অশোক মিত্র মহাশয়ের ‘দুর্বল থেকে দুর্বলতর’ (৮-৩) লেখাটা পড়লাম। তিনি ভারতে বামপন্থীদের বর্তমান দশা সম্পর্কে লিখেছেন। হারানো জমি ফিরে পেতে হলে বামপন্থীদের কী করতে হবে, সে কথাও লিখেছেন। কিন্তু, ‘কেন’ এই ব্যাপার হল, সে-ব্যাপারে সামান্যই বলেছেন। প্রচ্ছন্ন অভিযোগ করেছেন, কয়েক প্রজন্ম আগের যুবসম্প্রদায় যে-রকম বাম রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করত, এখনকার আত্মকেন্দ্রিক যুবসমাজ সে-রকম করে না। প্রশ্ন হল, যুবসম্প্রদায় বাম রাজনীতির পিছনে সময় ও শক্তি অপচয় করবে কেন? বাম রাজনীতি তাদের কী দিয়েছে? বরং যখন কিছু করার সুযোগ ছিল, তখন বিকশিত হওয়ার রসদগুলি সুপরিকল্পিত ভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
স্কুলশিক্ষা দিয়েই শুরু করা যাক: বামপন্থা, বিশেষত মার্কসবাদ ভাল ভাবে বুঝতে গেলে ইংরেজিটা জানা প্রয়োজন। কারণ মার্কসবাদী চর্চার সিংহভাগ হয় ইংরেজিতে। অশোকবাবুর কথা মতো, এক কালে সম্পন্ন বাড়ির শিক্ষিত ছেলেরা বামপন্থী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঘটনা হল, তাঁদের পাশাপাশি, সম্পন্ন নয়, এমন বহু শিক্ষিত ছেলেও নিজেদের পরিবার, ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার আগে তাঁরা স্কুলে লেখাপড়াটা ভাল ভাবে শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবং সেগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি স্কুল ছিল, যেখানে ইংরাজি ভাল করে শেখানো হত। ইংরাজি তুলে দেওয়ার ফলে সেই সাপ্লাই লাইন কাটা পড়ল। সুদীর্ঘ বাম শাসনে আমরা তাই তিন ধরনের কমরেড দেখতে পাই— ১) নিশ্চিত ভাবেই সুযোগসন্ধানী এবং ধান্দাবাজ। তারা সব সময় ক্ষমতায় অনুকূলে যায়। সিপিএম কোনও দিন ফিরে এলে তারা আবার সে-দিকে যাবে এবং সিপিএমও নিয়ে নেবে। ২) সম্পন্ন ঘরের, ইংরাজি-শিক্ষিত বামপন্থী। তত্ত্ব খুব ভাল বোঝেন, দেশ-বিদেশের সুন্দর সুন্দর জায়গায়, অর্থাৎ কমফর্ট জোন-এ বাস করেন, কিন্তু মাটির সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। এসি না চললে চোখে অন্ধকার দেখেন, ভিখারি এসে ভিক্ষা চাইলে প্রচণ্ড বিরক্ত হন। ৩) নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সে-সব কর্মী, যাঁরা পার্টিকে প্রচণ্ড ভালবাসেন, নিয়মিত এসে পার্টি অফিস খুলে ঝাঁট দেন। সমস্যা হল, পার্টির কাগজ যা বোঝায়, বা কোনও বাক পটু নেতা যা বলেন, সেগুলোই বিশ্বাস করেন। কোনও স্বাধীন চিন্তাভাবনা নেই। সে-কারণে এঁদের গোঁড়ামি বেশ হাস্যকর ও বিরক্তিকর জায়গায় পৌঁছে যায়, যা পার্টির আরও ক্ষতি করে।
ইংরাজি তুলে দেওয়ার সঙ্গেই, সরকারি স্কুলগুলিতে কাজের পরিবেশ পরিকল্পিত ভাবে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, জেলা, মফস্সল এবং গ্রামাঞ্চলে বহু নামী-অনামী স্কুল ছিল যেখানে ভাল লেখাপড়া হত, সেখানে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি ঢুকিয়ে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করা হয়েছে, লেখাপড়ার সময়টা মিছিলে হাঁটার জন্য। ঘটনা হল, সরকারি স্কুল থেকে পাশ করা বহু ছাত্রছাত্রী আজকে ইংরাজি তো দূরের কথা, বাংলাটাই ঠিকমত লিখতে পারেন না।
এ ছাড়া, পাড়ায় পাড়ায় প্রমোটাররাজ কায়েমের মাধ্যমে যুবসমাজের হাত থেকে খেলার মাঠ কেড়ে নেওয়া হল।
কেন এমন হল? অনেক কারণের মধ্যে আসলটি হল, বাম শাসকবর্গ চেয়েছিলেন, সাধারণ মানুষ যেন ‘কোয়ালিটি’ শিক্ষা পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারেন। তা হলেই তাঁরা পার্টির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন এবং পার্টির দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করবেন। কিন্তু যদি স্কুলে কেউ ঠিকমত লেখাপড়া এবং নিয়মশৃঙ্খলা না শেখে, সে পার্টি অফিসেও শিখবে না। আর অক্সফোর্ড-শিক্ষিত কোনও কমরেড নিশ্চয়ই তেহট্টতে গিয়ে মার্কসবাদের ক্লাস নেবেন না। সুতরাং পার্টি ক্লাস নেওয়ার জন্য যে শিক্ষককে পাওয়া যাবে, তিনিও তো একই রকম স্কুল-ব্যবস্থার শিকার। আজকে সে-জন্যই বামপন্থা কোনও শ্রদ্ধা বা আস্থার উদ্রেক করে না।
অশোকবাবু চিন্তিত, এই প্রবল অন্যায়-অবিচারের পরিবেশে বামপন্থা না থাকলে কী হবে? দরিদ্র-দুর্বল মানুষ কোথায় যাবে? সবিনয়ে বলি, এতটা দুর্ভাবনার কোনও কারণ নেই। বামপন্থা আসার অনেক আগে থেকেই মানুষ অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেছে, সমাজ পরিবর্তন করেছে। আবার বামপন্থী অন্যায় বা অবিচারেরও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করেছে। যুবসমাজের একাংশ চিরকালই প্রতিবাদী ছিল, বর্তমানেও বহু যুবক আছেন, তাঁরা সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চান, কিন্তু সে-জন্য তাঁরা বাক সর্বস্ব বামপন্থীদের নির্দেশিত পথ মানবেন কি না, সময়ই সেই উত্তর দেবে।
সুজয় ঘোষ খড়্গপুর-৬
বাস্তববোধ
অশোক মিত্র লিখেছেন, ‘নির্বাচনে জয়পরাজয় অপ্রাসঙ্গিক,...’ সংসদীয় ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী যে-কোনও দলের সাফল্যের একটি প্রধান মাপকাঠি অবশ্যই নির্বাচনী সাফল্য। এ-দেশে বামপন্থীরা তথাকথিত বিকল্প নীতির প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছেন নির্বাচনী সাফল্যতে ভর করেই। অর্ধশতাব্দী আগে এক দল বামপন্থী সংসদীয় মোহ ত্যাগ করে কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্ন দেখেছিলেন, ফল হয়েছিল নির্মম। এ-রাজ্যেও বামেরা ভূমি সংস্কার বা ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের কৃতিত্ব দাবি করে, তা সম্ভবই হত না, যদি না তারা ক্ষমতায় আসীন হত।
দ্বিতীয়ত, ভারতের এক-একটি অঞ্চলে আঞ্চলিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। মূল নীতিকে আঁকড়ে (যদি ধরা যায়, ২০১৯-এ দিল্লির বর্তমান শাসকের পরাজয়ই মূল লক্ষ্য) অঞ্চলভেদে নতুন জোটসঙ্গীই তো স্বাভাবিক। প্রতিপক্ষ যখন জোট রাজনীতির সুবিধা নিয়ে এগিয়ে যায়, তখন বামপন্থীদের অনড় অবস্থান আত্মহত্যার শামিল। আশা করব তারা ১৯৯৬ ও ২০০৮ থেকে শিক্ষা লাভ করবে, নচেৎ বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে গিয়ে দলটাই না উঠে যায়!
দেবত্র দে ই-মেল মারফত
বাংলা মিডিয়াম
‘কেন বাংলা ইস্কুলের চাহিদা নেই’ (৯-৩)— এর কারণ এতটাই প্রাঞ্জল যে, গবেষণার প্রয়োজন দেখি না! অনেক অপকর্মের মতো এটির জন্যও দায়ী বামফ্রন্ট সরকার। জ্যোতি বসু রীতিমত ইংরেজি বলতে পারতেন। কিন্তু বাংলা বক্তৃতায় কোনও দিন তাঁকে একটা আস্ত বাক্য সম্পূর্ণ করতে শুনিনি! এহেন মুখ্যমন্ত্রী, যিনি অবকাশ যাপনে লন্ডন যেতে পছন্দ করতেন, নিদান দিলেন, প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি তুলে দাও! প্রথম কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় এসেই একটি কমিশন গঠন করলেন এ-রাজ্যে ইংরেজি শিক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে। শীর্ষে ছিলেন এক বিখ্যাত অধ্যাপক, যাঁর ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি ঈর্ষণীয়। তিনি সুপারিশ করলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের একটা বিদেশি ভাষা শেখানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সরকার এটিকেই নীতি হিসাবে গ্রহণ করল। প্রাথমিকে ইংরাজি পড়ানো উঠে গেল, আর বামফ্রন্ট নেতাদের নাতি-নাতনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যেতে লাগল।
প্রাথমিকে ইংরেজি বন্ধ হল বলে ইংরেজি শেখার পথ একেবারে অবরুদ্ধ হল, বলছি না। কিন্তু এতে বাংলা আর ইংরেজি মাধ্যম দুটি ব্যবস্থায় শিক্ষাক্ষেত্র আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেল। বাংলা মিডিয়াম এখন ইতর-অধম শ্রেণির শিক্ষাক্ষেত্রে আপদ-গতির বিশেষণ! বাংলা মাধ্যমের মাস্টার শিক্ষক সমাজের ‘অপর’। ‘বেঙ্গলি মিডিয়াম স্টুডেন্ট’ একটা পড়ন্ত সোশ্যাল স্টেটাস বোঝাতে জুতসই গালাগাল।
অরবিন্দ সামন্ত সোনপত, হরিয়ানা
ভ্রম সংশোধন
‘রুদ্ধশ্বাস জয়ে দৌড়ে...’ শীর্ষক খবরে (১১-৩, পৃ ১৬) মুশফিকুর রহিমকে বাংলাদেশের অধিনায়ক লেখা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের প্রাক্তন অধিনায়ক। বর্তমান অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়