তৃণমূলের মিছিলে সশস্ত্র সমর্থক। ছবি: ভিডিয়ো থেকে নেওয়া
এমনিতেই নাগরিক আস্থা রাখতে পারেন না আর প্রশাসনে। যে সঙ্কটে বা সমস্যায় রাজনৈতিক রং সামান্যতমও রয়েছে, সেখানে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করা দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। আস্থা বা ভরসার যে সব অন্তরীপ এখনও টিকে রয়েছে, সেগুলোও ডুবে গেলে খুব মুশকিল।
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন মানেই বিভীষিকা যেন! নতুন নয় এ প্রবণতা, দশকের পর দশক ধরে চলছে। সম্প্রতি যেন আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে নির্বাচনী হিংসা। কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও শাসক বা কোনও বিরোধী এর দায় নিতে ইচ্ছুক কি না, সে প্রসঙ্গে গিয়ে যে লাভ নেই, আমরা সকলেই সম্ভবত বুঝে গিয়েছি সে কথা। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীও যদি দায় নিতে না পারে, তা হলে আরও দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ওঠে পরিস্থিতিটা।
বীরভূমের সাঁইথিয়ায় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে প্রকাশ্য মিছিল সেই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির উপসর্গ। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেও ঠিক এই পরিস্থিতিই দেখতে হয়েছিল বাংলাকে। আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসানি, নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিটা পর্ব থেকে সাধারণ তথা আইন-শৃঙ্খলা অনুসারী নাগরিকদের হঠিয়ে দিয়ে সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের প্রকাশ্য দাপট, কোথাও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, কোথাও দুষ্কৃতীর পক্ষে সক্রিয়তা— এমন অজস্র ছবি ধরা পড়েছিল বা অভিযোগ উঠে এসেছিল। সে সবের প্রতিবিধান কতটুকু হয়েছিল, তা আমাদের কারও অজানা নয়। ফলস্বরূপ রেকর্ড সংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফয়সলা হয়েছে, রেকর্ড সংখ্যক ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগই পাননি। সে নির্বাচন আয়োজিত হয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে, নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল রাজ্যেরই বাহিনী। এ বারের নির্বাচন তো জাতীয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে হচ্ছে, নিরাপত্তার দায়িত্বে তো বহুলাংশেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করার অবকাশ রয়েছে। তার পরেও আগ্নেয়াস্ত্রের মিছিল কেন দেখতে হবে? দুষ্কৃতী যদি দাপট দেখানোর চেষ্টা করে, তৎক্ষণাৎ তা রুখে দেওয়ার বন্দোবস্ত কেন থাকবে না?
এ রাজ্যে গত দু-দশ বছরে বা তার একটু বেশি সময়ের মধ্যে কখনও মোটের উপর অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়নি, এমন নয়। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচন বা ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটানো গিয়েছিল। তাতে নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপরে বাংলার জনসাধারণের আস্থা বেড়ে গিয়েছিল। সেই আস্থার প্রমাণ এবারের নির্বাচনী মরসুমে বারবার মিলছে বাংলার নানা প্রান্তে। কোথাও ভোটকর্মীরা আন্দোলনে নামছেন সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে ভোট পরিচালনা করার দাবিতে। কোথাও ভোটাররা ভোটগ্রহণের দিনে রাস্তাঘাট অচল করে দিচ্ছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে ভোটগ্রহণ করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপরে আস্থা কতখানি থাকলে এইরকম ছবি তৈরি হয়, তা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। সেই আস্থা বা ভরসা যদি বিনষ্ট হয়ে যায় এবারের নির্বাচনে। তাহলে গণতন্ত্রের খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে দেশের এই পূর্বপ্রান্তে।
উপসর্গ কিন্তু অবাধ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশের আভাস দিচ্ছে না। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় ভোটকেন্দ্রের প্রবেশ পথের ১০-১২ মিটার দূরত্বেই প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে কংগ্রেস কর্মীর উপরে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী কেন ঠেকাতে পারল না ওই হামলা? প্রশ্ন তুলেছে সব পক্ষই। রাজ্যে প্রশাসন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া সত্ত্বেও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে দুষ্কৃতীরা বাইক মিছিল করতে পারল কী ভাবে? উঠছে এই প্রশ্নও।
রাজ্যের পুলিশকে কাজে লাগিয়ে কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না কমিশন? যদি না পারে, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কেন রুটমার্চ করানো হচ্ছে না সংবেদনশীল এলাকাগুলোয়? পর্যাপ্ত বাহিনী কি এখনও এসে পৌঁছয়নি রাজ্যে? যদি না পৌঁছে থাকে, তাহলে আনানো হচ্ছে না কেন? সব কটা প্রশ্নের জবাব কিন্তু কমিশনকেই দিতে হবে। ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভাবে না হলে দায় কিন্তু কমিশনের উপরেই বর্তাবে। তাই যা করার করুন, যে পরিমাণ বাহিনী প্রয়োজন, সেই পরিমাণই আনান। কিন্তু যে কোনও মূল্যে বাংলার ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত করুন।