নির্বাচনে হিংসা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু যে মানুষগুলো নির্বাচনী হিংসায় অংশ নেন, বিভিন্ন দলের হয়ে ‘যুদ্ধ’ করে হাত-পা-জীবন হারান, তাঁরা থেকে যান আলোচনার পিছনে। এঁদের অস্তিত্ব কোনও দল স্বীকার করে না। নেতাদের বয়ানে তাঁরা বিরোধী দলের গুন্ডা, নয় অজ্ঞাত সমাজবিরোধী। নির্বাচনের অচ্ছেদ্য অংশ হয়েও এরা অদৃশ্য।
মুখোমুখি বসলে কী বলেন তাঁরা? দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক রাজনৈতিক দলের কর্মী (দলীয় বাহিনীতে কমান্ডার গোছের) মনে করেন, ভোটের সময় যা হয় সেটা ‘সন্ত্রাস’ নয়। সামান্য পেশি প্রদর্শন। এ ভাবেই গণতন্ত্র চলে, এটাই পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য। যে ভাবে ভোটকর্মীদের প্রশিক্ষণ হয়, তেমন ‘রুটিন’ ধরে নির্বাচনের মাসখানেক আগে থেকে এলাকার বেকার যুবকদের সান্ধ্য বৈঠকে নির্বাচনের হিসেব, সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরির নকশা আঁকা হয়।
বাংলায় রাজনীতিতে হিংসাশ্রয়ী ধারার উদাহরণ অসংখ্য— ব্রিটিশ শাসনের প্রতিরোধে অগ্নিযুগের অনুশীলন সমিতি, যুগান্তরের বিপ্লবীরা, সত্তরের দশকে নকশালকর্মীরা হিংসাকেই অস্ত্র করেছিলেন। কেন হিংসা, তার ব্যাখ্যাও তাঁরা দিয়েছেন। কিন্তু আজ নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের লড়াইতে হিংসার নৈতিক ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। যাঁরা ভোটের আগে, বা ভোটের দিন হিংসায় জড়ান, তাঁরা অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দরকষাকষি করেন। দর বুঝে দল স্থির হয়। রাখঢাক নেই।
একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী প্রথম দফার নির্বাচনের সাত দিন আগে উত্তরবঙ্গে ছুটলেন। ওখানে গিয়ে তাঁর কাজটা কী? তিনি বোঝালেন, স্থানীয় কর্মীদের মনোবল বাড়াতে নির্বাচনের দিন তাদের নিয়ে এলাকা টহল দেওয়া, দাপট দেখানো (এরিয়া ডমিনেশন), ‘মাল রেডি রাখা’ তাঁর কাজ। যদি দেখা যায় নির্বাচনের দিন অন্য কোনও দল ভাল ভোট করাচ্ছে সে ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তৈরি করতে সাহায্য করা, সেটা বোমাবাজি হতে পারে, ওয়ান-শটার দেখানো হতে পারে। এতেই মানুষ ভয় পেয়ে ভোট দিতে কম আসবেন। উদ্দেশ্য সফল হবে। ভোটের ‘অ্যাকশন’-এর জন্য বহিরাগতদের আনা হয়। কেন? আর একটি দলের প্রাক্তন কমান্ডার, মধ্য কলকাতার দাপুটে দলকর্মী বললেন, স্থানীয়দের খুনোখুনিতে জড়ালে পার্টির মুখরক্ষা মুশকিল। তাই বাইরে থেকে আনতে হয় কর্মীদের।
ভোটের হিংসায় যাঁরা প্রাণ দেন, তাঁদের অধিকাংশ একেবারে পদাতিক সৈনিক। ব্যবসা রক্ষা বা রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল, কোনও উদ্দেশ্যই তাঁদের নেই। বেশির ভাগ অল্পবয়সি অল্পশিক্ষিত, পাড়ার বা গ্রামের ক্লাবের মধ্যে দিয়ে রাজনীতি ও দূর্বৃত্তায়নে হাতেখড়ি। স্থায়ী কাজ নেই, ছোটখাটো কাজের পাশাপাশি ভোটের মরসুমে রাজনৈতিক দাদাদের প্রভাবে কিছু অর্থ উপার্জন, ওয়ান-শটার স্পর্শে নায়ক হওয়ার অনুভূতি, অক্লেশে জুটে যাওয়া সান্ধ্যকালীন খাদ্য-পানীয়, স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তির ঘনিষ্ঠ থাকার সুবিধা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে পেশাদার দুষ্কৃতীরা। নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক দলের হয়ে ভাড়া খাটে। এরা প্রশিক্ষিত, এবং প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। একটি দলের কথা জানা গেল, যারা সুন্দরবন অঞ্চলে ডাকাতি করে, ভোটের সময় দক্ষতার কারণে চাহিদা প্রচুর।
খনি অঞ্চলে দেখা যায়, বেআইনি কয়লার ব্যবসাদার নির্বাচনে মস্তানি ও দাপাদাপি করার লোক সরবরাহ করছেন। ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই বললেন, এ সব অঞ্চলে ব্যবসা করার শর্ত হল প্রভাবশালী নেতাকে মাসোহারা ছাড়াও নির্বাচনে অর্থ ও লোকবল দিয়ে সাহায্য করতে হবে। বালি মাফিয়া, বর্ডার পেরিয়ে গরু পাচার, বিস্তীর্ণ বাংলাদেশ আর নেপাল বর্ডারের চোরাকারবারের ক্ষেত্র বা সিন্ডিকেট ব্যবসা, সব ক্ষেত্রেই সমীকরণটি একই। নির্বাচনে খাটলে যে হেতু কিছুটা বেশি উপার্জন হয়, খাদানের অবৈধ শ্রমিক, বা চোরাকারবারে যুক্ত মানুষগুলিও সে কাজে যুক্ত হন।
আইন আর অপরাধের মাঝমাঝি ছায়াচ্ছন্ন ভূমিতে বাস করেন যাঁরা, নির্বাচনের সময় বাদ দিলেও জীবিকার প্রয়োজনে দৈনন্দিন এতটাই ঝুঁকি নিয়ে বাঁচতে হয় তাঁদের, যে রাজনৈতিক হিংসা আলাদা অনুভূতি জাগায় না। কালো অর্থনীতিতে থাকা শ্রমজীবীকে দুর্বৃত্তায়নের পাঠ নিতেই হয়। পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে অপরাধেও দক্ষতা অর্জন করতে হয়।
অর্থনীতিবিদ অরুণ কুমার ২০১৭ সালে প্রকাশিত আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য ব্ল্যাক ইকনমি অ্যান্ড ব্ল্যাক মানি ইন ইন্ডিয়া বইটিতে দেখিয়েছেন ভারতবর্ষের জাতীয় উৎপাদনের বাষট্টি শতাংশ কালো অর্থনীতির টাকা (কালো টাকা নয়), যা কৃষি ও শিল্পের সম্মিলিত অবদানের চেয়ে বেশি। বিতর্কিত এই গবেষণার কিছুটাও যদি সত্যি হয়, তবে মেনে নিতে হবে যে রাজনৈতিক দলগুলির পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই অর্থনীতি চলতে পারে না। কালো অর্থনীতি ও তার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য সাধারণ জীবন স্বতঃই অপরাধে নিমজ্জিত।
সেই বেআইনি অর্থনীতিকে চালু রাখতে নির্বাচনী গণতন্ত্রকেই খেসারত দিতে হয়। যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা আর অবৈধ কারবারের চাবিকাঠি হাতে রাখতে ময়দানে নামানো হয় কিছু বোড়ে, ভদ্রলোকের ভাষায় যারা ‘সমাজবিরোধী’। কাজ হয়ে গেলে সমাজ তাদের দ্রুত সরিয়ে দেয় আড়ালে। ভোটের দিন গুলি-বোমা চলবে, মৃতের সংখ্যা খবর হবে, এটাই এ রাজ্যের ঐতিহ্য। কার কাঁধে রেখে চালানো হল বন্দুক, কাকে গুলিতে মরতে হল, কে খবর রাখে?