শুধু রাজনীতি নয়, ছায়া প্রতিহিংসারও

দেখ কেমন লাগে!

মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের একজোট করতে প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন মমতাই। জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশেও তিনি কংগ্রেস-সহ সব বিরোধী দলকে এক মঞ্চে হাজির করায় জোট-রাজনীতি আরও খানিকটা এগিয়ে যায় এবং তৃণমূল নেত্রীর গুরুত্বও বাড়ে।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২৩:৪৫
Share:

রাজধানী: ‘তানাশাহি হটাও, দেশ বচাও’ সমাবেশে চন্দ্রবাবু নায়ডু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পওয়ার ও ফারুক আবদুল্লা। দিল্লি, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভোট-ঘোষণার সময় এগিয়ে আসছে। তেতে উঠছে রাজনীতির হাওয়া। আর তাতে রীতিমতো উত্তপ্ত পশ্চিমবঙ্গ। অনেকে বলছেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে এ যেন মোদী-দিদি দ্বৈরথ! যাঁরা বলছেন, তাঁরা হয়তো খুব ভুল নন। কারণ, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্য-রাজনীতি যে ভাবে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠল তাতে মমতার রাজ্য নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ভাবনাচিন্তার ‘বিশেষ’ কারণ থাকতেই পারে! তাঁর বিবিধ কার্যকলাপে সেই লক্ষণগুলি ধরা পড়ে। এখন বিরোধী দলগুলির জোট গড়ে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত এবং সেখানে মমতার ‘সক্রিয়’ ভূমিকা সেই প্রয়োজন আরও বাড়িয়ে দিল।

Advertisement

বিজেপির প্রস্তাবিত রথযাত্রা ধাক্কা খাওয়ার পরেই দল ঘোষণা করেছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ-সহ বড় বড় নেতা-মন্ত্রীরা দফায় দফায় রাজ্য সফরে আসবেন। এক সপ্তাহের মধ্যে মোদী এবং শাহ দু’জনেই পর পর দু’বার চলে এলেন। এলেন রাজনাথ সিংহ, যোগী আদিত্যনাথ প্রমুখ।

অন্য দিকে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজ্যে যে সব ঘটনা ঘটল এবং মোদী-সরকারের বিরুদ্ধে মমতা ধর্নায় বসলেন, তা বিরোধী নেতাদের আরও এক বার মমতার পাশে একত্রিত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়। একেবারে টাটকা তাঁর এ বারের দিল্লি সফরও এ ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থবহ হয়ে উঠেছে। কারণ মমতার কলকাতার ধর্না মঞ্চ থেকেই দিল্লিতে পরবর্তী বিরোধী-সমাবেশের ঘোষণা হয়েছিল। আর সেই সমাবেশের পরে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি একসঙ্গে ভোটের আগেই জোট গড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিয়েছে। যেখানে মমতা অতি সক্রিয় অনুঘটক। কারও কারও মতে, তিনিই নাকি নেপথ্য রূপকার!

Advertisement

মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের একজোট করতে প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন মমতাই। জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশেও তিনি কংগ্রেস-সহ সব বিরোধী দলকে এক মঞ্চে হাজির করায় জোট-রাজনীতি আরও খানিকটা এগিয়ে যায় এবং তৃণমূল নেত্রীর গুরুত্বও বাড়ে। যদিও অনেকের ধারণা, এর পিছনে আরও একটি বড় কারণ আছে। তা হল এই রাজ্যের নির্বাচনী ভবিতব্য। এখনও পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে রাজ্যে ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে মমতার দলের পক্ষে আনুমানিক ৪০টির কাছাকাছি আসন পাওয়াও অসম্ভব নয় বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অধিকাংশ মনে করছেন। ফলে মমতা এখন যথেষ্ট ‘মূল্যবান’।

এমন এক জন বিরোধী নেত্রীকে সরাসরি নিশানা করা বিজেপির পক্ষে অবশ্যই স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত। মোদী-শাহরা সেই মতো এগোচ্ছেন। কিন্তু এই নিশানা শুধু মমতাকে রাজনৈতিক আক্রমণ করার মধ্যে থেমে নেই। দিদির রাজ্যে মোদীর এক একটি পদক্ষেপ কোথাও যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এর পিছনে কাজ করছে ‘দেখ কেমন লাগে’ মানসিকতা। যা সুস্থ রাজনীতির পক্ষে বেমানান। বিশেষত, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি লোকচক্ষে তার শরিক হয়ে যান!

এই রকম কিছু যে হতে পারে, তার আভাস মিলছিল। যেমন কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, ভোট এগিয়ে এলেই রাজ্যে সিবিআইয়ের অভিযান জোরদার হবে। বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া, ক্ষমতা বা পদ নির্বিশেষে অভিযুক্ত এবং সন্দেহভাজনদের জেরা করা, প্রয়োজনে ব্যবস্থা করা— সবই উচিত। এ নিয়ে কোনও আপত্তির কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু বেশ কিছু দিন আপাত-নীরবতার পরে হঠাৎ ভোটের মুখে তেড়েফুঁড়ে ওঠার পিছনে কেউ যদি কোনও বিশেষ অভিসন্ধি বা ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’র গন্ধ পান, তা হলে সেটাও নজর এড়ায় না।

কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে রবিবারের সন্ধ্যায় আচমকা সিবিআই অফিসারদের হানা এই পর্বে এক বড় ঘটনা। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত তদন্তে এক সময়ের ‘সিট’ প্রধান রাজীবকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন থাকতেই পারে। কিন্তু সে দিন ভরসন্ধ্যায় এক দল সিবিআই অফিসার যে ভাবে রাজীবের সরকারি বাসভবনে চড়াও হলেন, সেটা চোর-ডাকাত বা পলাতক খুনের আসামি ধরতে যাওয়ার থেকে আলাদা মনে হয়নি। স্থানীয় থানায় একটি হাতে লেখা চিরকুট পাঠিয়ে তাঁরা এই ‘সিক্রেট অপারেশন’-এ পুলিশি সহায়তাও চেয়েছিলেন!

যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল, তার অন্তর্নিহিত অর্থ যে রাজ্যের শাসক মহলে নির্দিষ্ট কিছু ‘বার্তা’ দেওয়া, এটা বুঝতে আইন পড়ার দরকার হয় না। মনে রাখতে হবে, রাজীবকে গ্রেফতার করার বা জেরা করার কোনও ওয়ারেন্ট সঙ্গে নিয়ে ওই অফিসারেরা যাননি।

এর বিরুদ্ধে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর পথে বসার মধ্যেও আবার পাল্টা রাজনীতির উপাদান ছিল যথেষ্ট। এবং তিনি তার সদ্ব্যবহার করতে কসুর করেননি। রাহুল গাঁধী থেকে শুরু করে বিরোধী নেতারা সবাই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন। এমনকি এই প্রথম তৃণমূল নেত্রী পাশে পেয়ে যান ওড়িশার নবীন পট্টনায়ককেও। মুখ খোলে শিবসেনা। চন্দ্রবাবু নায়ডু-সহ কয়েক জন তো সরাসরি চলে আসেন ধর্না মঞ্চে। ঘোষণা করা হয় দিল্লির বিরোধী-সমাবেশ। এ বার জোট-ঘোষণার মাধ্যমে তা বড় মাত্রা পেল।

একই ভাবে কলকাতা হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ ঘিরে যে কাণ্ড ঘটল, সেটাও কম লক্ষণীয় নয়। ময়নাগুড়িতে সভা করতে আসার এক দিন আগে সহসা প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জানানো হয়, তিনি ওই মঞ্চ থেকে বহুপ্রতীক্ষিত জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন করবেন। সেই সার্কিট বেঞ্চ, যা চার মাস আগে উদ্বোধন করার প্রস্তুতি নিয়েও কেন্দ্রের ছাড়পত্র না মেলায় করে ওঠা যায়নি। এখন মোদীর তড়িঘড়ি উদ্বোধন করতে চাওয়ার পিছনে কারণ যে ভোট-রাজনীতি, তা শিশুও বোঝে। ঘটনাচক্রে হাইকোর্ট, রাজ্য সরকার, কেউ ওই অনুষ্ঠানে ছিল না। ফলে এটা কার্যত হয়ে উঠেছিল প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘একলা চলো’ উদ্যোগ!

কলকাতা হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৯ মার্চ ওই সার্কিট বেঞ্চের ‘আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন’ হবে। সিদ্ধান্ত আদালতের। তাই মন্তব্য অনুচিত এবং নিষ্প্রয়োজন। শুধু সাদামাটা তথ্যের খাতিরে বলে রাখা যায়, মোদী ৮ ফেব্রুয়ারি যে সার্কিট বেঞ্চের ‘উদ্বোধন’ করেছেন, সেই বেঞ্চের ‘আনুষ্ঠানিক’ উদ্বোধন হবে ঠিক এক মাস পরে। তবে এ কথা বলার সময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, মহামান্য আদালতের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কে কোথায় কবে কী করেছেন, তা কোনও ভাবেই সম্পৃক্ত নয়।

কিন্তু এ সবের বাইরে একটি প্রশ্ন ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তা হল, মোদী-অমিত শাহরা এ বার এই রাজ্যকে ‘মাছের চোখ’ হিসাবে বেছে নিলেন কেন? একটা অঙ্ক নিশ্চিত ভাবে কাজ করছে। উত্তর এবং দক্ষিণ ভারত থেকে এ বার তাঁরা কতটা সুবিধা আদায় করতে পারবেন, বলা কঠিন। খোদ উত্তরপ্রদেশেও গেরুয়া-রথের পথ এ বার খুব মসৃণ হবে কি না, সন্দেহ। হয়তো তাই পশ্চিমবঙ্গে এসে মরিয়া চেষ্টা তাঁদের, যদি কিছু মেলে!

সেই চেষ্টারই এক দিকে সিবিআই, গ্রেফতার, ভয় ধরানো। অন্য দিকে জাতপাত, ধর্ম-সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজনকে উস্কানি দেওয়া। সেই সঙ্গেই বিবিধ ভোট কাটাকাটির সুযোগ খোঁজা।

জাতীয় স্তরে বিরোধী জোট হওয়ার পরেও রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার সম্পর্কের কোনও নতুন বিন্যাস হবে কি না, এখনও বলা কঠিন। ইঙ্গিত আপাতত নেতিবাচক। আবার বামেরা যদি কংগ্রেসের সঙ্গে যায়, তা হলেও ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হবে কি না, প্রশ্ন সেখানেও।

সব মিলিয়ে তাই হিসাব খুব সহজে মেলানো যাচ্ছে না। তবে ইতিহাস বলে, বিজেপি, কংগ্রেস, বাম— তিন পক্ষকেই একা হারাতে পেরেছেন মমতা। এটা তাঁর চেনা লড়াই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement