ভদ্রলোককে চিনি বেশ কিছু দিন। বাজারে আলাপ। এঁর ভাই উত্তরবঙ্গের ডাকসাইটে বামপন্থী নেতা। হাসিখুশি প্রবীণ মানুষটির কথাবার্তায় এক ধরনের রাজনীতির ঝোঁক তাঁর পূর্ববঙ্গীয় টানে মিশে থাকে। যদিও নিজে কোনও দলীয় পদাধিকারী নন। সে দিন দেখা হতে ভোটের হালচাল, বিশেষত উত্তরবঙ্গের অবস্থা, জানতে চাইলাম। একটু তেতো হেসে খাটো গলায় বললেন, “আমরা তো পারলাম না, অরা যদি পারে!” জবাব শুনে সপ্রশ্ন চাইতে উনি বললেন, “এখন এইটাই আমার রাজনীতি।” এই রাজনীতিই কি এই রাজ্যে বামপন্থী সমর্থকদের (দলের সদস্য বা নেতৃবৃন্দের কথা বলছি না) রাজনীতি? ইতিউতি কান পাতলে এমনটা শোনা যাচ্ছে বটে। ‘একুশে ওরা, ছাব্বিশে আমরা’ আদি নানা গুঞ্জন বঙ্গভূমির ভোট-(কু)রঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে কি এ বার ‘বাম’ থেকে ‘রাম’! ভোটবিজ্ঞানের রীতি মেনে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার কথা ধরতে হয়, পঞ্চায়েত ভোটে সার্বিক ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারার ক্ষোভও আঁচ করা যায়।
তৃণমূল স্তরে কার সমর্থন কোথায় দাঁড়িয়ে, তার ঠিক হদিশ না পাওয়ায় সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে সবাই খানিক ধন্দে। পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন, যা এই রাজ্যের আইন অনুযায়ী বহু বিষয়েই রাজ্য সরকারের মুখাপেক্ষী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাও সাধারণত রাজ্য পুলিশের হাতে থাকে। ফলে বিরোধীরা প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগ করতেই পারেন। বাম আমলেও করতেন, অবস্থান বদলে এখনও করেন। কিন্তু ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর মে মাসেরই শেষ দিকে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মহেশতলা বিধানসভার উপনির্বাচন হয়, যার পরিচালনার দায়িত্বে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনই ছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিপরীতে এই নির্বাচন ছিল সংবাদমাধ্যমের ভাষায় ‘শান্তিপূর্ণ’। ওই অবস্থাতেও কিন্তু শাসক দলের প্রার্থী বিজেপি প্রার্থীকে ৬২,৮২৭ ভোটে পরাস্ত করেন, যেখানে কংগ্রেস সমর্থিত বাম প্রার্থী পান ৩০,৩১৬। তাই পঞ্চায়েত ভোটের ফল থেকে স্পষ্ট ধারণা না করা গেলেও দু’ভাবে এ বারের ভোটের হালচাল বোঝা সম্ভব। এক, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে রাজ্যে বিজেপি দ্রুত দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। দুই, তা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তার এখনও পার্থক্য বিস্তর।
অনেকে বলতে পারেন, মহেশতলা দিয়ে গোটা রাজ্যের বিচার হয় না। তা ছাড়া, তৃণমূল থেকেও তো ভোট বিজেপির দিকে আসতে পারে। পারে, কিন্তু তার অনুপাত এত দূর হওয়া কঠিন (অন্যান্য কারণ ছেড়ে দিলেও স্রেফ ক্ষমতায় থাকার কারণেই) যে ওই সাড়ে ৩২ হাজারই বিজেপি পেয়ে যাবে! এবং মহেশতলাই রাজ্য নয় বটে, কিন্তু (ক) পঞ্চায়েতের পরেই সেখানে ভোট হয়; (খ) সেখানে বিজেপির দু’নম্বরে আসা স্পষ্ট হয়, (গ) তা হয় বামেদের ভোটে ভাগ বসিয়েই। যদিও ২০১৬ বিধানসভা ভোটে ওই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থীর (৯৩,৬৭৫ ভোট) ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছিলেন সিপিএমের প্রার্থী (৮১,২২৩ ভোট) এবং বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিলেন মাত্র ১৪,৯০৯টি ভোট। দু’বছরেই ‘বাম’ ও ‘রাম’-এর এতটা অবস্থান বদল চোখে পড়ার মতোই।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তাই, পঞ্চায়েত ভোটের ‘সঠিক’ হিসেব না থাকলেও বিধানসভা (’১৬) ও লোকসভার (’১৪) ভোট এবং উপনির্বাচনগুলির ফলাফল বিচার করেও অবস্থার কিছুটা হদিশ মিলতে পারে। ২০১৪’য় দেশ জুড়ে ‘মোদী হাওয়া’র জেরে এ রাজ্যে বিজেপি এক লাফে প্রায় ১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭.০২; ২০১৬’র বিধানসভায় বাম+কং আসন সমঝোতার সময় তা নেমে যায় ১০.২-তে। ২০১৪’য় বাম ও কংগ্রেস পৃথক ভাবে লড়ে পেয়েছিল ২৯.৭১ ও ৯.৫৮, আর তৃণমূল ৩৯.০৫ শতাংশ। ২০১৬’তে বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতা হলে তাদের নিয়ে বিরোধী পক্ষ ও মিডিয়ার প্রত্যাশা ছিল তুঙ্গে। প্রসঙ্গত, ২০১১’তে ক্ষমতা হারালেও বামেদের ভোট ও সংগঠন কিন্তু ২০১৬’তেও রাজ্য-জোড়া আর তিনটি জেলায় কংগ্রেসও শক্তিশালী ছিল। সে বারও তাদের মিলিত ভোট ৩৮ শতাংশ, তৃণমূল পেয়েছিল ৪৪.৯। অর্থাৎ ৬-৭ শতাংশের ফারাক।
এই অবস্থা উল্টে গিয়ে কি বিজেপি ১৭ থেকে ৩৮ শতাংশে উঠবে, আর পৃথক পৃথক ভাবে কংগ্রেস ও বামেরা নেমে যাবে ১০ শতাংশে? তাদের এতটা বিপর্যয় বোধ হয় উত্তরবঙ্গের ওই প্রবীণ মানুষটিও আশা করেন না। আর বাজারে যতই ফিসফাস ও নানা রটনা থাকুক, বেশ কিছু দায়িত্ববান বাম ও কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, নিজেরা ‘বিলীন’ হয়ে শত্রুর শত্রুকে বলীয়ান করে দিলে যে শেষমেশ নিজেদেরই অস্তিত্বের চরম সঙ্কট ঘনিয়ে আসবে, সে বিষয়ে তাঁরা পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল।
অতএব, বিজেপি বহু আসনেই তৃণমূলের সবচেয়ে কাছে চলে এলেও একটা মোটামুটি ফারাক থেকেই যাচ্ছে। এই ফারাক অতিক্রম করে তারা বেশ কিছু আসনে ‘এক নম্বর’ হওয়ার লক্ষ্যে মরণপণ করছে, কিন্তু ক’টি জায়গায় তারা শেষ অবধি সফল হবে সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত নয়।
সংখ্যাতত্ত্ব ছেড়ে রাজ্য রাজনীতির দু’একটি মাত্রার নিরিখেও বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করতে পারি। প্রথম মাত্রাটি হল গ্রাম ও শহরের তফাত। এ রাজ্যে শহরের ভোটার বরাবরই দ্রুত নতুন সরকারের প্রতি অসহিষ্ণু ও স্বভাব-পরিবর্তনকামী। স্বাধীনতার কিছু দিন পর থেকেই কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী শহরাঞ্চলে বিরোধী বামপন্থীদের প্রভাব বাড়তে থাকে, গ্রামে কিন্তু তখন শাসক দল কংগ্রেসের একাধিপত্য। ১৯৬৭ ও ’৬৯-র প্রথম দু’টি ক্ষণস্থায়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ও গ্রামে কংগ্রেস ও শহরে বামেদের এই দাপট অনেক দিন বজায় ছিল, এমনকি ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকারেরও প্রথম দিক অবধি। এর পর থেকে গ্রাম বামেদের দখলে যেতে থাকে আর শহরে বিরোধীদের (তখন কংগ্রেসের) প্রভাব বাড়তে থাকে। সেই সময় গ্রামে বাম একাধিপত্য এতটাই যে ১৯৯০-এর গোড়ায় একটি সংবাদ-ম্যাগাজ়িন তাদের প্রচ্ছদ নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিল: জ্যোতি বাসু রুলস বেঙ্গল ফ্রম ভিলেজেস! সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের আগে অবধি এই প্রভাব টিকে ছিল। আজ গ্রামে প্রভাবের সিংহভাগ তৃণমূলের। তাই, লোকসভা কেন্দ্রগুলির শহুরে অংশে যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ‘হাওয়া’, গ্রামে তার অনেকটাই বায়ুর্ভূত হয়ে যাবে, যদি না ‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম’-এর মতো কোনও দিকচিহ্ন বদলের ঘটনা ঘটে থাকে।
দ্বিতীয় মাত্রাটি সংগঠনের, বিশেষত ভোট সংগঠনের। এর মধ্যে অবশ্যই হিংসা, ছাপ্পা ভোটের মতো নিন্দনীয় দিকও আছে, যা এই রাজ্যে চিন্তাজনক ভাবে ১৯৭০-এর দশক থেকেই ক্রমশ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সংগঠনের সদর্থক দিকও আছে। ভোটারদের (নিজের ও বিরোধীদের) বারো মাস ‘চেনা’র সংগঠন এবং ভোটের দিন নিজস্ব ভোটারদের বুথ-মুখো করার সংগঠন। সিপিএম দীর্ঘদিন এটা সফল ভাবে করে এসেছে। ক্যাডারভিত্তিক বিজেপিও রাজস্থান গুজরাত মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে এ কাজ করে চলেছে, এরই জেরে এই সব রাজ্যে তারা অনেক সময়েই কংগ্রেসের থেকে এগিয়ে। বাংলায় এই সংগঠনের অনেকটাই এখন তৃণমূলের করায়ত্ত। অন্তত, এ যাবৎ ভোট দেখে এটাই মনে হয়েছে। আসল বোঝা অবশ্যই ২৩ মে-র জন্য তোলা রইল!
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক