সহযোদ্ধা: রাজনীতিতে দূরত্ব থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতায় পরস্পরের অতিনিকট ছিলেন মহাত্মা ও নেতাজি, হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশন, ১৯৩৮
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অশীন দাশগুপ্তের বাংলা ভাষায় লেখা গাঁধী-বিষয়ক বই মনিয়া ও অন্যান্য গান্ধী-র সূচনাবাক্যটি ছিল, “ভারতবর্ষ গান্ধীকে নেয়নি কিন্তু ভারতবর্ষ গান্ধীকে মনে রেখেছে।” এই মনে-রাখার দুই ধরন আমরা দেখে থাকি। একটি ভজনা— দেবতা সাজিয়ে পুজো করা। দ্বিতীয়টি ভিলেন বানিয়ে নিন্দামন্দ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতীয় কংগ্রেসের রমরমার যুগে প্রথম প্রবণতাটি দেখা পেত। এখন, ‘নতুন ভারত’-এ দ্বিতীয়টির প্রাধান্য। গাঁধীজি শুধু সমালোচিতই নন, উপহাসের, ব্যঙ্গবিদ্রুপের পাত্র। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে আমরা এখন এই ভাবেই গাঁধীজিকে মনে রাখছি।
এই বাংলায় কোনও দিনই অবশ্য গাঁধীজি জনপ্রিয় ছিলেন না। তার একটি কারণ বাংলার প্রিয় আইকন সুভাষ বসুর সঙ্গে তাঁর ‘বিরোধ’। তাঁর আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েই সুভাষের সঙ্গে কংগ্রেসের বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়। এর পাশাপাশি মার্ক্সবাদী ও কমিউনিস্টদের প্রভাবও বাংলায় বেশি, তাঁদের কঠোর সমালোচনাতেও গাঁধীজি বিদ্ধ হয়েছেন বরাবর। গাঁধী-সমালোচনার এই উর্বর জমিতে হিন্দুত্ববাদীরা ইদানীং ভাল রকম আবাদ শুরু করেছেন। তাতে ভালই ফসল উঠছে। কে, কেন, কী স্বার্থে এই গাঁধী-নিন্দার প্রসার চাইছেন, এই ধরনের প্রচার থেকে কারা লাভবান হতে পারেন, এ সব না ভেবেই আমরা গাঁধীজির অবমূল্যায়ন ঘটাচ্ছি।
গাঁধী সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা তাঁকে বুঝে সমালোচনা করব, না কি না-বুঝে নিন্দা করব? বিভিন্ন পক্ষের সমালোচনার ভিন্ন ভিন্ন হেতু ও দৃষ্টিকোণ কি আমরা খেয়াল রাখব না? লক্ষ করব না যে সুভাষচন্দ্র বা কমিউনিস্টরা গাঁধীজির ‘সমালোচক’ হলেও ব্যক্তি-গাঁধীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন? গাঁধীজির ধর্মীয় সহনশীলতা ও আপসহীন সাম্প্রদায়িকতাবাদ-বিরোধিতার প্রতিও তাঁরা ছিলেন শ্রদ্ধাবনত। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রেক্ষিত থেকে দেখলে সুভাষচন্দ্র-নেহরু-গাঁধীজি ও কমিউনিস্টরা কিন্তু ‘সহযোদ্ধা’ ছিলেন।
এ-ও খেয়াল রাখা প্রয়োজন, ‘যুদ্ধ’টা এখনও শেষ হয়নি, বরং কঠিনতম পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। যাঁরা এখনও হিন্দুরাষ্ট্র ও তার অনুসারী দর্শনের অবশ্যম্ভাবী বিজয়ে বিশ্বাস করেন না, এখনও মনে মনে শপথবদ্ধ যে বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও ছাড়া যাবে না, গাঁধীজিকে তাঁদের স্মরণে ও অনুধাবনে রাখতেই হবে। হ্যাঁ, শুধু স্মরণ নয়, অনুধাবনও। মহাত্মা গাঁধী, যিনি নিজেকে ‘সনাতন হিন্দু’ বলে দাবি করতেন, তাঁকে, তাঁর ধর্মভাবনাকে, এই আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের বাড়বাড়ন্তের যুগে বুঝে ওঠা ও তার থেকে শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
গাঁধীজি ধর্ম ও রাজনীতির বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাস করেননি। এই অর্থে তাঁর রাজনীতি সেকুলার ছিল না। কিন্তু তাঁর ধার্মিক রাজনীতির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মৌলিক তফাত ছিল। হিন্দুত্ববাদীদের মতো গাঁধীজি ভারতকে ‘হিন্দুদের দেশ’ মনে করতেন না। ভারত সব সম্প্রদায়েরই দেশ, কোনও ধর্মগোষ্ঠীর সেখানে অগ্রাধিকার নেই। হিন্দুত্ববাদীরা বিশ্বাস করেন ইসলাম বহিরাগত, মধ্যযুগের ইতিহাস হল হিন্দু ও মুসলমানের পারস্পরিক বিরোধ ও দ্বন্দ্বের কাহিনি। গাঁধীজি এই ভাবনার সঙ্গে একমত ছিলেন না। ইসলাম, খ্রিস্টান ধর্মকে হিন্দুধর্মের মতোই শান্তির ধর্ম বলে মনে করতেন। তাঁর ভাষায়, “আমি নিজে গোঁড়া হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও আমার ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে খ্রিস্টান মুসলমান ও জরথুস্ট্রের শিক্ষার কোনও বিরোধ দেখি না।” তাঁর প্রিয় কথা ‘সর্বধর্মসমভাব’।
দুই, হিন্দুত্ববাদীর কাছে ধর্ম একটা রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। গাঁধীজির কাছে ধর্ম একটি বিশ্বাস, নীতিনিষ্ঠ জীবনাচরণের অবলম্বন, আত্মিক উন্নতির সোপান, মানবসেবা। রাজনীতি এই সেবার অঙ্গ। অন্য দিকে, হিন্দুত্ববাদীদের কাছে ধর্মপরিচয় (হিন্দু) নেশন নির্মাণের উপকরণ, ‘অপর’-এর ধারণায় বিশ্বাসী। হিন্দুত্ববাদীদের এই ‘অপর’ হলেন মুসলমানেরা। গাঁধীজির ধর্মভাবনা ও নেশন ভাবনায় কিন্তু ‘অপর’-এর কোনও স্থান নেই।
তিন, সাম্প্রদায়িকতাবাদের মূল আধার হিংসা ও ঘৃণা। গাঁধীহত্যাকারী নাথুরাম গডসে মনে করতেন, গাঁধী তাঁর অহিংসার বাণী প্রচার করে হিন্দুদের ভীরু ও ভারত-রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দিতে সচেষ্ট। অন্য দিকে গাঁধীজি মনে করতেন, সত্য, প্রেম ও অহিংসার অনুসরণ এবং অনুশীলনেই মানুষ শক্তিশালী হয়; ‘সত্যাগ্রহ’ দুর্বল ও ভীরুর দর্শন নয়। অস্ত্রধারীর তুলনায় অহিংস সত্যাগ্রহী অনেক বেশি নৈতিক ও আত্মিক ভাবে বলীয়ান। হিংসা ও ঘৃণা অসত্যের আধার, তার অনুসরণে ধর্ম আর ধর্ম থাকে না। হিন্দুধর্মের সুরক্ষার জন্যেই তাই হিন্দুত্ববাদ বর্জনীয়। একই ভাবে গাঁধীজি পাকিস্তানের দাবিকেও ‘আন-ইসলামিক’ মনে করতেন। বলেছিলেন, ইসলাম মানবজাতির ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের প্রতিভূ, একতার ধ্বংসকারী নয়।
চার, হিন্দুত্ববাদীরা কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থক। গাঁধীজি রাষ্ট্রবাদী নন। তাঁর বাস্তববাদ রাষ্ট্রকে পুরোপুরি অস্বীকার করেনি, কিন্তু হেনরি ডেভিড থোরো-র সঙ্গে সহমত হয়ে তিনি বলেছেন, “সেই সরকারই সবচেয়ে উত্তম যা ন্যূনতম পরিমাণে শাসন করে।” যে জাতীয়তাবাদের আবাহন হিন্দুত্ববাদীরা চান, তার মধ্যে ব্যক্তির স্বাধীন ও স্বকীয় কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়, যেখানে বহু স্বরের কণ্ঠ রুদ্ধ। অন্য দিকে গাঁধীজি প্রবল ভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, তাঁর কাছে একমাত্র দিকনির্দেশিকা হল ‘সত্য’-এর কণ্ঠস্বর, বিবেকের সম্মতি। রাষ্ট্রের চাপানো আইন যদি সত্যকে লঙ্ঘন করে তবে তার বিরুদ্ধে তিনি সত্যাগ্রহেও প্রস্তুত। সংখ্যাগুরুর অভিমত সম্পর্কেও একই কথা— সত্যকে অবলম্বন করে তিনি একলা চলতেও রাজি। তাঁর ‘রামরাজ্য’ হল আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আত্মশাসন। এই ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক মানুষের অন্তরের ধর্মবোধ, কোনও সম্প্রদায়গত আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়।
পাঁচ, গাঁধীজি ভাবাবেগে নয়, যুক্তিতে বিশ্বাসী। ভিন্ন মতের তিনি এক জন আগ্রহী শ্রোতা। সত্য তাঁর কাছে কোনও পূর্বনির্ধারিত আপ্তবাক্য নয়, তা একটা ‘সন্ধান’— সত্যান্বেষী মানুষের নিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা। ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের সঙ্গে যৌক্তিক সংলাপ এই সত্যান্বেষণের প্রধান অবলম্বন। একই ভাবে গাঁধীজি আন্তর্ধর্ম সংলাপে বিশ্বাসী। তিনি মনে করতেন, মানবসৃষ্ট সব ধর্মগ্রন্থ বা শাস্ত্রগ্রন্থই অপূর্ণ— তাতে সত্যের উপাদান যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ভ্রান্তির চিহ্নও। প্রত্যেক মানুষের উচিত অন্য ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের ধর্মের মধ্যে নিহিত সত্যের অংশটির বিকাশ ঘটানো।
ছয়, হিন্দুত্ববাদীর কাছে রাম এক জন ঐতিহাসিক পুরুষ, অযোধ্যার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদটির ঠিক নীচেই তাঁর জন্মস্থান। গাঁধীজির রাম ঐতিহাসিক পুরুষ নন, তাঁর রামরাজ্য অযোধ্যার তথাকথিত রামরাজ্যের অনুরূপ শাসন নয়। বরঞ্চ গাঁধীজি ঐতিহাসিক রামচন্দ্র বা শ্রীকৃষ্ণের বিরোধী। ১৯৪৬-এ হরিজন পত্রিকায় লেখেন, “আমার রাম বা আমরা যে রামের ভজনা করি, তিনি দশরথপুত্র অযোধ্যার রাজা ঐতিহাসিক রাম নন। আমাদের রাম সনাতন, অজরামর ও অদ্বিতীয়।... এই রাম সকলের।” মহাভারত সম্পর্কে বলেন, “আমার কৃষ্ণের সঙ্গে কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তির সম্পর্ক নেই।... আমি যদি এ কথার প্রমাণ পাই যে মহাভারত আধুনিক অর্থে একটি ইতিহাস গ্রন্থ এবং মহাভারতের প্রতিটি শব্দ প্রামাণ্য ও মহাভারতোক্ত কৃষ্ণ সত্য সত্যই মহাভারতে বর্ণিত অনেকগুলি ঘটনার নায়ক, তা হলে হিন্দুসমাজ থেকে বহিষ্কৃত হবার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও আমি ওই কৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতাররূপে গ্রহণ করতে অস্বীকার করব।... এর অধিকাংশ রূপকাত্মক— ঐতিহাসিক দলিল নয়।”
প্রশ্ন উঠবে, গাঁধীজির ধর্মাশ্রিত রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনার সঙ্গে শুধু কি হিন্দুত্ববাদীদেরই বিরোধ ছিল? নেহরুর মতো ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ছিল না? ছিল। ‘ধর্ম’ নিয়ে নেহরু ছিলেন নিরুৎসাহ, ধর্ম ও রাজনীতির সম্পূর্ণ বিযুক্ত রাখায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভাবলে ভুল হবে যে, নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা গাঁধীজির ভাবনা থেকে অতি-দূরবর্তী। এক মিশনারির প্রশ্নের জবাবে গাঁধীজি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, “আমি যদি একনায়ক হতাম রাষ্ট্র ও ধর্মকে বিচ্ছিন্ন রাখতাম। আমি আমার ধর্মমতে শপথবদ্ধ, এর জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত। কিন্তু এ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা নেই। রাষ্ট্র দেখভাল করবে ধর্মনিরপেক্ষ ভালমন্দগুলি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বৈদেশিক সম্পর্ক, মুদ্রাব্যবস্থা প্রভৃতি কিছু, কিন্তু আপনার বা আমার ধর্মমত নয়” (হরিজন, ২২.০৯.১৯৪৬)। গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে আইনপ্রণয়নের দাবির সূত্রেও— রাষ্ট্র কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমত বা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত করুক, গাঁধীজি তা চাইতেন না।
সুতরাং আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, গাঁধীজিকে ভুল, মিথ্যা, ভণ্ড বলে প্রমাণ করতে পারলে কাদের বেশি লাভ। গাঁধীজির অবুঝ সমালোচনার সময় আমরা যেন ভেবে দেখি, গাঁধীজির অবমূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা নাথুরাম গডসের উত্তরসূরিদের সুবিধা করে দিচ্ছি না তো?
ইতিহাস বিভাগ, গভর্নমেন্ট জেনারেল ডিগ্রি কলেজ, গোপীবল্লভপুর