সম্পাদক সমীপেষু: ভাঙার কারণ

নকশাল আন্দোলনের নেতা, বিশিষ্ট কবি সাংবাদিক সরোজ দত্ত ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় (২০ অগস্ট, ১৯৭০) মূর্তি ভাঙার সমর্থনে লিখেছিলেন, ‘যুবশক্তি, শ্রমিক ও জনতা মূর্তি ভাঙছেন শুধু মূর্তি ভাঙার জন্য নয়, ও কাজ তাঁদের নেতিবাচক কাজ নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৮ ০০:১৫
Share:

আমাদের চতুর্দিকে মূর্তি ভাঙার হিড়িকে কিছু প্রাবন্ধিক এই কালাপাহাড়দের সঙ্গে নকশালদের একাসনে বসাচ্ছেন। কিন্তু মূর্তি ভাঙার সপক্ষে নকশালদের যে মতাদর্শগত অবস্থান, তার কোনও উল্লেখ তাঁদের লেখায় নেই। আমরা তার সঙ্গে সহমত না হতে পারি, কিন্তু সেই তাত্ত্বিক অবস্থান অনুল্লিখিত থাকলে, সাধারণ দুবৃত্তদের সঙ্গে কোনও পার্থক্য থাকে না সেই স্বার্থত্যাগী, নির্ভীক নকশাল তরুণদের, ‘যাঁরা একহাতে আগ্নেয়াস্ত্র আর অন্য হাতে হৃৎপিণ্ডটা নিয়ে সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন’, মনে হতেই পারে, ‘নকশাল’ শব্দটি নৈরাজ্যের সমার্থক।

Advertisement

নকশাল আন্দোলনের নেতা, বিশিষ্ট কবি সাংবাদিক সরোজ দত্ত ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় (২০ অগস্ট, ১৯৭০) মূর্তি ভাঙার সমর্থনে লিখেছিলেন, ‘যুবশক্তি, শ্রমিক ও জনতা মূর্তি ভাঙছেন শুধু মূর্তি ভাঙার জন্য নয়, ও কাজ তাঁদের নেতিবাচক কাজ নয়। মূর্তি ভাঙছেন তাঁরা পালটা মূর্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদে। কারণ নতুন মূর্তি মানেই নতুন রাজনীতি, সশস্ত্র সংগ্রামের বিপ্লবী রাজনীতি। তাই মূর্তি ভাঙার লড়াই আসলে, দুই লাইনের লড়াই, দুই শ্রেণির লড়াই। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্থান এখানে নেই।’ (সরোজ দত্ত রচনাবলি, ১ম খণ্ড)।

বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে সিপিআই (এমএল)-এর ক্ষোভ ছিলই যে বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তখন সেই কলেজ প্রাঙ্গণে সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজ ফৌজের ছাউনি পড়েছিল।

Advertisement

আবার এই মূল্যায়ন যে যথার্থ নয় তা দেখিয়েছেন উৎপল দত্ত, তাঁর ‘রবি ঠাকুরের মূর্তি’ প্রবন্ধে। ‘ছাপার অক্ষরে পড়েছি তোদের কাগজে, বললেন জপেনদা। আসলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে তোরা অজ্ঞ। তোরা মার্কসবাদ বুঝিস না। ইতিহাসে বুর্জোয়াদের যে বিপ্লবী ভূমিকা থাকে সেটা জানিস না। কুসংস্কার অার অশিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিদ্যাসাগর যে পরোক্ষে শ্রমিক আন্দোলনের পথ পরিষ্কার করে যাচ্ছেন এটা তোরা বুঝবি কিভাবে? চের্নিশেভস্কি সম্পর্কে লেনিনের লেখা তো কচুপোড়া পড়িসনি। আচ্ছা, তা না হয় না পড়লি— কিন্তু কমনসেন্সও কি থাকতে নেই? তোরা কি জানিস না বাংলা কথ্য ভাষাকে স্ট্যাণ্ডার্ডাইজ করে গেছেন বিদ্যাসাগর? জনতার ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন ব্যাকরণের ভিত্তিতে? শহর ও গ্রামের ভাষার পার্থক্যকে দূর করে গেছেন? আজ যে কথায় কথায় চেঁচাস গ্রামে যাও, কৃষককে রাজনীতি দাও— বিদ্যাসাগর না থাকলে গাঁয়ে গিয়ে বলতিস কি রে হতভাগা? কি ভাষায় কথা কইতিস কৃষকের সঙ্গে? শিখতিস তো সংস্কৃত আর বলতিস, ভো ভো হলধর, বিপ্লবস্য ফৌজম!’ (উৎপল দত্ত গদ্য সংগ্রহ, ১ম খণ্ড)।

আসলে বিদ্যাসাগর কালের পরিপ্রেক্ষিতে কী দিয়ে গেলেন, মার্কসবাদে তা-ই বিচার্য। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন কি না, শ্রমিক শ্রেণির অগ্রণী ভূমিকা সম্বন্ধে কিছু বললেন কি না, এ সব যে খোঁজে, জপেনদার ভাষায় সে ‘রাম জন্মাবার আগে রামায়ণ খুঁজছে।’

এ বিষয়ে সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘‘কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মশায়ের মর্মরমূর্তির যেদিন মুণ্ডচ্ছেদ হয়, তার মাসখানেকের মধ্যে সিপিআই(এমএল) দলের এক নেতৃস্থানীয় ছাত্রনেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। ঘটনাচক্রে সে আমার নিকট আত্মীয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট-ক্লাস-ফার্স্ট। কট্টর নকশাল। আমার পেচক-প্রতিম বিরস মুখখানা দেখে সে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল ‘বিশ্বাস কর ছোটকাকু! মূর্তিটা যে ভেঙেছে তাকে আমি চিনি। গত বছর হায়ার সেকেণ্ডারিতে সে বাংলায় লেটার পেয়েছে। ওর সেই বাংলা প্রশ্নপত্রে প্রবন্ধ এসেছিল, ‘তোমার প্রিয় দেশবরেণ্য নেতা’। ও লিখেছিল বিদ্যাসাগরের উপর।’’

‘‘আমি জানতে চেয়েছিলুম, ‘তাহলে ও বিদ্যাসাগরের মূর্তিটা ভাঙল কেন?’

‘‘...বিদ্যাসাগরের মূর্তি তো সে ভাঙেনি। ভেঙেছে একটা ফেটিশ! ‘ষড়যন্ত্রী’ মশাইরা যে ফেটিশের গলায় প্রতি বছর ২৬ সেপ্টেম্বর একটা করে গাঁথা ফুলের মালা দুলিয়ে দিয়ে তোমাদের বলেন, আগামীবার ভোটটা আমায় দেবেন কাইণ্ডলি। দুঃখ কর না কাকু। সর্বহারার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে বিদ্যাসাগরের মূর্তি আমরাই বসাব।’’ (আজিজুল হক-এর লেখা ‘নকশালবাড়ী: বিক্ষোভ-বিদ্রোহ-বিপ্লব এবং রাশিয়া...’ গ্রন্থের ভূমিকা)।

এ কথা বোঝা জরুরি যে মূর্তি ভাঙা প্রশ্নে নকশালদের অবস্থান হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপ্রতীপ মেরুতে। রুশ বিপ্লবের পরে লেনিনগ্রাদে কিন্তু পিটার দ্য গ্রেট-এর মূর্তি ভাঙা হয়নি।

শিবাজী ভাদুড়ী হাওড়া

গড়ার কারণ

মূর্তি ভাঙা না-হয় গর্হিত কাজ। মূর্তি গড়া কি খুব মহৎ কর্ম? তা হলে মূর্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার মূলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক। মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই অসহায়। প্রথমে প্রকৃতির প্রচণ্ডতা। পরে সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে-সঙ্গে জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা। ধীরে-ধীরে আত্মনির্ভরতা বিসর্জন দিয়ে হাল ছেড়ে দেয় মানুষ। আত্মসমর্পণ করে এক অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে। সেই সর্বশক্তিমানের কৃপাতেই তার বাঁচা-মরা। সেই অতিপ্রাকৃতকে যাতে সাধারণ জন উপলব্ধি করতে পারে, তার জন্য গড়ে ওঠে নানা মূর্তি।

চলছিল ভালই, গোল পাকালেন মার্কসসাহেব। জগৎসংসারের সব কাণ্ডকেই তিনি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে উদ্যোগী হলেন। তাঁর মতবাদের হাত ধরে জন্ম নিল এক নতুন মনুষ্য সম্প্রদায়। ঘোর বস্তুবাদী, অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী নয় একেবারেই। (আগেও নাস্তিকেরা ছিল। কিন্তু তাদের উপস্থিতি এত সবল, চিৎকৃত ছিল না)।

তবে অভ্যাস যাবে কোথায়? স্বপ্নের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রবাদপ্রতিম বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়ে আত্মবিশ্বাস হারাল কমিউনিস্ট ক্যাডার। নাস্তিক ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করে কী করে? তাই তারা এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের লক্ষ্যে আস্থা স্থাপন করল পার্টির উপর। তার পর ধীরে-ধীরে নির্ভুল, অভ্রান্ত, সর্বজ্ঞানের অাধার পার্টি-নেতৃত্বের উপর। সেই আস্থা পোক্ত করতে, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের আদলেই গড়ে উঠল মার্কস, লেনিন, স্তালিনের স্ট্যাচু। মূর্তি যারই হোক, তা আসলে মানুষের অসহায়তারই প্রতীক।

মূর্তি স্থাপনের একটা কারণ অবশ্যই ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে আত্মবিশ্বাসের অভাব। ঈশ্বরপ্রেমী ডানপন্থীরা মূর্তি গড়বে, স্বাভাবিক। তা ভেঙে ফেলা বেদনাদায়ক। কিন্তু বামপন্থীরাও...!

অর্জুন সেনগুপ্ত যুগ্ম সম্পাদক, ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (নবপর্যায়)

মানে নেই

শহর ভর্তি প্রচুর মূর্তি কেন? নিশ্চয়ই সেই অসামান্য মানুষদের আমরা স্মরণ করতে চাই বলে। তাঁরা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাই আমরা তাঁদের মূর্তির দিকে তাকাব, তাঁদের মহত্ত্বের কথা ভাবব, তাঁদের আলোয় নিজেদের সামান্য জীবন আলোকিত করে নিতে উদ্দীপিত হব। কিন্তু, শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমরা কেউ নেতাজির কথা ভাবি কি? নাকি ভাবি, কী করে এই ব্যস্ত রাস্তাটা পেরোব? ধর্মতলায় লেনিনের মূর্তির তলায় যারা জিরোয়, তারা লেনিনের অবদানের কথা ভেবে ধ্যানস্থ থাকে? বরং এই ভাঙাভাঙি হলে আমাদের টনক নড়ে, তাই তো, এতগুলো বড় বড় মানুষের মূর্তি আছে!

লোকেশ চৌধুরী কলকাতা-৬৪

ভ্রম সংশোধন

• মদন টিয়ার ছবিটি (২২-৩, পৃ ১৬) প্রদীপ্ত বিশ্বাস নয়, জয়দীপ দাসের তোলা।

• ‘মৃত্যুতে যন্ত্রণামুক্তি সৎপাত্র সুদানের’ শীর্ষক খবরে (২১-৩, পৃ ১০) লেখা হয়েছে ‘সুদান’ নামের গন্ডারটির দুই মেয়ে ‘নাজিন’ এবং ‘ফাতু’। প্রকৃতপক্ষে ফাতু হল নাজিনের মেয়ে, অর্থাৎ সুদানের নাতনি।

অনিচ্ছাকৃত এই ভুলগুলির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement