হ্যাভ ইউ নো সেন্স অব ডিসেন্সি, স্যর?— ১৯৫৪ সালের ৯ জুন মার্কিন সেনেটের প্রবীণ রিপাবলিকান সদস্য জোসেফ ম্যাকার্থির উদ্দেশে এই প্রশ্নটি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন আইনজীবী জোসেফ ওয়েলচ। ‘আমেরিকা-বিরোধী কার্যকলাপ’ প্রতিরোধের নামে বামপন্থী-দমনের যে অভিযান চালাইয়া ওই সেনেটর আপন নাম ইতিহাসের শিলালিপিতে খোদাই করিয়া রাখিয়াছেন, সেই ‘ম্যাকার্থিজ়ম’-এর তখন অন্তিম পর্ব। প্রদীপ নিবিবার আগে অধিক জ্বলে। ওই শেষ পর্বে ম্যাকার্থি মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যেও কমিউনিস্ট ভূত ধরিতে তৎপর। সেই সূত্রেই এক দিন সেনেটের শুনানিতে এক তরুণ আদালত-কর্মীর বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার করিয়া চলিয়াছেন তিনি, এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর আইনজীবী, স্বভাবত ধৈর্যশীল ওয়েলচ সহসা তীব্র ক্ষোভে ফাটিয়া পড়েন এবং মাইক্রোফোনটি কাছে টানিয়া ওই বাক্যটি উচ্চারণ করিয়াছিলেন: স্যর, আপনার কি কোনও ভদ্রতাবোধ নাই? কোনও কোনও উক্তি ঘটনার সীমা অতিক্রম করিয়া ঐতিহাসিকতা অর্জন করে, জোসেফ ওয়েলচের এই তীক্ষ্ণ প্রশ্নটিও তেমনই। সভ্য দুনিয়ার ভদ্রসমাজে বসিয়া কেহ অসংযত, অশোভন মন্তব্য বা আচরণ করিলে আজও কখনও কখনও তাঁহাকে শুনিতে হয়: হ্যাভ ইউ নো সেন্স অব ডিসেন্সি, স্যর?
ভারতীয় রাজনীতির ময়দানে, বিশেষত নির্বাচনী মরসুমে, কেহ এই প্রশ্ন করিলে তাহা বোধ করি নিতান্ত আদিখ্যেতা বলিয়া গণ্য হইবে। সৌজন্যের বালাই রাখিলে ভোটে লড়া যায় না— এমন এক দৃঢ় বিশ্বাসই যেন ভোটের বাজারে রাজনীতিকদের চালনা করিতেছে। কুকথা এই দেশের রাজনীতিতে নূতন নহে— তোজোর কুকুর, কানা বেগুন কিংবা গাই-বাছুরের কদর্য উপমায় ইতিহাস সমুজ্জ্বল। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির ধারা পঙ্কিল আবর্জনা হইতে মুক্তি পাইবে, ইহাই ছিল গণতান্ত্রিক ভারতের প্রত্যাশা। ঘটিয়াছে তাহার বিপরীত। গঙ্গার মতোই রাজনীতির দূষণ উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিতেছে। এবং সেই দূষণে অতুলনীয় ও অস্বাভাবিক ভূমিকা লইয়াছেন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার দল। অন্যরাও কেহই সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক নহেন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের নেতানেত্রীদের আচরণে বঙ্গজননী প্রায়শই অধোবদন হইতেছেন। এমনকি, হয়তো প্রতিযোগিতার তাড়নাতেই, সৌজন্য-সচেতন কংগ্রেস সভাপতিও মাঝেমধ্যে ‘মোদী মানেই চোর’ গোছের কুবাক্য বলিতেছেন। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের নানা মাপের নেতানেত্রীরা তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজের কথা এবং আচরণকে যেখানে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, নেহরু দূরস্থান, তাঁহার কোনও পূর্বসূরিই তাহা ভাবিতে পারিতেন না। রাজনীতির এই চলৎ-চিত্র দেখিলে হতবাক জোসেফ ওয়েলচ ‘ডিসেন্সি’র কথা ভাবিতেও পারিতেন না।
তে হি নো দিবসা গতাঃ। আজ আর এই অশোভন দৃশ্যাবলি কাহাকেও বিস্মিত করিবে না। স্বাভাবিক সৌজন্য বলিতে যাহা বুঝায়, যাহা বুঝাইত, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের দেশ ও দুনিয়ার এক বড় অংশ তাহা বেবাক হারাইয়াছে। দেশের প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। দুনিয়ার, বিশেষত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে দক্ষিণপন্থী অসহিষ্ণুতার ধ্বজাধারীদের দাপট উত্তরোত্তর বাড়িতেছে, তাহাদের আচরণে সৌজন্যের চিহ্নমাত্র নাই। ম্যাকার্থি ও ওয়েলচের দেশে রাজত্ব করিতেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, সৌজন্যের বিপরীত মেরুতে চিরকাল যাঁহার চির-অবস্থান। এই পৃথিবীতেও এলিজ়াবেথ আর্ডের্নরা আছেন, সভ্যতার বিরাট ভরসা হিসাবেই আছেন, কিন্তু তাঁহারা, মানচিত্রের নিউজ়িল্যান্ডের মতোই, সুদূরবর্তী। সত্য ইহাই যে, দেশে দেশে সমাজের এক বিরাট এবং প্রভাবশালী অংশ অসহিষ্ণু অসৌজন্যের প্রতিমূর্তিদেরই সহস্র বাহু বাড়াইয়া বরণ করিয়া লইতেছে। রাজনীতিকের অসৌজন্য নূতন কিছু নহে, কিন্তু সৌজন্যের অভাবকেই স্বাভাবিক বলিয়া গণ্য করিবার এই সর্বগ্রাসী ব্যাধিকে অভিনব বলিলে অত্যুক্তি হয় না। এই বিকৃতির কারণ অনেক। কিন্তু একটি বড় কারণ মানুষকে মানুষ হিসাবে সম্মান না করিয়া স্বার্থসিদ্ধির প্রকরণ হিসাবে দেখিবার মানসিকতা। এই মানসিকতার দাপট স্পষ্টতই বাড়িয়া চলিয়াছে, তাহাকে শক্তি জোগাইতেছে সর্বময় বাজারের বশীভূত অর্থনীতি, যাহার নিকট মানুষ কেবলমাত্র মুনাফা বাড়াইবার উপকরণ— শ্রমিক হিসাবে এবং উপভোক্তা হিসাবে। তাহার আর কোনও মূল্য নাই। এই সমাজে এবং রাজনীতিতে মানুষের মর্যাদা? সৌজন্য? আস্তে কন কত্তা, জোসেফ ম্যাকার্থি হাসিবেন।
যৎকিঞ্চৎ
কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ সমাজমাধ্যম জুড়ে শুরু হয়ে গেল মদন মিত্রকে নিয়ে হাসাহাসি। ভদ্রলোক বহু দিন হেডলাইনের বাইরে, হঠাৎ এত রসিকতা, মিম, তির্যক মন্তব্যের ঢল কেন? কেউ জানে না, কিন্তু সবাই উপভোগে দিব্যি ব্যস্ত, এই সময় হঠাৎ শোনা গেল, তাঁর দল তাঁকে রাজনীতির মূলস্রোতে ফিরে আসার সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে কি সোশ্যাল মিডিয়ার মজারু স্বভাবই তাঁকে আলোকবৃত্তে এনে দিল? না কি, আলোকবৃত্তে আনা হবে বলেই ওটা ছিল ‘গট আপ’ ঘুর-প্রচার?!