয়ে যাবে বলে মনে হয়। ভবিষ্যৎ ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর সেটা বেশ চাপের।
মমতার দিক থেকে বরং পরিস্থিতিটা এ ক্ষেত্রে অনেকটা যাকে বলে, উইন-উইন। আপাতত তাঁর হারানোর কিছু নেই। ব্রিগেড ভরানোর জোর তাঁর আছে। সিংহভাগ আসনে জেতার সম্ভাবনাও প্রায় ষোলো আনা। এবং এটাও জানা কথা, ঝোলায় যত বেশি আসন থাকবে, ততই গুরুত্ব বাড়বে তাঁর। বাড়বে দর কষাকষির জোরও। রাজ্য কংগ্রেসকে তাই তাঁর থোড়াই কেয়ার!
তবে দিল্লির হাইকম্যান্ড কী বোঝেন, সেটাই এখন দেখার।