সংসদ ভবন চত্বর। ফাইল চিত্র
আলোচনায় উঠে আসছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের নানা স্তর। জনগণের মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তার কথা। শুনে তৃপ্ত হচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, যাক, এখনও অন্তত ভারতীয় রাজনীতি এই গর্বের জায়গাটা ধরে রাখতে পেরেছে। পুরুলিয়ার একটি কলেজে আয়োজিত আলোচনাচক্রে সমবেত হয়েছিলাম আমরা ক’জন। কর্মসূত্রে।
সেই ১৯৫১ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে মোটের উপরে নির্বাচনী ব্যবস্থার ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে ভারতের রেকর্ড অবশ্যই নজর কাড়ার মতো।
তবে গণতন্ত্রের অর্থ তো কেবল নির্বাচন সর্বস্বতা নয়! গভীর অর্থে গণতন্ত্র আত্মমন্থনের বিষয়। প্রতিদিনের জীবনচর্যায় সমানাধিকার, নীতিবোধ, পরমত সহিষ্ণুতার মতো রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা ও বোধও এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। অথচ, আজ চোখের সামনে বড় হয়ে ওঠে ‘ক্ষমতাগর্বী’ অতি রাজনীতির চেহারা।
অনেকেই জানেন, ‘সমাজ রাষ্ট্রকে গড়ে। রাষ্ট্র সমাজকে নয়’। কিন্তু এ কথাও সত্যি, অনেকেই এই বক্তব্যের গভীরতা পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারিনি। বুঝিনি রাজনীতি কালক্রমে জন্ম দেবে এক দাপুটে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাকে। যেখানে নীতি ও আদর্শ অপেক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের কৌশল এক রকমের কায়েমি স্বার্থে পরিণত হবে। আবার দুর্নীতির কারণ যে কেবল নিরপেক্ষ বিচার ও বোধের অভাব এমনটাও নয়। বস্তুত, এর পিছনে রয়েছে প্রবল ব্যক্তি-ভাবনা। যতক্ষণ না ব্যক্তিস্বার্থে ঘা পড়ে, ততক্ষণ সব কিছু মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার আপস চলতে থাকে। এই ব্যক্তি স্বার্থসর্বস্বতা পশ্চিমি সাবেকি উদারনীতিবাদের মধ্যে আমরা দেখেছি, যা কখনই সচেতন, সামাজিক প্রতিবাদের জন্ম দেয় না।
কিন্তু পাশ্চাত্য ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত থাকলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী রাজনীতির বিকল্প অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে আত্মশক্তি, গ্রামোন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজই দেশ গড়ার আধার ছিল। তথাপি, রাজনীতির ঝোড়ো অভিঘাতে এই ভিন্ন স্বর যেন প্রান্তিক থেকে গিয়েছে।
আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যায্যতা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক সংস্কারপন্থীদের প্রয়াস সফলও হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ভোট-যন্ত্রে ‘নোটা’ (নান অব দ্য অ্যাবাভ) এসেছে। বিশ্বায়ন পর্বে নয়া উদারনীতির ঝোঁক থেকে সরে এসে ভারতীয় রাষ্ট্র ২০০৪-০৫ সাল থেকে এক গুচ্ছ নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। যেমন, তথ্যের অধিকার আইন, শিক্ষার মৌলিক অধিকার আইন। এসেছে ‘এনআরইজিএ’-র মতো প্রকল্প বা অতি সম্প্রতি খাদ্যের অধিকারের জন্য আন্দোলন। কিন্তু অরণ্য তথা প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে স্থানীয় অধিবাসীদের দাবিই হোক বা ‘এনআরইজিএ’-র মতো বিষয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি, ভারতীয় গণতন্ত্রের বেশ কিছু প্রগতিশীল ভাবনা ও তার জন্য আরব্ধ কার্যক্রম কখনও রাজনীতিক, কখনও আমলার যোগসাজসের জন্য সফল হতে পারেনি।
জঁ দ্রেজ তাঁর একটি গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, ‘এনআরইজিএ’-র ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠন ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। রাজস্থানের মতো একটি ‘ওয়েল পারফর্মিং স্টেট’-এ এই পরিস্থিতির ফলে রাজ্যের ৩৬টি জেলায় পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে ‘স্পেশ্যাল অডিট’-এর নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকার। কর্নাটকের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা নিযুক্ত কমিশনার এই প্রকল্পে দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন। তবে এই দুর্নীতির কারণ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে খতিয়ে দেখার ও কৈফিয়ত তলব করার ব্যবস্থারও অভাব রয়ে গিয়েছে। আজও।
রাজনীতি ও প্রশাসনের সঙ্গে দুর্নীতির এই যোগ অনেক আগেই দেখা গিয়েছে ১৯৬২ সালের সান্থারাম কমিটির প্রতিবেদনে। সেখানে অভিযোগ উঠেছিল, নেহরু মন্ত্রিসভার কয়েকজন মন্ত্রী অন্যায্য ভাবে সম্পত্তি বৃদ্ধি করেছিলেন এবং নৈতিকতার তোয়াক্কা না করেই স্বজনপোষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এত বছর পরেও ব্যবস্থা যে এতটুকু বদলায়নি তা যেন পরিষ্কার হয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদ্বয় সিক্রি ও অশোকভূষণের বেঞ্চ, ২০১৭ সালে আধার বিষয়ক রায় দিতে গিয়ে ১৯৮৫ সালের রাজীব গাঁধীর বক্তব্যকে মান্যতা দিয়ে বলে, সরকার গরিবের জন্য এক টাকা বরাদ্দ করলে তার কাছে পৌঁছয় ১৫ পয়সা।
২০১৩-র একটি গবেষণাপত্রে এস শ্রীধরন ভারতে গণতন্ত্র ও দুর্নীতি সম্পর্কে আলোচনায় উল্লেখ করেন, ১৯৯১ সালে ভারতীয় অর্থনীতির আমূল সংস্কারের পিছনে যে যুক্তি কাজ করেছিল, তা হল সরকারি ব্যবস্থাপনায় লাল ফিতের ফাঁস ও দুর্নীতিকে হ্রাস করা। ভারতের ক্ষেত্রে দুর্নীতি লাগাম ছাড়া পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে দাবি করা হয়েছে ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজ়িনের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, দুর্নীতির নিরিখে এশিয়ার মধ্যে ভারত শীর্ষে। এর মধ্যেও আন্না হাজারের নেতৃত্বে ২০১১ সালের গণ আন্দোলন কিছুটা হলেও স্বার্থকতা পেয়েছে লোকপালের নিয়োগে।
এখন দেখার বিষয় এটাই যে রাজনীতির অলিন্দে দুর্নীতি নামক বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙার কাজটা কতটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে, প্রশাসন সে কাজ করে দেবে ভাবলে ভুল হবে। সন্দেহ-দ্বিধার কারণ, দুর্নীতির শক্তিকে ভাঙার জন্য যদি অধিকতর শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, তা হলে তাকে খর্ব করতে রাজনীতি আর এক শক্তিশালী হাত তৈরি করবে না তো!
লেখক সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান