এ বারের নির্বাচনে নতুন ভোটার ঝুঁকে কার দিকে?

শেষ পর্যন্ত সহস্রাব্দের জাতকেরা কাকে বেছে নেবেন বা সার্বিক ভাবে তরুণ প্রজন্মের ভোট জাতীয় বা রাজ্য স্তরে কোন দিকে সুইং করবে, তা জানতে ২৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। লিখছেন অরিন্দম চক্রবর্তী এক মাসাধিক কালব্যাপী ভোটপর্ব। তা মিটে গেলে আগামী মাসের ২৩ তারিখ জানা যাবে, পরবর্তী পাঁচ বছরে কাদের হাতে যেতে চলেছে দেশের শাসনভার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০২:২৩
Share:

লোকসভা ভোট চলছে। পৃথিবীর সব চেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার উদ্‌যাপনের উৎসব।

Advertisement

এক মাসাধিক কালব্যাপী ভোটপর্ব। তা মিটে গেলে আগামী মাসের ২৩ তারিখ জানা যাবে, পরবর্তী পাঁচ বছরে কাদের হাতে যেতে চলেছে দেশের শাসনভার। কিন্তু কী হতে পারে তার পূর্বানুমান উঠে আসছে একাধিক সমীক্ষায়। প্রতিটি সমীক্ষায় যে বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, তা হল নতুন ভোটারেরা কী ভাবছেন। এবারের নতুন ভোটারদের কেউ কেউ নতুন সহস্রাব্দের জাতক। এই সহস্রাব্দের একদম দোরগোড়ায় যাঁরা জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা এবার প্রথম বার ভোট দেবেন। আগামী লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের ভোট বিশেষ নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?

এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৯০ কোটি। তার মধ্যে ৮.৪ কোটি মানে, মোট ভোটারের ৯ শতাংশ হল একদম নতুন ভোটার। যাঁরা এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এই নতুন ভোটারদের ভোট কোন দিকে যাবে, সেটা এবার লাখ টাকার প্রশ্ন। কারণ, প্রতিটি লোকসভা সিটে গড়ে এঁদের উপস্থিতি মোটামুটি ভাবে ১৫৪৬৯৬ জন করে। যদি গত ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়, তবে দেখা যায় যে প্রায় ১৮৮ সিটে জয়ের ব্যবধান ছিল এক লক্ষের কম। আমরা যদি ধরে নিই যে, গড়ে ৭০ শতাংশ ভোটদান হবে, তা হলে সিট পিছু ১০৮২৮৭ জন নতুন ভোটার ভোট দেবেন। যা বেশ বড় সংখ্যক সিটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।

Advertisement

নতুন ভোটারদের নিয়ে আলোচনার স্বভাবতই দু’টি প্রেক্ষিত রয়েছে। একটি সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত, অন্যটি রাজ্যের। জাতীয় স্তরে আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভলপিং সোসাইটি’ বা সিএসডিএস-এর সমীক্ষা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। বিগত ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল— এই সময়ের মধ্যে ১৮ থেকে ২৫ বছরের ভোটারদের যে পরিসংখ্যান সিএসডিএস-এর সমীক্ষায় উঠে এসেছে, তা হল— ২০১৪ সালে প্রথম বার এই বয়সের ভোটারদের ভোটদানের হার গড় ভোটদানের হারকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, বিগত লোকসভায় ভোটদানের ক্ষেত্রে তরুণ ভোটারদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়েছে। জাতীয় স্তরে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে যদি কংগ্রেস ও বিজেপির তুলনা করা হয়, তবে সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০৯ সালের পর থেকে তরুণ প্রজন্মের ভোট নারী-পুরুষ, গ্রাম-শহর, স্বল্পশিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত নির্বিশেষে বিজেপির পক্ষে গিয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভায় ১৮-২২ এই বয়সের ভোটারেরা কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপিকে দ্বিগুণ সংখ্যায় ভোট দিয়েছে। এবার কী হতে পারে?

সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নতুন ভোটারদের সমর্থন আদায়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন দল বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করেছে। বিজেপি তার ‘নমো যুব ভলান্টিয়ার্স’ উদ্যোগে একটি নির্দিষ্ট ফোন নম্বরে মিসড কলের মাধ্যমে নাম নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। যুব কংগ্রেস ২৫টি রাজ্যে তাদের ‘যুব ক্রান্তি যাত্রা’র মাধ্যমে মূলত নতুন ভোটার ও সংখ্যালঘু, দলিতদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। বিহারে জনতা দল (ইউনাইটেড) ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোরকে নতুন ভোটারদের পাণিপ্রার্থনা করার দায়িত্ব দিয়েছে। মহারাষ্ট্রে এনসিপি ১০০টি কলেজে সচেতনতা শিবির করে নতুন ভোটারদের দলে টানার চেষ্টা করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্রদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের উপর ক্যুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে এবং এখান থেকেই একটা সদস্যকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ফলে, বসে নেই কেউই।

সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যদি ধরে নেওয়া হয় যে, নতুন ভোটারদের মধ্যে একটা বাইপোলারাইজেশন ঘটবে, তবে বলা যায়, কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে তাদের ভোট বিজেপির দিকে যাবার সম্ভাবনা বেশি। বিমুদ্রাকরণজনিত দেশের আর্থিক ক্ষতি, বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ হওয়া, উগ্র হিন্দুত্ববাদ এই বিষয়গুলি নতুন ভোটারদের কাছে যতটা না বিবেচ্য হবে, তার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর ভাবমূর্তি বা সার্জিকাল স্ট্রাইককে ঘিরে জাতীয়তাবাদী আবেগ বা দেশের সুরক্ষা তাঁদের বেশি প্রভাবিত করতে পারে। অন্য দিকে, ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থান, কৃষক বা গরিবদের নিয়ে রাহুল গাঁধীর বিশেষ ভাবনা নতুন প্রজন্মের কিছু অংশকে প্রভাবিত করতে পারে।

রাজ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। আজকের যাঁরা নতুন ভোটার, তাঁরা সদ্য সদ্য স্কুল থেকে বেরিয়েছেন। স্কুল জীবনের শেষ কয়েক বছর তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট রাজ্য সরকারের একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পের উপভোক্তা হয়েছে তাঁরা। কেউ সবুজসাথীর সাইকেল পেয়েছেন, কেউ কন্যাশ্রীর টাকা। ফলে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এঁদের ভোটের একটা বড় অংশ রাজ্য সরকারের পক্ষে যেতে পারে। মমতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখার একটা আবেগও সবুজ-মনে কাজ করতে পারে। অবশ্য আমরা যদি ১৮ থেকে ২৫ বয়সের ভোটারদের কথা বিবেচনা করি, তবে এই প্রবণতা পালটে যেতে পারে। কারণ, এই তরুণ ভোটারদের অনেকেই বিগত দিনে দেখেছেন শিল্প-কারখানায় নতুন করে কোনও চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। যা-ও একসময়ে স্কুলের চাকরিটা প্রতিনিয়ত হত, সেটাও ধীরে ধীরে যেন দূরের গল্প হয়ে যাচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, স্বজনপোষণ, অর্থের লেনদেন— সব মিলে এই তরুণ ভোটারদের কিছুটা হলেও মোহভঙ্গ হয়েছে।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ভোটপূর্ব সমীক্ষা রাজ্যের ভোটারদের ক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত প্রবণতা নির্দেশ করেছে। বামপন্থী ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ শতাংশ বিজেপিতে চলে যাচ্ছে। এই নয় যে, বামপন্থীরা সব হিন্দুত্ববাদী হয়ে উঠেছেন। আসলে গ্রামবাংলায় ফল্গুধারার দু’টি স্রোত বইছে। এক, যে করেই হোক তৃণমূলকে হটাও। প্রয়োজনে আপাতত বিজেপিকে নিয়ে আসা হোক। পরে দেখা যাবে। দ্বিতীয় যে চেতনা কাজ করছে, তা হল ভোটকে কার্যকরী করা। সিপিএমকে ভোট দিলে বিরোধী ভোট নষ্ট হবে, তাই বিজেপিকে দাও। একটা ফল হয়তো পাওয়া যাবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে দ্বিতীয় প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তারা চায় তাদের ভোট ফলপ্রসূ হোক। সেক্ষেত্রে তাদের ভোট বিজেপিতে যাবার একটা সম্ভাবনা রয়েছে।

শেষ পর্যন্ত সহস্রাব্দের জাতকেরা কাকে বেছে নেবেন বা সার্বিক ভাবে তরুণ প্রজন্মের ভোট জাতীয় বা রাজ্য স্তরে কোন দিকে সুইং করবে, তা জানতে আমাদের ২৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। ততদিন অবধি গণতন্ত্র রক্ষায় অংশগ্রহণ চলুক।

মাজদিয়া সুধীরঞ্জন লাহিড়ি মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement