ভালই তো, চিনে নেওয়া গেল
Lok Sabha Election 2019

এখনও যাঁরা বুঝছেন না, তাঁরা ভুল করছেন না, অপরাধ করছেন

আমরা পরিচিত নই এই গৈরিক মিছিলের সঙ্গে। এই উন্মাদ মুসলিমবিরোধী স্লোগানের সঙ্গে।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৯ ০০:০১
Share:

ঘরের কাজ করছিল মমতাজ, আমাদের সুভাষিণী ব্যক্তিত্বময়ী পরিচারিকা। টিভিতে তখন সন্ধের খবর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ স্ট্রিট হয়ে দেশপ্রেমিক বাহিনী তখন ঘোর সমারোহে চলেছে বিদ্যাসাগর কলেজের অভিমুখে। তার পরই সেই মূর্তি চুরমার। টিভির দিকে তাকিয়ে মমতাজ প্রায় গর্জে উঠল, ‘এত বড় সাহস? বিদ্যাসাগরের গায়ে হাত দেয়? এরা কি মানুষ?’ একটু অবাক হয়ে পড়াশোনার সুযোগ না-পাওয়া গরিব মুসলিম মেয়েটির দিকে তাকালাম আমি। ক্ষোভে ফুটন্ত মুখ তার, ‘জানে এরা বিদ্যাসাগর কে? কী করেছে সে আমাদের মতো মেয়েদের জন্য?’

Advertisement

‘ওরা’ জানে কি না, কী জানে, সে বড় জটিল প্রশ্ন। কিন্তু সে সব ছাড়িয়ে সেই মুহূর্তে আমি অভিভূত বিদ্যাসাগরের কথা ভেবে। কোনখানে, আমাদের সমাজের কত ফাঁকেফোকরে গভীরে বসবাস করেন তিনি! ‘মেয়েদের জন্য’ ‘আমাদের জন্য’ যা-ই করে থাকুন বিদ্যাসাগর মশাই, তার তো খুব অল্প আঁচই মমতাজদের মহলে পৌঁছনোর কথা! না কি, আমিই ভুল জানতাম এত দিন? বোধ হয় তা-ই, ভুল জানতাম। কেননা, ঠিক তখনই উপরের তলায় চলছে আমাদের গাড়ির চালক রফিকুল ইসলামের সরব আক্ষেপ! ‘এ কী? এ ভাবে ভেঙে দিল বিদ্যাসাগরের মূর্তি? এরা সব কারা? কলেজে ভাঙচুর করে কী লাভ হল এদের? এই যে চেয়ার টেবিল জানলা দরজা ভাঙছে, কত ছাত্রছাত্রীর কত অসুবিধে হবে— এ কী রাজনীতি শুরু হয়েছে!’ তার পরই একটা নিশ্চিতির বিলাপ: ‘অবাঙালি গুন্ডা ছাড়া এমন কাজ কেউ করতে পারে না!’

হঠাৎ কতকগুলো ঠুনকো পরিচয় ভেঙে টুকরো হয়ে বেরিয়ে এল শক্তপোক্ত একটা আইডেন্টিটি— যার নাম, বাঙালিত্ব। হায়, ইসলাম খবর রাখে না বাঙালি গুন্ডারা ঠিক কী কী কাজ করে ইতিহাসে নাম তুলেছেন দূর ও নিকট অতীতে। কিন্তু মঙ্গলবারের অশান্তির বিস্ফোরণ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে যে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে হিন্দু-মুসলিম সীমারেখা অতিক্রম করে বাঙালি আবেগে বড় মাপের একটা ঢেউ উঠল, চোখের সামনেই তা দেখলাম। এইটা দরকার ছিল। পরিষ্কার হওয়া দরকার ছিল, এখনকার বিজেপি রাজনীতির প্রকরণটি কেন বড্ড অ-বাঙালি। বাঙালি জীবনযাপনের সঙ্গে কেন তা ঠিক খাপ খায় না।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সে দিক থেকে বিদ্যাসাগরকে ঠেঙিয়ে ভেঙে ভালই হল। এর আগে পশ্চিমবঙ্গে মাছ-মাংসের বিরোধিতা করতে গিয়ে ঠেকেছে বিজেপি, ভুলে যাইনি আমরা। হনুমান পুজো কিংবা রামনবমী অনেক দূর এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতেও বাঙালি যে দু’হাত বাড়িয়ে তাদের গ্রহণ করেছে, এমনটা বলা যাবে না। অন্য দিক দিয়ে ভাবতে গেলে, এর আগে বিজেপির হাতে ভেঙেছেন লেনিন কিংবা অম্বেডকর। বাঙালি বাম ও দলিতরা দুঃখ পেয়েছেন, বাকিরা পাননি, এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বার করেছেন। হয়তো সেই সমস্ত ‘বাকি’দের অনেককে ছুঁতে পারলেন বিদ্যাসাগর, কে জানে। এত দিন ধরে স্বামীজি থেকে নেতাজি— সকলকে নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের ঠুনকো ভেজাল নকল ও অন্যায় প্রচারে বিবেকানন্দ কিংবা সুভাষচন্দ্রের ঘোর অসম্মান ঘটেছে, কেননা আজীবন এবং আপ্রাণ তাঁরা সঙ্ঘীয় হিন্দুত্ববাদের একেবারে উল্টো কথাই বিশ্বাস করেছেন, প্রচার করেছেন। কিন্তু বাঙালি ‘আইকন’দের পক্ষে বাঙালিকে যথেষ্ট গর্জে উঠতে দেখা যায়নি তাও। মঙ্গলবার বিদ্যাসাগরের অসম্মানে সেই গর্জন শেষ পর্যন্ত শোনা গেল।

গর্জন শেষ পর্যন্ত বর্জনে পৌঁছবে কি না, বলা মুশকিল। বিশেষত যখন পরের দিন ফেসবুক খুলতেই দেখা গেল, বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র বা ছাত্রী নামধারী ব্যক্তিবর্গের পোস্ট করা নকল জবানবন্দি— না, বিজেপি মিছিল তো নেহাতই শান্তিপূর্ণ ছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরাই যা ভাঙচুর করার করেছে। এই সব পোস্ট যে ‘ফেক’ সেটা বুঝতে সময় লাগে এক সেকেন্ড, কেননা প্রতিটি জবানবন্দিরই এক ভাষা, এক বাক্যবন্ধ, এমনকি এক বানান ভুল! ‘দরজা পেরোতে’ কথাটা ভুলক্রমে ‘দরজা পেটোতে’ হয়ে গিয়েছে— সেও প্রতিটি পোস্টেই! আর যে-ই না এ নিয়ে লেখালিখি শুরু হল, অমনি পোস্টগুলোও ভৌতিক ভাবে শুধরাতে শুরু করল। চোট্টামো করতেও আর একটু বুদ্ধি লাগে। তবে যাঁদের বিশ্বাস-আকুল প্রাণ, কিংবা মমতা-বিরোধিতায় যাঁরা নির্মম, তাঁরা নিশ্চয় পোস্টগুলো অন্য ভাবে পড়ছেন, পড়বেন।

সুতরাং, এইখানে আর একটা কথা বলা খুবই জরুরি হয়ে পড়ছে। বার বার একটা কৈফিয়তের সুরে শুনছি যে, তৃণমূলের উস্কানি ছিল। ছিল, নিশ্চয় ছিল। থাকবে না-ই বা কেন। বিজেপি যেখানে হাজারে হাজারে লোক বাইরের রাজ্য থেকে এনে বজরংবলী মিছিলে কলকাতার রাজপথ কাঁপাচ্ছে, সেখানে অন্য দল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে উস্কানি দেবে, এটাই তো প্রত্যাশিত। চিরকাল এমনই হয়ে এসেছে। পরিষ্কার বলি, তৃণমূল নেতাকর্মীদের গুন্ডামি ও অসভ্যতার সঙ্গে আমরা প্রত্যহ প্রবল ভাবে পরিচিত। তার আগে পরিচিত, সিপিএম স্পর্ধা, দুর্নীতি ও গুন্ডামির সঙ্গে।

কিন্তু আমরা পরিচিত নই এই গৈরিক মিছিলের সঙ্গে। এই উন্মাদ মুসলিমবিরোধী স্লোগানের সঙ্গে। এই পরিকল্পিত ভাবে মুসলিম বসতির পাশ দিয়ে যেতে যেতে অশ্রাব্য সাম্প্রদায়িক গালাগালি বর্ষণের সঙ্গে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙাটা কেবল উপলক্ষ মাত্র, লক্ষ্যটা যে কী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না— এবং কোন দল কত পাথর ছুড়েছে তার হিসেবেরও দরকার থাকে না। সে দিন ওই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন, এমন প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গেরুয়া পট্টিবাঁধা ছেলেদের উপর নির্দেশ ছিল দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করতে, তাই জন্যই তারা কলাবাগান অঞ্চলের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল, অকথ্য স্লোগান দিতে দিতে। সে দিন যে বড় মাপের কোনও সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেনি, তার কৃতিত্ব বিজেপি মিছিলের নয়, তৃণমূলী জনতার নয়, পুলিশ-প্রশাসনের নয়— ওই অঞ্চলের মুসলিম মানুষদের, যাঁরা শত প্ররোচনাতেও সে দিন প্ররোচিত হননি। বিজেপির সঙ্গে হাড়ে হাড়ে পরিচিত প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, মঙ্গলবার কলকাতা ছাড়া অন্য যে কোনও জায়গায় ‘অন্য কিছু’ ঘটে যেত, কেননা মিছিলের তা ‘ঘটানো’র প্রবণতা ছিল! কলকাতার এই আত্মনিয়ন্ত্রণের নমুনা আমরা আগেও দেখেছি, বিরানব্বইতে বা তসলিমা নাসরিনের সময়।

না, আত্মনিয়ন্ত্রণকে বেশি গৌরবময় করার দরকার নেই মোটেই। আমরা জানি, অধিকাংশ সময়ই শুভবোধের থেকেও এই আত্মনিয়ন্ত্রণের পিছনে থাকে— ভয়। সাধারণ বুদ্ধি বলে, সে দিন কলাবাগানের মানুষ চুপ থাকতে বাধ্য হচ্ছিলেন— শুভবোধে নয়, ভয়ে। এই সুবিশাল গেরুয়াবাহিনী কী কাণ্ড করতে পারে, সেই ভেবে। অর্থাৎ আমাদের চেনাপরিচিত রাজনৈতিক গুন্ডামির থেকে এ অনেক, অনেক আলাদা জাতের হিংস্রতা। তাই, বলতেই হবে, তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডামি আর বিজেপির বর্বরতা এখনও চরিত্রগত ভাবে আলাদা— কোনও অনিয়ন্ত্রিত জনতার ভাঙচুর-হট্টগোলের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত জনতার পরিকল্পিত হিংসা, এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেই হিংসাকে লেলিয়ে দেওয়ার পদ্ধতির একটা বিরাট ফারাক আছে। ভোটের সময় তা মাথায় রাখা জরুরি। আমাদের দুর্ভাগ্য, গুন্ডাদের মধ্যেও এই শ্রেণিভেদটা করতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য বলে কাজটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না— এড়িয়ে গেলে সেটা অত্যন্ত বড় রকমের অন্যায় হবে।

স্পষ্ট কথাটা স্পষ্ট করেই বলা দরকার: এই ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ভোট নয়। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, গেরুয়াবাহিনীর নামে ভোট। মমতা খারাপ না ভাল, সে প্রশ্ন পরে ভেবে দেখার সুযোগ হবে, পরের পরের বছর। যাঁদের বলতে শুনছি— ‘মমতা প্রধানমন্ত্রী হবেন এই ভয়েই নাকি বিজেপিকে ভোট দেব’, তাঁদের বলি, সাম্প্রদায়িক হিংসা আর ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা, অন্যায়, দুর্নীতি, প্রবঞ্চনাকে আপনারা আর এক বার মাথায় তুলে নেওয়ার অজুহাত বানাতে চান, বানান— শুধু দয়া করে সেটাকে ‘যুক্তি’ হিসেবে দাবি করবেন না। গত পাঁচ বছর একটা কথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, মমতা রাহুল মায়াবতী বা অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হলেও হিংস্রতা অন্যায় কুশাসনের দিক দিয়ে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর বহু নীচেই তাঁদের স্থান হবে। স্বাধীন ভারতের গণতন্ত্রবিরোধী অন্যায়কারী প্রধানমন্ত্রী মোদীর নাম ইতিহাসে খোদিত থাকবে।

এখনও যাঁরা এ কথা বুঝছেন না তাঁরা কেবল ভুল করছেন না— অপরাধ করছেন। নররক্তলোলুপ বাঘের সামনে প্রতিবেশী মানুষটিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে বেঁচেবর্তে থাকার অপরাধ। মমতাজ আর রফিকুলদের ভয়ে কাঁপিয়ে দিয়ে নিজেরা সুবিধেবাদী জীবনযাপনের কোটরে ঢুকে থাকার অপরাধ। এমন অপরাধ উনিশে মে নিশ্চয় অনেকেই করবেন। বঙ্গসমাজের চাপে আজীবন ভাঙতে ভাঙতে বিদ্যাসাগর তো বলেই গিয়েছেন, ‘যাহাদের অভিপ্রায় সৎ ও প্রশংসনীয় এরূপ লোক অতি বিরল এবং শুভ ও শ্রেয়স্কর বিষয়ে বাধা ও ব্যাঘাত জন্মাইবার লোক সহস্র সহস্র’...। কেবল অপরাধ করার সময় ‘অপরাধ’ জেনে কাজটা করবেন, এইটুকুই নিবেদন রইল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement