আমার মেয়ে এক জন এমবিবিএস ইন্টার্ন। আর জি করের ঘটনার পরে আমাদের বিনিদ্র রজনী কাটাতে হচ্ছে। বিশেষ করে যে দিনগুলো মেয়েকে হাসপাতালে রাতের ডিউটিতে যেতে হয়। আমাদের রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলি এমবিবিএস ইন্টার্ন আর পিজি পড়ুয়া ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল। এদের ডিউটির কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনও কখনও এক টানা ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। আমার মেয়েকে এক বার ৫৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়েছিল। সবচেয়ে অসুবিধা হয় মহিলা চিকিৎসকদের, বিশেষ করে রাতে। ডিউটির স্থানে নেই মেয়েদের শৌচালয়, রাতে বিশ্রাম নেওয়ার মতো আলাদা ঘর। উপযুক্ত সিকিয়োরিটির ব্যবস্থা নেই। আমাদের রাজ্য সরকার সভাসমিতিতে বলে বেড়ায়, রাজ্যে অনেক মেডিক্যাল কলেজ, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল গত ১০ বছরে খোলা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ খুললেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। চাই উপযুক্ত পরিকাঠামো। এ রাজ্যে কোনও মেডিক্যাল কলেজেরই উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই, জোড়াতালি দিয়ে চলছে। নেই কোনও নিরাপত্তা। সর্বত্র চলছে দালালদের দৌরাত্ম্য।
রাজ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই প্রথমে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় নির্যাতিতাকে। এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি। বলা হল, সেমিনার হলে বিশ্রাম করছিলেন কেন? ঘটনার পরে হাসপাতাল থেকে বাবাকে ফোন করে বলা হয় মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেই পুরনো বুলি। শুধু তা-ই নয়, বাবা-মা মেয়েকে দেখতে চাইলে কেন পুলিশ কর্তৃপক্ষের এত টালবাহানা? কেনই বা বাবা-মায়ের অজানতে মেয়ের দেহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল? এক জন সিভিক ভলান্টিয়ার হয়ে সঞ্জয় রায় কী করে পুলিশ ব্যারাকে থাকার জায়গা পায়? হাসপাতালে অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারে? এ সবের পিছনে কার হাত আছে, আমাদের সবার জানার অধিকার আছে।
প্রফুল্ল কুমার সরকার, কলকাতা-৭৮
অভিযোগ ছিল
আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে রাজ্যবাসী হিসাবে মাথা হেঁট হয়ে গেল। খাস হাসপাতাল চত্বরে পড়ুয়া-চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা প্রমাণ করল, মহিলা-চিকিৎসক তাঁর কর্মস্থলে আজ আর নিরাপদ নন। রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী একাধারে স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র, এই দুই গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উভয়েই প্রাথমিক ভাবে এই ধর্ষণজনিত খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইছিল। অতীতে হাঁসখালিতে কিশোরীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে যেমন ‘লাভ অ্যাফেয়ার ছিল’ বলে তদন্তের অভিমুখ নির্দেশিত হয়েছিল, ঠিক সেই ভূমিকায় নামতে দেখা গেল হাসপাতালের প্রশাসক ও পুলিশকে। এক জন সিভিক ভলান্টিয়ার গ্রেফতার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তাঁর পেশাগত পরিচয় জানাতে গিয়ে ইতস্তত করতে দেখা গেছে খোদ পুলিশ কমিশনারকে।
আর জি কর হাসপাতালে টেন্ডার রাজ, তোলাবাজি, দুর্নীতি, দালালচক্র, অপছন্দের শিক্ষকদের বদলি, বিরুদ্ধ মতের ছাত্রদের ফেল করিয়ে দেওয়ার অজস্র অভিযোগ রয়েছে। অতীতে বেশ কিছু অভিযোগ স্বাস্থ্য দফতরের অধিকর্তার কাছে পৌঁছেছিল। একাধিক বার বিজ্ঞপ্তি বার করেও অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে বদলি করা যায়নি। কোন স্বার্থ অধ্যক্ষ ও সুপারকে স্ব-পদে রেখে দেওয়ার জন্য এত দিন তৎপর ছিল, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভেবে দেখা প্রয়োজন।
রাজশেখর দাশ, কলকাতা-১২২
সুরক্ষাহীন
‘ভয়ঙ্কর’ (১২-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় এক চিকিৎসক শিক্ষার্থী নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। জনৈক সঞ্জয় রায় এই ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছে। সমাজের প্রতিটি স্তর থেকেই এই জঘন্যতম অপরাধের শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। এর পরেও নাগরিক মনে কিছু প্রশ্ন নাড়া দিয়ে যায়। রাজ্যের অন্যতম একটি মেডিক্যাল কলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত ঢিলেঢালা কী করে? যেখানে ডাক্তারের নিরাপত্তা নেই, সেখানে সাধারণ মানুষের ভরসা থাকবে কী করে? তড়িঘড়ি এক জনকে গ্রেফতার করে, তার চরমতম শাস্তি দাবি করলেই কি উত্তর মিলবে? যেখানে এক, বা একাধিক অপরাধী বিনা বাধায় এত বড় একটা অপরাধ সংঘটিত করতে পারে, সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ইতিপূর্বে রিজওয়ানুর রহমানের রহস্য মৃত্যুর সাক্ষী থেকেছে রাজ্যবাসী, সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্স পাঠরত ছাত্রের অকালমৃত্যু দেখেছে, কামদুনির ঘটনা এখনও ফিকে হয়ে যায়নি। এই সব ঘটনায় মোমবাতি মিছিল বেরিয়েছে, ক্রমে ন্যায়ের দাবি স্তিমিত হয়ে এসেছে। হয়তো এমনই ঘটবে এই ঘটনার ক্ষেত্রেও। সব শাসকই জানেন, সাধারণ জনগণের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। কালের অতলে হারিয়ে যাবে সব অপরাধের নেপথ্য কাহিনি। এই বিস্মরণের ফাঁক গলে সংঘঠিত হবে নতুন নতুন অপরাধ। আমরা রাজনীতির নাগপাশ থেকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ বিচার আশা করার আস্থা হারাব বার বার।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
আড়াল কেন?
যে কোনও অন্যায় বা অপরাধ ঘটলে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে অপরাধীর পরিচয় গোপন করার একটা প্রাথমিক চেষ্টা দেখা যায়। আর অপরাধীর সঙ্গে যদি পুলিশের সংযোগ থাকে, তা হলে তো কথাই নেই! এটা আবার আমরা প্রত্যক্ষ করলাম সাম্প্রতিক আর জি করের ঘটনায়। ধৃত সঞ্জয় রায় কর্মসূত্রে কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার। তার একাধিক কীর্তিকলাপ জানা যাচ্ছে। এক জন সিভিক ভলান্টিয়ার হয়েও ‘আমিই পুলিশ’ বলে চমকানো ছাড়াও মহিলাদের উত্ত্যক্ত করা, মহিলা পুলিশকর্মীদেরও উত্ত্যক্ত করা, পুলিশে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা তোলা, অবাধে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে যাতায়াত করা, প্রভাবশালী কর্তার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে পুলিশ কর্তাদের সমীহ আদায় করে চলা, এ সবই জানা কথা। যে কোনও সরকারি হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করানোর ক্ষমতা রাখে সে, এবং সেই দাপটেই আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার অবাধ যাতায়াত। এখানে একটাই প্রশ্ন, এ-হেন কীর্তিমান সিভিক ভলান্টিয়ারের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে পুলিশের কেউই কিছু জানত না? না কি উপরমহলের কোনও প্রভাব কাজ করত।
পুলিশ শুরুতে এটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কেন? ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখলে বোঝা যায় না, সেটি আত্মহত্যা না খুন! অপরাধী ‘পুলিশ’ বলে কি? চিকিৎসক মহল সূত্রে জানা গেছে, মৃত ছাত্রী মেধাবী, নম্র, শান্ত স্বভাবের মেয়ে। এই ধরনের এক জন সম্ভাবনাময় চিকিৎসকের সঙ্গে সরকারি হাসপাতালেই যদি এই পরিণতি হয়, তা হলে বাকি সমাজের নিরাপত্তা কোথায়?
প্রসঙ্গত, সিভিক ভলান্টিয়ারদের অনেকে পুলিশ মহলে দলের প্রতিনিধি হয়েই বিরাজ করে। ‘দাদার লোক’ এই তকমা পাওয়ার জন্যই ধৃত সঞ্জয় রায় উর্দি পরত না, নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে পুলিশের ব্যারাকে থেকে সরকারের দেওয়া বাইক ব্যবহার করত। এ কেমন সিভিক ভলান্টিয়ার? এই প্রশ্নটি উঠবে না? সিভিক ভলান্টিয়ারদের অনেকে চাকরি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘পুলিশ’ স্টিকার সাঁটা বাইকে এলাকা টহল দেয়, সমীহ আদায়ের চেষ্টা করে। এটা আর কত দিন চলবে? তাদের গতিবিধির উপরেও নজরদারি দরকার; এ বিষয়ে পুলিশ মহলের বোধোদয় কি ঘটবে না?
দেবাশ্রিত রায়, রানাঘাট, নদিয়া