ভেঙে পড়া সেতুর নীচে। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।
এই বার কোন ব্রিজ, কোন ফ্লাইওভার? মঙ্গলবার বিকাল হইতে কলিকাতাবাসী মনে মনে হিসাব কষিয়া চলিতেছেন। কোন ফ্লাইওভারের স্তম্ভে ফাটল ধরিয়াছে, কোন ব্রিজের ওজন তাহার বহনক্ষমতার অধিক, কোন রাস্তায় হঠাৎ ধস নামিতে পারে? মহানগরের বাসিন্দাদের তো এমন আতঙ্কে বাঁচিবার কথা নহে। সরকারের উপর ভরসা করিবার কথা। আশ্বস্ত থাকিবার কথা যে, সরকার আছে, পুরসভা আছে— শহরের পথঘাট বিপজ্জনক হইয়া উঠিবার পূর্বেই তাহার রক্ষণাবেক্ষণ হইবে। সকালে ঘর ছাড়িবার সময় সন্ধ্যায় অক্ষত দেহে, যথাসময়ে ঘরে ফিরিবার নিশ্চয়তা থাকিবে। কিন্তু কলিকাতাবাসী জানেন, এই আশ্বাস তাঁহাদের জন্য নহে। প্রথমে উল্টাডাঙা ফ্লাইওভার, তাহার পর বিবেকানন্দ রোডের নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভার, এবং মঙ্গলবার মাঝেরহাট ব্রিজ— কয়েক বৎসরের মধ্যে তিন তিনটি দুর্ঘটনা যাবতীয় বিশ্বাসের ভিত্তি টলাইয়া দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সেতুগুলির গায়ের রং বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সম্ভবত সজাগ। তবে দুর্ভাগ্য, বিপদ ঠেকাইতে পারে, সেই ক্ষমতা সেতুর রঙের নাই। সেই ক্ষমতা সেতুর গঠনেরই থাকিবার কথা। মাঝেরহাট ব্রিজের ভাঙিয়া পড়ার সংবাদে প্রথমেই মনে হয়— বিবেকানন্দ রোড ফ্লাইওভার ভাঙিবার জন্য কাহারও শাস্তি হইয়াছে কি? সরকার সেই অপরাধীদের শনাক্ত করিয়াছে কি? এ সব কথাই কিন্তু শহরবাসীর জানা প্রয়োজন ছিল। জানা প্রয়োজন ছিল, গত বৎসর অক্টোবরে মাঝেরহাট ব্রিজের সংস্কারের জন্য টাকা বরাদ্দ হইবার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরও এক বৎসরে সেই কাজ হইল না কেন। সেই দীর্ঘসূত্রিতার বিরুদ্ধেই বা সরকার কী করিল।
এমতাবস্থায় শহরবাসী যদি সিদ্ধান্ত করেন, যাহারা কর্তব্যে অবহেলা করে, যাহারা শহরকে এমন বিভীষিকার দিকে ঠেলিয়া দেয়, নাগরিক প্রাণের বিন্দুমাত্র মর্যাদা দেয় না, ঠিক রাজনৈতিক ছাতার তলায় থাকিতে পারিলেই তাহারা অনন্ত রক্ষাকবচের অধিকারী— নাগরিকদের দোষ দেওয়া মুশকিল। বিভিন্ন ঘটনাবলি হইতে ইঙ্গিত স্পষ্ট, কলিকাতা, এবং বৃহত্তর অর্থে গোটা রাজ্যই, ক্রমে চাপা পড়িতেছে নানা রাজনৈতিক রক্ষাকবচের তলায়। এখানে অপরাধী ভয় পায় না। অন্যায়কারীর ঠিক সময়ে শাস্তি হয় না। অথচ ধরা পড়িবার ভয় না থাকিলে, শাস্তির আশঙ্কা না থাকিলে সরকারি কাজে অবহেলা ঠেকাইবে কে। রাজ্যবাসী তাই বুঝিয়া লইয়াছেন, এই বিপুল অবহেলা এবং তজ্জনিত বিপদ মাথায় লইয়াই তাঁহাদের বাঁচিতে হইবে। প্রতি নিমেষে মৃত্যু আসিতে পারে জানিয়া জীবন অতিবাহন করিতে হইবে। আদরের পুত্রকন্যা বাড়ি হইতে বাহির হইলে ব্রিজ ভাঙিয়া তাহারা নিহত হইতেও পারে, এই ভয়ে কাঁটা হইয়া থাকিতে হইবে।
কেহ বলিতে পারেন, দুর্নীতিতে কলিকাতা অথবা বাংলা দেশে সর্বাগ্রগণ্য, তাহার যখন কোনও অকাট্য প্রমাণ নাই, তখন ফ্লাইওভার ভাঙিয়া পড়িবার জন্য দুর্নীতিকেই দায়ী করা হইবে কেন? কলিকাতায় কেন পর পর ফ্লাইওভার ভাঙিয়া পড়িতেছে, এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো নিহিত আছে দক্ষিণবঙ্গের ভূপ্রাকৃতিক কারণের মধ্যে। কথাটি সম্পূর্ণ উড়াইয়া দেওয়ার নহে। কিন্তু, ফ্লাইওভার কেন ভাঙিতেছে, সেই কারণ লইয়া জল্পনাকল্পনার প্রয়োজন কী? যথাবিধি তদন্ত হইলেই কারণটি বোঝা যাইবে। মাটির দোষ যদি থাকেও, মানুষের দোষ তাহাতে খণ্ডিত হইবে বলিয়া বোধ হয় না। নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আগে প্রয়োজন। কলিকাতায় কেমন নির্মাণ হইলে তাহা টেকসই হইবে, গবেষণা হউক। কিন্তু, যে চরম অবহেলায় সেতুগুলি শেষ অবধি ভাঙিয়া পড়িতেছে, তাহার জন্য দোষীদের যেন রেয়াত না করা হয়। শহরবাসীর প্রাণের দায়িত্ব যে সরকারের, প্রশাসনের— এই কথাটি যেন মুখ্যমন্ত্রী ভুলিয়া না যান।