অঙ্কন: কুনাল বর্মণ
হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের তীব্র প্রতিবাদ, অভব্য আচরণ, সংস্কৃত ও বাংলা শ্লোকমিশ্রিত অনবরত গালি উপেক্ষা করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নাছোড় লড়াইয়ের ফলে শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই পাশ হয়ে গেল যুগান্তকারী ‘বিধবা বিবাহ আইন’। এর ফলে তৎকালীন হিন্দু সমাজে বাল্যবিধবা মেয়েদের সারা জীবন ধরে অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণার নিরসন ঘটল। তবে এই আন্দোলনে বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করেন মুর্শিদাবাদবাসীর কিয়দংশ। কেননা জেলাতে সৈয়দাবাদ নিবাসী কবিরাজ গঙ্গাধর সেনের নেতৃত্বে বিরুদ্ধ জনমত সংগঠিত করার উদ্যোগও চলেছিল। কাশিমবাজার রাজপরিবারের মহারানি স্বর্ণময়ীর অবশ্য এই আন্দোলনে সহযোগিতার কথা শোনা যায়। মদনমোহন নিজে মুর্শিদাবাদে বিধবাবিবাহের পক্ষে আইন পাশ করানোর জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহে নেমেছিলেন। তার পরে এ জেলা থেকেই ১৮৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার, সার্কেল পণ্ডিত সুরেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নেতৃত্বে গৃহীত স্বাক্ষরপত্র কলকাতায় পৌঁছয়। বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তনের পক্ষে ভারত সরকারের কাছে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রেরিত শতাধিক গণ-আবেদনপত্রে প্রথম স্বাক্ষরটি করেন পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার।
বিধবা বিবাহের ব্যাপারে মদনমোহনের দ্বিতীয় ও প্রধান কাজ ছিল আইন পাশের পরে বিধবা বিবাহের জন্য পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করা। সত্যি বলতে ২৬ জুলাই আইন পাশ হলেও সঙ্গে সঙ্গে কোনও বিধবা বিবাহ ঘটতে দেখা গেল না। তাই তো ঈশ্বরগুপ্ত কটাক্ষ করে লিখলেন, ‘‘গোলেমালে হরিবোল গন্ডগোল সার।/নাহি হয় ফলোদয় মিছে হাহাকার...।।’’
এ দিকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ও অগস্ট মাসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় অসুস্থ হয়ে পড়লেও মদনমোহন কিন্তু এ সময়ে নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। তিনি অবশ্য এই সময় এক মাসের ছুটিতে ছিলেন বলে ১৮৫৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘গভর্ণমেন্ট গেজেট’-এ তার উল্লেখ পাওয়া যায়। ছুটির সঠিক কারণ জানা না গেলেও বিধবা বিবাহের উদ্যোগ একটি কারণ বলে অনুমান করা হয়। অবশেষে তাঁরই বিশেষ প্রযত্নে বিধবা কন্যা ও তার মাতাকে কলকাতায় প্রেরণ করা হয়। তিনিই ছিলেন প্রথম পরিণীতা বিধবা বালিকার সংযোজন-কর্তা। প্রথমে বেথুন সাহেবের ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’-এ দুই কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে সম্প্রদান এবং পরে প্রথম বিধবা বিবাহের সাহায্য করায় তাঁকে স্বদেশীয় লোকের দ্বারা ৮-৯ বছর সমাজচ্যুত হতে হয়। শুধু তাই নয়, তাঁকে শুনতে হয়েছিল, ‘ওরে মদনা করলে কি।’
সেই সময়ে মুর্শিদাবাদে জজ পণ্ডিত পদে ১৫০ টাকা বেতনে কর্মরত ছিলেন বিদ্যাসাগরের সহপাঠী বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তখন সরকারি ভাবে ‘জজ পণ্ডিত’-এর এই পদকে বলা হত ‘নেটিভ ল অফিসার’। আদালতের কাছে হিন্দু আইনের প্রকৃত ব্যাখ্যা উপস্থািপত করায় ছিল জজ পণ্ডিতের প্রধান কাজ। তিনি ১৮৫০ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজের কাজ করে মুর্শিদাবাদের সদর বহরমপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। মুর্শিদাবাদে মদনমোহনের নতুন পদলাভ ও সেই উপলক্ষে স্থানান্তর যাওয়ার খবরে ১৮৫০ সালের ১ নভেম্বর তারিখে ‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়, ‘‘ ...জনরবে শুনা গেল যে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে মদনমোহন তর্কালঙ্কার বিচারীয় পন্ডিতের পদস্থ হওয়াতে উক্ত মহাত্মা (বেথুন) তাঁহার দ্বারা তথায় কলিকাতাস্থ স্ত্রীবিদ্যালয়ের ন্যায় এক বিদ্যালয় স্থাপন করাইবেন...।’’
সেই সময় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিমনস্কদের সঙ্গে সংস্কৃতজ্ঞ ও টুলো পণ্ডিতদের বাকযুদ্ধ চলছে। অপর দিকে আধুনিক শিক্ষার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহও বাড়ছে। সেই সুযোগে মদনমোহন স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মুর্শিদাবাদে ব্যাপক গণ-উদ্দীপনা সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। নানা জায়গায় তিনি সাধারণ জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে এ ব্যাপারে জনমত তৈরি করেন। ১৮৫৩ সালের ১০ অগস্ট ‘লোকাল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’-এর উদ্যোগে মুর্শিদাবাদে কলেজ ও স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য বহরমপুরে জেলা জজ ডি জে মনির বাড়িতে সভা ডাকা হয়। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন মদনমোহনের প্রধান সহযোগী পুলিনবিহারী সেন, রামদাস সেন, নবাব বেগম, দেশীয় জমিদার-সহ প্রায় ২০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এই মহতী সভায় ব্যক্তিগত ভাবে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ৫০ টাকা আর্থিক সহায়তা করেন। সেই দিনের সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত ও আবেদনপত্র গভর্নরের কাছে পাঠানো হয়।
অবশেষে স্বপ্ন ও বাস্তবের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক অনাস্বাদিত উৎসের সন্ধান পেল মুর্শিদাবাদ। বঙ্গীয় সরকারের ১৮৫৩ সালের ২৬ অক্টোবরের ১৯১৩ নং আদেশপত্রের ঘোষণা অনুযায়ী ১৮৫৩ সালের ১ নভেম্বর বর্তমান ঋত্বিক সদন সংলগ্ন ‘মেন হস্টেল’-এ ‘বহরমপুর কলেজ’-এর উদ্বোধন হয়। ১১৭ জন ছাত্রকে নিয়ে নিয়মিত ক্লাস শুরু হয় ২১ নভেম্বর। ১৮৫৫ সালে বহরমপুর কলেজের স্কুল বিভাগের বাংলা পরীক্ষার পরীক্ষক ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার নিজে।
মদনমোহন ১৮৫৫ সালের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত জজ পণ্ডিতের দায়িত্বভার সম্পন্ন করেন। তবে কোর্টে এই কাজের জন্য তেমন ডাক না পড়ায় বাড়িতেই প্রায় কর্মহীন অবস্থায় বসে থাকতেন। তাই কর্মী ও কাজপাগল মদনমোহন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন এবং স্বাস্থ্যকর নিবাস ময়ূরাক্ষীর তীরে কান্দিতে বদলির জন্যও অনুরোধ করেন। ফলস্বরূপ, তিনি ২৮ নভেম্বর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হন। এর এক বছর সময়কাল পরে আনুমানিক ১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসের একেবারে গোড়ার দিকে তিনি কান্দিতে বদলি হয়ে আসেন। কারণ ওই সময়েই মুর্শিদাবাদ জেলায় ‘জামুয়া কান্দী’ নামে একটি নতুন ‘এলাকা খন্ড’ বা মহকুমা সৃষ্টি হয় এবং মদনমোহন ওই মহকুমার প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর নিযুক্ত হন। কান্দিতে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় ও ইংরেজি স্কুলও স্থাপন করেন। কান্দির রাস্তাঘাট নির্মাণ, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি। কান্দি ছিল মদনমোহনের কীর্তির চরমস্থান।
কান্দিতে থাকাকালীন সময়ে কোনও একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর শারীরিক আঘাতপ্রাপ্তি ঘটে এবং মানসিক ভাবেও বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণের বিবরণে পাওয়া যায়, কান্দি-সংলগ্ন মাকালতোড় নামক গ্রামে প্রতি বছর দুই দুর্দান্ত মুসলমান জমিদারের কৃত্রিম যুদ্ধ হত। সেই যুদ্ধে (লড়াই) প্রতি বছর কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটত। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মদনমোহন ঘোড়ার পিঠে চেপে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে গিয়ে উভয় জমিদারের লেঠেল বাহিনীর হাতে প্রবল ভাবে প্রহৃত হন ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সংজ্ঞা ফেরার পরে কান্দিতে ফিরে এসে পুনরায় মাকালতোড় গিয়ে অপরাধীদের ধরে আদালতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু জমিদারদের ভয়ে কেউ অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেওয়ায় অপরাধীরা মুক্তি পেয়ে যায়। এই ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আজ আমার অর্ধমৃত্যু হইল।’’ ওই ঘটনার প্রায় দু’মাস পরে কান্দিতে ১৮৫৮ সালের ৯ মার্চ ওলাওঠা রোগে তাঁর মৃত্যু হয়।
শিক্ষক, কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল
গ্রন্থ ঋণ— ১) মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্মারকগ্রন্থ: ড.নির্মল দাশ
২) কৃষ্ণনাথ কলেজ শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ