ছবি: সংগৃহীত
লকডাউন-এর সময়সীমা বাড়তেই সবার প্রশ্ন— কবে লকডাউন উঠবে আর আমরা বাড়ি থেকে বেরোব? বলা হচ্ছে, পরিস্থিতির বিচার না করে লকডাউন তোলা বা বাইরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। গৃহবন্দি অবস্থায় এই ‘পরিস্থিতি’ বলতে কী বোঝাচ্ছে? তা কী ভাবে নির্ণয় করবে আমরা কত দিন বাড়িতে বন্দি থাকব? এ সব প্রশ্নও মুখে মুখে।
সার্স কোভ-২ বা করোনাভাইরাস যত মানুষকে অসুস্থ করে, তার থেকেও বেশি লোককে ‘অসুস্থ’ করে না! উদ্ভট এই বৈশিষ্ট্যই ভাইরাসটি থেকে আমাদের নিস্তার পেতে দিচ্ছে না। ভাইরাস আমাদের দেহে ঢোকে বাসা বাঁধতে। তাদের লক্ষ্য আমাদের দেহের জীবন সঞ্চালক প্রক্রিয়ার সাহায্যে বেঁচে থাকা এবং নিজেদের বিস্তার ও ক্রমবিকাশ। আমাদের মৃত্যু ঘটলে তাদের লাভ নয়, ক্ষতি। সত্যি বলতে, করোনা সংক্রমণে এত মৃত্যুর জন্য ভাইরাসটি সরাসরি দায়ী নয়। দায়ী আসলে ভাইরাসটির প্রতি আমাদের দেহের এক প্রকার আত্মঘাতী প্রতিক্রিয়া। যখন এমন ভাইরাস দেহে প্রবেশ করে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায়, আমাদের দেহের প্রতিরোধ যন্ত্রগুলি ভাইরাস দমন করতে ‘সাইটোকায়িন’ নামক জৈবরাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে। সাইটোকায়িনের অত্যুৎসাহী হামলায় সার্স কোভ-২’র মতো ভাইরাস ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে ভাইরাসবাহক ফুসফুসের কোষও ধ্বংস হতে থাকে। একে ভাইরাস দমনের প্রচেষ্টায় এক প্রকার অকাম্য সমান্তরাল ক্ষতি বা ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ বলা যায়। ফলে, ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেও নিউমোনিয়াই মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভাইরাসটির বিরুদ্ধে অনেক রকম ওষুধের প্রভাবের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা নতুন ভাইরাসটিকে ঠিক মতো চিনে উঠতেই পারিনি, কার্যকরী ওষুধ বা প্রতিরোধক তৈরি তো দূরের কথা। তাই অসহায় হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানা পদ্ধতিতে এই ভাইরাসের সংক্রমণকে দমনের প্রচেষ্টা চলছে। সেগুলি কতটা কার্যকরী, এখনও ঠিক জানা নেই।
অনেক সময়ই ভাইরাসটি আমাদের ফুসফুসে বা দেহে বাসা করলেও কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে না। দিব্যি সুস্থ অবস্থাতেই ভাইরাসটিকে ফুসফুসে পোষণ করছি। বস্তুত ভাইরাসটির এই আচরণ মৃত্যুর থেকেও মারাত্মক হতে পারে। কেন, বুঝে নেওয়া যাক।
যাতে আমরা সমাজে ভাইরাসটি ছড়াতে না পারি এবং অসুস্থ হয়ে আমাদের সীমিত স্বাস্থ্য-ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি না করি, সেটিই গৃহবন্দি হওয়ার মূল কারণ। বাড়িতে আটক থেকেই নিস্তার পাব— এমন ভাবনাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করা যাবে না। এটিই আপাতত ভাইরাসটির সংক্রমণ রুখতে বিচক্ষণতম পদক্ষেপ। কিন্তু গৃহবন্দি অবস্থায় এক জন থেকে অন্য জনে যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়, তার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সামাজিক দূরত্ব রাখা দরকার। অথচ, এই জনবহুল দেশটিতে বেশির ভাগ মানুষ এক ছাদের তলায় ঠাসাঠাসি করে থাকেন। এখানে এই দূরত্ব বজায় রাখা মুশকিল। আসলে আমরা লকডাউনের মধ্যে ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’-এর নামে সমাজটাকে অনেকগুলি ভাগে বিভক্ত করেছি। এই এক-একটি ভাগ একটি বাড়ি বা পরিবার কিংবা একটি জনাকীর্ণ আস্তানার রূপ নিয়েছে। আমেরিকার ‘সেন্টার্স ফর ডিজিজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ সংস্থা-র দাবি, ভাইরাসটি এক লাফে ১৩ ফুট অবধি হাওয়ায় ভ্রমণ করতে পারে। এই তথ্যের ভিত্তিতে, বাড়ির ভিতরে করোনাভাইরাসের উপসর্গহীন বাহক থাকলে, তিনি বাসস্থানের সবাইকে অজান্তে সংক্রমিত করে ফেলতেই পারেন। তবে, গৃহবন্দি অবস্থায়ও সারা ক্ষণ মাস্ক পরে ভাইরাসটির সংক্রমণ কমানোর দৃষ্টান্ত মিলেছে। মাস্কের কার্যকারিতা সংশয়াতীত।
ঘরবন্দিদের কারও কোভিড-১৯-এর লক্ষণ দেখা দিলে, ওই সংক্রমিত পরিবার বা আস্তানা চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গে সমাজ থেকে কোয়ারেন্টিন বা আলাদা করা হয়। এলাকাটিকে ‘হটস্পট’ ঘোষণা করা হয় যাতে কেউ সেখান থেকে বেরোতে বা ঢুকতে না পারেন। পদ্ধতিটি এ দেশেও চালু হয়েছে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব রাখলেও উপসর্গহীন আক্রান্তের থেকে অজান্তে সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েই যাচ্ছে। এঁদেরই ভাইরাসটি ব্যাপক হারে সমাজে ছড়াবার বা ‘কমিউনিটি স্প্রেডিং’-এর প্রধান বাহক বলে গণ্য করা হয়। পরীক্ষার দ্বারা এঁদের শনাক্ত করা খুবই জরুরি। লকডাউন তুলে দিলে ও এঁরা নির্বিচারে সমাজে মিশতে শুরু করলে বিপদের শেষ নেই।
বৈজ্ঞানিক বিবেচনায়, একটি সম্ভাবনা দৃঢ়। যদি কেউ এই সংক্রমণ ২১ দিনের বেশি নিজের দেহে পোষেন, তবে তাঁর প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে তাকে নির্মূল করতে পারেন। তাই এঁরা এক মাসের উপর লকডাউনে বাড়িতে থেকে তার পর বাইরে বেরোলে, পরে এঁদের দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে। কিন্তু এঁরা যদি এর মধ্যে নতুন ব্যক্তিকে সংক্রমিত করেন, তা হলে ঝুঁকি থাকবে। ভাইরাস আক্রান্ত কি না, দেশের ১৩৫ কোটি মানুষকে হয়তো সেই পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু, ঘরবন্দি কারও যাতে সুপ্ত সংক্রমণ না থাকে, সেটি লকডাউন তোলার আগে নিশ্চিত করা দরকার।
যাঁরা রোগাক্রান্ত দেশগুলি থেকে ফিরেছেন, প্রথমেই তাঁদের পরীক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু তখন কেউ অনুমান করতে পারেননি যে, রোগটি অভূতপূর্ব অতিমারির আকার নেবে। পরীক্ষা করার কিট অপর্যাপ্ত ছিল, তাই পরেও হয়তো সেটা সম্ভব হয়নি। বুঝতে হবে, পৃথিবীর সর্বত্র ভাইরাসটি পর্যটক বা বিদেশ-ফেরত নাগরিকদের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট দেশে এসেছে। তাই প্রথমেই এঁদের পরীক্ষা করলে ভাইরাসটি ছড়ানোর সম্ভাবনা কমত। ভাইরাসটির সমাজে ছড়ানোর সম্ভাব্য পথগুলিও অবরোধ করা যেত। তা এখনও করা যায়। কারণ, আমাদের দেশে সংক্রমণের হার হয়তো এখনও হাতের বাইরে যায়নি। সংক্রমিত ব্যক্তি কার থেকে ভাইরাস পেতে পারেন বা কাকে দিতে পারেন, সংক্রমণ রোধে তার নির্ধারণও জরুরি। একে এ রকম রোগের পর্যবেক্ষণে ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’ বলে। দেহের তাপ মেপে বা ‘থার্মাল স্ক্রিনিং’ দ্বারা বিশেষত এয়ারপোর্ট দিয়ে বিদেশ-ফেরতদের ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। সংশয়পূর্ণ পদ্ধতি। কারণ, একটি জ্বর কমানোর ট্যাবলেটেই পরীক্ষাটি এড়ানো যায়। তায়, বেশির ভাগ সংক্রমিতের রোগের উপসর্গ থাকে না। তাই এই পরীক্ষায় সময় এবং অর্থের অপচয় হয়েছে।
স্বাস্থ্যকর্মীরা আমাদের বাঁচাতে জীবন বাজি রেখেছেন। তাঁদের ঠিকঠাক নিজস্ব সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) দিতে হবে। তা ছাড়া তাঁদেরও নিয়মিত পরীক্ষা প্রয়োজন। কারণ, তাঁরাই ভাইরাস-সমরের প্রধান যোদ্ধা। তাঁরা সংক্রমিত হলে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
আমেরিকা বা ইউরোপীয় দেশগুলিতে যে হারে ভাইরাসটির প্রকোপ বাড়ছে, তা আসলে ভাইরাসটির প্রকৃত সংক্রমণের হার নয়। বরং যে ব্যাপক হারে সে দেশের লোকেদের মধ্যে ভাইরাসটির পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার প্রতিচ্ছবি। ভারতের মতো জনবহুল দেশেও সেই হারেই পরীক্ষা প্রয়োজন। নইলে, ঘরবন্দিদের মধ্যে কারা ভাইরাসের উপসর্গহীন বাহক, জানা যাবে না। তখন এ দেশ সংক্রমণের ভুল মূল্যায়নের মারাত্মক ফল ভুগবে। সেই ভুলের ভিত্তিতে লকডাউন তোলার সিদ্ধান্ত নিলে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। তার থেকে রেহাই পাওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ না-ও মিলতে পারে। আমাদের ভাইরাসটির পরীক্ষার সামর্থ্য বাড়াতেই হবে। লকডাউন তুলে বেরোবার আগে এই সংক্রমিতদের কোয়ারান্টিন করতে হবে। সফল হলে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার সাধারণ জীবন যাপনে বাধা থাকবে না। দাবি করা হচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দেশে কোভিড-১৯ সঙ্কট অনেকটাই সামাল দিয়েছে। এখনই পর্যাপ্ত পরীক্ষার উপর জোর দিতে পারলে তবেই লকডাউন তুলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যাবে। এই মুহূর্তে যুদ্ধের ভিত্তিতে ঝুঁকিগ্রস্ত জনগণের মধ্যে ভাইরাসটির পরীক্ষা চালিয়ে দেশে ‘পরিস্থিতি’-র ঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। আর কষ্ট করে যথাসম্ভব গৃহবন্দি থাকতে হবে। শুধু এই দুটি কাজ ঠিকমতো করলেই, শত্রুটিকে হারানো কঠিন হবে না।
বায়োটেকনলজি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়