স্মরণিকা: ১৯৪৪ সালের ২৩ জুলাই মালদহ কলেজের উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা।
বাহান্ন বিঘা জমির উপর মালদহ কলেজের নিজস্ব ভবন গড়ে ওঠে ১৯৫২ সালে। কিন্তু ভবনের উদ্বোধন হয় ১৯৫৩ সালের ৬ জানুয়ারি। উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও বিধান পরিষদের সভাপতি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন পুনর্বাসন মন্ত্রী রেণুকা রায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রেরিত শুভেচ্ছাবার্তাটি সুনীতিবাবু পাঠ করেছিলেন।
মালদহ কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে ১৯৪৪ সালের ৫ অগস্ট যোগ দেন দিগিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। দেশভাগের যন্ত্রণা যখন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন মালদহে স্বাধীনতা দিবস তিন দিন পিছিয়ে ১৮ অগস্ট পালিত হয়। সে বছরই ৮ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন দুর্গাকিঙ্কর ভট্টাচার্য। যাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা, আগ্রহ আর কর্মতৎপরতায় মালদহ কলেজ ক্রমশ মহীরূহে পরিণত হয়। শুধু ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেওয়াই নয়, তিনি শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের মধ্যেও উৎসাহের প্রাণস্পন্দন আনতে পেরেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন মালদহের শিক্ষাপ্রসার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। খেলাধুলোতেও সমান উৎসাহ দান করতেন তিনি। ১৯৯৪ সালে সুবর্ণজয়ন্তীতে কলেজের দুই মহান প্রতিষ্ঠাতার স্মরণে দু’টি প্রেক্ষাগৃহের নামকরণ হয় দুর্গাকিঙ্কর সদন এবং সানাউল্লাহ মঞ্চ।
প্রথম পর্বে কলেজে আইএ, আইএসসি, আইকম, পরে বিএ, বিএসসি, বিকম এবং অনার্স পড়ানো শুরু হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের কলেজ হিসেবে শুধু নয়, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের কলেজগুলির তুলনায় মালদহ কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রথম ফলাফলে ৪১ জনের মধ্যে ১১ জন উত্তীর্ণ হন। তিনজন ছাত্রী এবং রামগোপাল সরকার ডিসটিংশন নিয়ে কৃতকার্য হন। কলেজে পঠনপাঠনের পাশাপাশি নানা সামাজিক এবং উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা জড়িয়ে পড়েন। এনএসএস, এনসিসি, বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি, সমবায় প্রসার, ইত্যাদির সঙ্গে পাঠাগার, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, ছাত্রাবাস নির্মাণ করা— সব কাজেই ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন অগ্রগামী। স্বাধীনতা-পূর্ব মালদহের সংগ্রামী জিতু সাঁওতালের স্মৃতিসূত্রে জানা যাচ্ছে, ‘জিতু ছাত্রাবাস’ তৈরি হওয়ার পর বহু দরিদ্র ছাত্র ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন। গ্রামীণ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে কলেজের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
কলেজের কৃতী ছাত্রছাত্রীদের যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের অনেকেই স্বনামধন্য। শিক্ষক শশাঙ্কশেখর সিংহ নঘরিয়া গ্রামে ছাত্রাবস্থাতেই ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে ক্লেশ ভোগ করেছিলেন। সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের ছাত্র ছিলেন তিনি। শিক্ষক কৃষ্ণবন্ধু দাস ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। ১৯৩৯ সালে বৃন্দাবনি আমগাছ তলায় সুভাষচন্দ্র বসুর আগমন উপলক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে তিনি মালদহবাসীর পাশাপাশি হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রেরও। এর প্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্র বসু মন্তব্য করেছিলেন যে, পরাধীন ভারতে কৃষ্ণবন্ধু দাসের মতো সাহসী ও তেজস্বী তারুণ্যই প্রয়োজন। সারা জীবন শিক্ষাবিস্তারে ও মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে গিয়েছেন কৃষ্ণবন্ধু দাস। শিক্ষক বীরেন্দ্রকুমার রায় সাহিত্যচর্চায় সুনাম অর্জন করেছিলেন। লিখেছিলেন ‘জলছবি’, ‘মানসযাত্রী’, ‘অগ্নিকন্যা’, ‘শিবাজির স্বপ্ন’ (উপন্যাস), ‘মাটির শিখা’ (কাব্যগ্রন্থ), ‘জীবনের পথে পথে’ (প্রবন্ধ) প্রভৃতি। শিক্ষক দীপ্তিময় সরকার কবি হিসেবে সমগ্র বাংলায় পরিচিত ছিলেন (কাব্য: ‘আকাশ স্বপ্ন দেখে’, ‘যৌবন অভিমুন্য হও’)। অমৃতলাল নাথ পদার্থবিদ্যার আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক মিহিরকুমার গোস্বামী ‘বিড়ম্বনা’, ‘রক্তস্বাক্ষর’, ‘রাজা’, ‘সাজঘর’ (নাটক), ‘জীবনস্বপ্ন’ (উপন্যাস) ছাড়াও প্রচুর পাঠ্যপুস্তক রচনা করে খ্যাতি পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে অনেক শিক্ষকই শিক্ষকতার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। প্রভাতকুমার আচার্য, প্রদ্যোত ঘোষ, পুষ্পজিৎ রায়, শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার চক্রবর্তী, অধ্যক্ষ জিবেন্দ্রনাথ বাগচি, অধ্যক্ষ অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত প্রমুখের নামও স্মরণযোগ্য।
মালদহ কলেজ যেমন অস্থায়ী ভবনে নিজের পথচলা শুরু করেছিল, তেমনই অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পথ চলা শুরু করতে সাহায্যও করেছে। মালদহ পলিটেকনিক কলেজ, শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় মালদহ কলেজ থেকেই জয়যাত্রা শুরু করেছিল। মালদহ কলেজ পত্রিকাটিও জ্ঞানচর্চার দিশারি হিসেবে কাজ করে গিয়েছে।
এ কলেজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কলেজ হিসেবে স্থায়ী আসন লাভ করবে বলেই আশা বর্তমান অধ্যক্ষ মানসকুমার বৈদ্যের। ১৯৯৪ সালে সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের পর এ বছর প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী শুরু হয়েছে ১০ জানুয়ারি। চলবে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, কবি সম্মেলন, পুনর্মিলন, আলোচনা সভা, নাট্যোৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার সমস্ত কিছুই শুরু হয়েছে। চলছেও সুচারু ভাবে। (শেষ)
(লেখক গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)