সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব পদে যোগ দিলেন ন’জন ‘বহিরাগত।’ সরকারি তাসের দেশে উতল হাওয়া বইয়ে দিতে বহিরাগত রাজপুত্র সওদাগরপুত্রদের ডেকে আনা খুব নতুন কিছু নয়। এ ভাবেই এসেছিলেন ভারতীয় পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং-এর জনক ভি কৃষ্ণমূর্তি, জাতীয় তাপ বিদ্যুৎ নিগমের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডি ভি কপূর, প্রতিরক্ষা উৎপাদন বিভাগের সচিবের ভূমিকায় ইঞ্জিনিয়ার ম্যানুয়েল মেঞ্জেস, কৃষি সচিবের দায়িত্বে এম এস স্বামীনাথন। ভারতের প্রথম রোডস স্কলার রসায়নবিজ্ঞানী লভরাজ কুমার নিয়েছিলেন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের সচিবের ভার। এসেছিলেন মনমোহন সিংহ, আই জি পটেল, বিজয় কেলকার। প্রশাসনের ‘চিড়িতন-হরতন-ইশকাবন’-দের নিয়েই তাঁদের কাজের উৎকর্ষ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এই প্রতিভাধর ব্যক্তিদের প্রতিভা সরকারি প্রশাসক মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। মন্ত্রকের উচ্চতম প্রশাসনিক আসন তাঁদের জন্য ছেড়ে দিতে কোনও আধিকারিক আপত্তি জানাননি। তাঁদের নেতৃত্বে কাজ করতে অনিচ্ছুক হননি। কথাগুলো বলা জরুরি, কারণ ওই ন’জন ব্যক্তি বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে আসার পর নানা সংবাদমাধ্যমে এমন মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে যে, আইএএস-সহ অন্য প্রশাসনিক শাখার আধিকারিকরা নিজেদের মৌরসিপাট্টা অব্যাহত রাখতে উদ্ভাবনী উদ্যোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকেন।
আবার, বহিরাগত বিশেষজ্ঞরা সর্বদাই সফল, তা-ও নয়। যে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মহলের মধ্যে আনাগোনা অবাধ, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক’দিন আগে সেক্রেটারি অব স্টেট পদ থেকে বরখাস্ত হলেন রেক্স টিলারসন। সরকারে যোগ দেওয়ার আগে এগারো বছর তেল ও গ্যাস কোম্পানি ‘এক্সনমোবিল’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে নিয়োগ করার বছরখানেকের মধ্যেই টিলারসনের কাজের পদ্ধতির প্রতিবাদ করে বিদেশ বিভাগের ষাট শতাংশ আধিকারিক চাকরি ছেড়ে দেন। সরকারি চাকরির জন্য দরখাস্ত নেমে আসে অর্ধেকে। ট্রাম্প তাঁকে বিদায় করতে বাধ্য হন।
স্বাধীনতার সময়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা চেয়েছিলেন, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস অবলুপ্ত হোক। সর্দার বল্লভভাই পটেল আপত্তি করে বলেছিলেন, প্রশাসনিক পরিষেবার মূল কাঠামো রাখতে হবে, তবে সংস্কার করতে হবে। সেই সময়ে বাবাসাহেব অম্বেডকর জোর সওয়াল করেছিলেন প্রশাসনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার। প্রশাসকরা হবেন সংবিধানের প্রহরী, এই ছিল তাঁদের আশা।
তাই স্বাধীন ভারতে প্রশাসকদের গুরুত্ব কমল না। আজও আইএএস পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের খবর নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখি। ২০১৬ সালে পরীক্ষায় বসার আবেদন করেছিলেন এগারো লক্ষেরও বেশি। প্রাথমিক পরীক্ষায় বসেন সাড়ে চার লক্ষের কিছু বেশি, চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য বিবেচিত হন প্রায় সাড়ে পনেরো হাজার, মৌখিক পরীক্ষার ডাক পান ২৯৬১ জন। শেষ অবধি আইএএস-সহ সব ধরনের সার্ভিসের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন সুপারিশ করেছিল ১২০৯টি নাম। শেষ ধাপ উত্তীর্ণ হয়ে সার্ভিসে যাঁরা এলেন, তাঁদের এক বড় অংশ আইআইটি, আইআইএম, এবং বিভিন্ন নামীদামি ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজে পড়েছেন। বেসরকারি সংস্থায় ভাল চাকরিও করতেন অনেকে। তাঁদের মেধা নিয়ে সংশয়ের কারণ দেখি না।
তবে সরকারি পরিষেবা এত জড়বৎ, দীর্ঘসূত্রী কেন? কারণগুলি অজানা নয়। সরকারি টাকা খরচের নিয়ম, প্রক্রিয়া এবং দায়বদ্ধতার মাপকাঠি বেসরকারির থেকে অনেক জটিল, সময়সাপেক্ষ। দীর্ঘ দিন ধরে কোনও সরকারই সেগুলির সংস্কার করার চেষ্টা করেনি। কাজে গতি আনতে ‘মিশন’ বা ‘যোজনা’ নাম দিয়ে কিছু কর্মসূচি এসেছে। কিন্তু সরকারি কাজের যে মূলস্রোত, অর্থাৎ বাজেট বরাদ্দ অনুসারে পরিকল্পনা মাফিক কাজে ব্যয়, তার গতি এখনও দীর্ঘ ও কুটিল। এ বিষয়ে সরকারি প্রশাসন ব্রিটিশ আমল থেকে খুব কিছু বদলায়নি। ১৯৬৪ ব্যাচের আইএএস এম কে কাও ‘ব্যুরোক্রেজি’ নামে একটি কৌতুক-উজ্জ্বল বইতে লিখেছিলেন, “মাথায় রাখতে হবে ‘সিদ্ধান্ত’ মানেই ঝুঁকি। কোনও এক দিন, কোনও এক স্তরে, কোনও ভাবে প্রমাণিত হবে সিদ্ধান্তটি ভুল, আর তখনই নরকবাস। সিদ্ধান্তগ্রহণ যদি এড়ানো না যায়, চেষ্টা করতে হবে সিদ্ধান্তটির পিছনের লোকটা কে, তা যেন চিহ্নিত না করা যায়। সেই জন্য দরকার একটা কমিটি তৈরি করে ফেলা।’’
সংস্কারের চেষ্টা হয়নি, এমন নয়। স্বাধীনতার পর দু’টি প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি, সাতটি পে কমিশন-সহ অগণিত রিপোর্টে সমস্যাগুলি চর্চিত হয়েছে। যার একটা লাভ, সরকারের বাঁধা রীতিনীতির বাইরে কাজ করার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত কিছু ‘মিশন’, ‘এজেন্সি’ জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি। এ ছাড়া বিশেষ কিছু হয়নি।
দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন ও সপ্তম পে কমিশন, দু’টিরই রিপোর্ট প্রশাসনে “আড়াআড়ি প্রবেশ”-এর সুপারিশ করেছিল। ২০১৬ সালের অগস্টে সংসদে শশী তারুরের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ জানান, এ নিয়ে সরকার কিছু ভাবছে না। কিন্তু ২০১৮ সালে দশটি যুগ্মসচিব পদে ৩ বছরের মেয়াদে বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে “মেধাবী ও প্রণোদিত” কর্মীদের আবেদন চাইল সরকার। অবাক হতেই হল।
বিস্ময়ের প্রথম কারণ, যুগ্মসচিব পদটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বিভাগীয় দায়িত্বে নেই। প্রশাসনিক সিঁড়ির ধাপের নিরিখে ‘যুগ্মসচিব’ পদকে বলা চলে উচ্চ-মধ্যবর্তী স্তর। বিভাগ বা মন্ত্রকের কাজকর্মে এই পদাধিকারীর প্রভাব সীমিত। দ্বিতীয়ত, স্রেফ বিজ্ঞাপন দিলেই প্রতিভাবান কর্মীরা সফল বেসরকারি কেরিয়ার ফেলে তিন বছরের জন্য সরকারি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন কেন? প্রতিভা খুঁজে বার করতে হয়, টেবিল পেতে বসলেই পাওয়া যায় না। যে সব বেসরকারি বিশেষজ্ঞ সরকারি ক্ষেত্রেও দক্ষতা দেখিয়েছেন, তাঁরা দরখাস্ত করে আসেননি। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের সাড়ে চারশোর বেশি যুগ্ম সচিব পদ রয়েছে। ঠিক কোন দশ ধরনের বিশেষজ্ঞের অভাব পড়েছে, সেটিও বোঝা গেল না এই প্রক্রিয়া থেকে। চতুর্থত, আইএএস এবং কেন্দ্রীয় সার্ভিসগুলির নানা পদে যে সব আধিকারিক আছেন, তাঁদের মধ্যে থেকে এই ধরনের বিশেষজ্ঞ তৈরি করার চেষ্টাই বা করল না কেন সরকার? মেধার এত কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা কি তার যোগ্য নন?
ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন ছ’হাজারের বেশি দরখাস্ত পায় বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে। মৌখিক পরীক্ষায় আমন্ত্রিত প্রার্থীর সংখ্যা উননব্বই, শেষে নিযুক্ত হন তাঁদের ন’জন। অর্থাৎ প্রাথমিক আবেদনকারীদের নিরানব্বই শতাংশ বাদ পড়ে যান। অর্থ মন্ত্রকের পদটির জন্য কোনও দরখাস্তই বিবেচিত হয়নি। তিন বছরের জন্য নিযুক্ত হন এই ন’জন। তাঁদের কাজে সরকার সন্তুষ্ট হলে থাকবেন আরও দু’বছর। তার পর তাঁরা ফিরে যাবেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে। এতে ঠিক কার কী উপকার হল বুঝলাম না। কেমন যেন মনে হচ্ছে, এই ‘বি-আমলাকরণ’ প্রক্রিয়াটির সাফল্য বিমুদ্রাকরণের মতোই হবে!
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস