মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা বিতান বইয়ের বাংলা আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্তিতে সম্পাদকীয় স্তম্ভে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে (‘স্তাবক-বিতান’, ১২-৫)। চিরকালই সাহিত্য পুরস্কার একটি বিতর্কিত বিষয়। এমনকি নোবেল পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরস্কার পেয়েছেন বলে এত বিদ্রুপ? তাঁর কবিতা কারও পছন্দের না হতে পারে। তাঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে কেউ সহমত না হতে পারেন। কিন্তু পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর বিচারে যদি তাঁর কবিতার বই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়ে থাকে, তখন বিচারক মণ্ডলীর সদস্যদের ‘স্তাবক’ বলে আখ্যায়িত করা কি শিষ্টাচার সম্মত?
সাহিত্যে ‘ননসেন্স রাইম’-এর প্রচলন স্বদেশে ও বিদেশে অনেক আগে থেকেই আছে। সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল আজও জনপ্রিয়। সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে এই রাজ্য, এবং তার নাগরিক সমাজের গ্লানি যে অতলে পৌঁছল, তার দায় এবং ভার বাস্তবিকই দুর্বহ। কাজের ফাঁকে কবিতা লেখা ও তার জন্য পুরস্কৃত হওয়ায় এতটা অসম্মান কি মুখ্যমন্ত্রীর প্রাপ্য ছিল? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমালোচনা করা খুব সহজ। তিনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন ট্রেনের কামরায় সামান্য মৃত আরশোলার ছবি-সহ সংবাদ বড় হরফে এই রাজ্যের সংবাদপত্রে পরিবেশিত হয়েছে। অথচ, টাইম ম্যাগাজ়িনের বিচারে বিশ্বের প্রভাবশালীদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্থান করে নিলে অদ্ভুত ভাবে বাংলার সংবাদমাধ্যমকে নীরব থাকতে দেখি। তাঁর মস্তিষ্ক-প্রসূত কন্যাশ্রী প্রকল্প যখন ইউনেস্কো-র স্বীকৃতি পায়, তখন সমাজমাধ্যমের নীরবতা বিস্ময় জাগায়।
বর্তমান ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী তিনি হয়েছেন নিজের যোগ্যতায়। কবিতাও তাঁরই নিজের লেখা। কুম্ভিলকের অভিযোগ কেউ করেননি। সহজ সরল জীবনযাত্রার মতোই তাঁর সহজ সরল লেখা। তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তিতে তাই বুঝি ‘আঁতেল এলিট’-দের এতটা রাগ?
সুরজিৎ কুন্ডু
মুন্সিরহাট, হাওড়া
দীপ্তিহীন
‘স্তাবক বিতান’-এর মতো একটি সুদৃঢ় সম্পাদকীয়ের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রতিটি পঙ্ক্তিতে, প্রতিটি ছত্রে যৌক্তিক ভাবে যথার্থ কথাটি বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “কমল হীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে আর তা থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি।” শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়, প্রাক্তন সচিব (যাঁর জন্য নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে) সকলেই পাথর বয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের হিরে রশ্মি-বিবর্জিত।
যে যা-ই বলুক, হাজার সমালোচনা, হাজার প্রতিবাদেও পরিবর্তন কিছু হবে না। তাই আরও বিচিত্র পদ সৃষ্টি হবে, আনকোরা বিচিত্র পুরস্কারের পদক ঝুলবে অযোগ্য মানুষের গলায়। কিন্তু সেই সব কবি-সাহিত্যিক, যাঁরা যোগী রাজ্যে কী ঘটল তার দিকে তাকিয়ে থাকেন, সরবে প্রতিবাদও করেন, এ রাজ্যে ঘটে-যাওয়া ঘটনায় তাঁদের কানের তালা বা মুখের কুলুপ সরবে না। আমজনতা যা বলে বলুক, তাঁদের আর কাজ কী ‘ট্রোল’ করা ছাড়া!
চৈতালী তরফদার (ভট্টাচার্য)
সিঙ্গাপুর
হিংসুটের উত্তর
‘স্তাবক-বিতান’ সম্পাদকীয়তে সেই সব বাঙালির মনের কথা লেখা হয়েছে, যাঁরা এই সার্বিক অবক্ষয়ের যুগে মূল্যবোধকে এখনও পুরোপুরি বিসর্জন দেননি। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী পুরস্কারটি নাম ‘রিট্রিভারশিপ অ্যাওয়ার্ড’। বাংলা আকাদেমির সদস্য কবি সুবোধ সরকার বলেছেন, এই পুরস্কারটি অনেকটা ম্যাগসাইসাইয়ের মতো, এবং তিন বছর পরে আবার এই পুরস্কার দেওয়া হবে। অর্থাৎ, আপাতত তিন বছরের জন্য শান্তি!
সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে আগেও বিতর্ক দেখেছি। বাম আমলে সতীকান্ত গুহকে রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়। সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারেও বড়সড় যৌন কেলেঙ্কারির জন্য ২০১৮ সালে পুরস্কার দেওয়া বন্ধ ছিল। বাংলা আকাদেমির এই প্রাইজ় ঘোষণার পর, প্রতিবাদ দেখিয়ে পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া (রত্না রশিদ বন্দ্যোপাধ্যায়), উপদেষ্টা মণ্ডলী থেকে ইস্তফা (অনাদি রঞ্জন বিশ্বাস)— এ সব ঘটে চলেছে। প্রশ্ন হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা বিতান বইটিকে পুরস্কৃত করে বাংলা সাহিত্য কি এক ধাপ এগিয়ে গেল, না পিছিয়ে গেল? বাংলা আকাদেমির চেয়ারম্যান, মন্ত্রী ও নাট্যকার ব্রাত্য বসু পুরস্কারের সমালোচনায় উষ্মা প্রকাশ করে রবিঠাকুরের ভাষায় বলেছেন: “রেখেছ বাঙালী করে মানুষ কর নি।” এর উত্তরে আমাদের মতো ‘হিংসুটে’রা হয়তো বলবে, “রেখেছ স্তাবক করে, মানুষ করোনি।”
অশোক বসু
বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
সংখ্যা ও মান
বিশ্বকবির জন্মদিনে সরকারি মঞ্চে নিজের লেখা কাব্যগ্রন্থের জন্য বাংলা আকাদেমির নামাঙ্কিত পুরস্কার পেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানালেন, বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মতামত নিয়েই মুখ্যমন্ত্রীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। যদিও কোন কোন কৃতী সাহিত্যিকের অবদান ছিল এই পুরস্কার দানে, তা রাজ্যবাসীর অজানাই থেকে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর রচনা ছাপার জন্য যে প্রকাশকের অভাব হবে না, সেটা জানা কথা। আর যা কিছুরই অভাব থাক, এই হতভাগ্য দেশে চাটুকার ও স্তাবকের অভাব কোনও কালেই ছিল না। তবুও মনে প্রশ্ন জাগে, যে কবিতার বইয়ের জন্য এই পুরস্কারটি দেওয়া হল তার ক’টি কবিতা কবিতাপ্রেমীদের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যাবে? সংখ্যার নিরিখে নয়, পুরস্কার দেওয়া উচিত মানের নিরিখে। কবি রজনীকান্ত সেন তাঁর ৪৫ বছরের জীবদ্দশায় মাত্র সাতখানি গ্রন্থ রচনা করে যেতে পেরেছিলেন। তবুও আজও তিনি বঙ্গবাসীর হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন লাভ করে আছেন।
সমীর কুমার ঘোষ
কলকাতা-৬৫
স্বীকৃতি
পুরস্কারই নাকি মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা-মেধা-মননের স্বীকৃতি। যোগ্য মানুষও পুরস্কৃত না হওয়া পর্যন্ত নিজের প্রতিভা-যোগ্যতা নিয়ে সংশয়াকুল থাকে। আর যাঁরা তা নন, তাঁরা ক্ষমতা-অর্থবল-স্তাবক দলকে কাজে লাগিয়ে পুরস্কার কেনেন। তাঁরা নিশ্চিত জানেন, দু’দিন পরে কেউ-ই তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কিন্তু ছাত্রপাঠ্য পুস্তকে তাঁদের পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা লেখা থাকবে। শিশুরা যখন দেখবে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় কোনও পুরস্কার পাননি, অথচ পাঠ্যবইয়ে স্থানপ্রাপ্ত ব্যক্তি পুরস্কার-ভূষিত, তাদের চিত্ত তো চমকিত হবেই!
দিলীপ কুমার ঘোষ
দফরপুর, ডোমজুড়
মহত্ত্বের শর্ত
ক’টা কবিতা লিখলে তবে প্রাইজ় পাওয়া যায়? সং অফারিংস (১৯১২) বইয়ের ১০৩টি কবিতা রবীন্দ্রনাথকে নোবেল এনে দিয়েছিল। তেষট্টি পাতার যেতে পারি কিন্তু কেন যাব শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়েছিল সাহিত্য অকাদেমির (১৯৮৩) স্বীকৃতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা বিতান-এর কবিতা সংখ্যা ৯৪৬! কৌতূহলের বশে অ্যামাজ়নে ‘বুকস বাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’ লিখে সার্চ করলাম। মোট তেত্রিশটি এন্ট্রি পেলাম, যেখানে রেটিং দিয়েছেন সর্বমোট চৌত্রিশ জন! বাংলা সাহিত্যে কবির অবদান, অন্তত জনপ্রিয়তার নিরিখে, বোধ হয় উল্লেখযোগ্য বলা যাবে না। শেক্সপিয়রকে অনুসরণ করে বলতে পারি, কেউ জন্মেই মহান, কেউ মহত্ত্ব অর্জন করে, কারও উপরে মহত্ত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়।
দেবাশিষ মিত্র
কলকাতা-৭০