‘বীরের সম্মান?’ (১৬-১০) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে আলোচনা বড়ই একপেশে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আজ সর্বব্যাপী, এ কথা অনস্বীকার্য। বিভিন্ন সময়ে সব দলের রাজনৈতিক নেতারা কোনও না কোনও অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে জেলে গিয়েছেন। তাঁদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমাদের দেশের নাগরিকরা এই অভিযুক্ত নেতাদের ভোট দিয়ে কেন জেতান? ইদানীং নির্বাচন কমিশন এই দাগী নেতাদের সম্পর্কে অপরাধের খতিয়ান প্রকাশ করে, তাঁদের কত সম্পত্তি, কাদের বিরুদ্ধে কত ফৌজদারি মামলা চলছে তার বিস্তারিত তথ্য পেশ করে গণমাধ্যমে। তবুও নির্বাচকমণ্ডলীকে নিরস্ত করা যায় না এঁদের নির্বাচিত করা থেকে। রাজনৈতিক দলগুলোও এই বাহুবলীদের নির্বাচনে লড়ার টিকিট দেয়। এ-ও তো এক রকম অপরাধীদের স্বীকৃতি দেওয়া। এই সব অপরাধী নিজ নিজ দলকে আর্থিক সহায়তাও করেন।
তবে এ বারের আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলনে কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতৃবৃন্দ কেন চুপচাপ বোঝা মুশকিল। দশ দফা দাবিতে যে আমরণ অনশন করলেন ডাক্তাররা, সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। এ নিয়ে জনমানসে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যেন একটা ঝোঁক রয়েছে অপরাধীদের আড়াল করা এবং তাঁদের বীরের সম্মান প্রদর্শন করা। সেটা কর্নাটকের গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযুক্তদের আড়াল করা থেকে এই রাজ্যে গরুপাচার মামলায় অভিযুক্ত অনুব্রতকে ‘বাঘ’ আখ্যা দেওয়া, নানা সময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় কর্মীদের পাশে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাঁড়ানো, এ সব থেকেই বোঝা যায়। বার বার আদালতে পুলিশ তিরস্কৃত হলেও এক সময় অভিযুক্তরা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন, এও তো এক রকম অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়ানোর উদাহরণ শাসক দলের। যখন সব রাজনৈতিক দল একই ভাবে অভিযুক্ত, তখন কোনও একটি দলকে দায়ী করা ঠিক নয়।
তারক সাহা, হিন্দমোটর, হুগলি
অন্তহীন হিংসা
‘ধ্বংসের এক বছর’ (৭-১০) সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি যেন চেতনায় চাবুক। যথার্থ সাম্যবাদী শিবিরের অনুপস্থিতিতে বিশ্বের সমস্ত প্রতিবাদ প্রতিরোধ আগ্রাহ্য করে একতরফা প্রাণঘাতী রক্তক্ষয়ী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইজ়রায়েল। ইজ়রায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে বিশ্বের এতগুলি দেশ কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। বরং কেউ কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, এমনকি ভারতও। ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় তারা স্বার্থের রাজনীতি ও কূটনীতির প্যাঁচ খেলছে।
আন্তর্জাতিক আইন, নীতি নৈতিকতা লঙ্ঘন করে ইজ়রায়েল নির্মম গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ৫০,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী; হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাসস্থান, ধর্মস্থান, আশ্রয় শিবির সব গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ আহত, ঘরছাড়া, শিবির ছাড়া, বিপর্যস্ত। অনেকে চিকিৎসাহীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
প্রবন্ধে সঠিক ভাবে বলা হয়েছে, কোনও জঙ্গি (হামাস) গোষ্ঠীর আক্রমণ, এবং সামগ্রিক ভাবে কোনও সমাজের উপর এক আগ্রাসী রাষ্ট্রের লাগাতার আক্রমণ, অসামরিক জনগোষ্ঠীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করা এক কথা নয়। সে কাজ যদি ইজ়রায়েলের মতো সামরিক ভাবে অতীব দক্ষ ও সমৃদ্ধ দেশ করতে থাকে, এবং তাকে অনবরত নেপথ্য সহায়তা দানে উন্মুখ থাকে আমেরিকার মতো ‘সুপারপাওয়ার’, তা হলে কোনও যুক্তিতেই তাকে সমর্থন করা অসম্ভব।
ভারত তথা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ভীষণ ভাবে উদ্বিগ্ন। জোরদার শান্তি আন্দোলনের পক্ষে আক্রমণ বন্ধের জন্য আমেরিকা ও ইজ়রায়েলের পণ্য বয়কট আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। অন্তহীন হিংস্রতা ও বিপরীতে নিঃসীম নিস্পৃহতাকে ‘অবধারিত’ বলে কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
মল্লিকা সরকার, ইংলিশ বাজার, মালদহ
দর্শনধারী
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘নতুন বর্মের খোঁজে’ (৩-১০) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত ‘মোদী ব্র্যান্ড’টিকে উজ্জ্বল করতে চেয়েছেন। বেশভূষা হোক, পরিবেশপ্রেমী ভাবমূর্তিই হোক, কিংবা নোটবন্দির ঘোষণা, অথবা কোভিডকালে দেশ জুড়ে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা— প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি প্রচারের তীব্র আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করেছেন। আবার, সংবেদনশীল বিষয়গুলিতে তিনি নীরব থেকেছেন। দিল্লির উপকণ্ঠে কৃষক আন্দোলন, বা মণিপুরে হিংসা নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করেননি। বিরোধী নেতাদের অনেকের মুখে যখন অশ্রাব্য ভাষার ফুলঝুরি, তখন মোদী প্রায় কোনও বেফাঁস মন্তব্য করেননি। তিনি এই ডিজিটাল জেট যুগের অবিসংবাদী নেতা। এক দিনে এমনটা হয়নি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই ধীরে ধীরে এই ভাবমূর্তি তিনি গড়েছেন। সেই সময়ে নেতৃত্বে থাকা বাঘা বাঘা রাজনীতিকে পিছনের সারিতে পাঠিয়েছেন অবলীলায়। এখন তাঁরাই দর্শক, তাঁরাই মোদীজির গুণগানে ব্যস্ত।
এই যুগ বিজ্ঞাপনের, বৈদ্যুতিন মাধ্যমের, গতির, ‘লাইমলাইট’-এ থাকার। এ হল নীতি, আদর্শের বাইরে ব্যক্তি বন্দনায় মেতে ওঠার যুগ। নেতা হতে কিংবা সর্বাধিনায়ক হতে আত্মত্যাগের পরিবর্তে আজ চাই মেন্টর, বিজ্ঞাপনের ঝলকানি, সর্বোপরি অত্যন্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কুশলী দল, যে ক্রমাগত প্রচারের হাতুড়ি ব্যবহার করে অখ্যাত মানুষকেও রাতারাতি নেতা করে দিতে পারবে। আজ আর আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের আগুন নেতা তৈরি করে না, সেই জায়গা নিয়েছেন ‘ভোটকুশলী’ প্রশান্ত কিশোরের মতো ব্যক্তি। তাঁরা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, বক্তব্য তৈরি করেন অর্থের বিনিময়ে, যেখানে ‘আন্দোলন’ নামক শব্দটির অস্তিত্বই নেই।
জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর নিজে বিভিন্ন ভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, এবং তিনিই আবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচন জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এর পিছনে ছিল তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, নিজের প্রতি আস্থা এবং দেশবাসীর প্রতি শ্রদ্ধা। রাজনৈতিক নেতাকে বিপণন করার জন্য, ভোটদাতাদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা মাপার জন্য কোনও বিশেষ সংস্থা সেই যুগে ছিল না, তার প্রয়োজনও সেই সময় কেউ অনুভব করেননি। তাই পরিবেশ সচেতনতা দেখাতে সাগর পাড়ে ইন্দিরা গান্ধীকে কখনও প্লাস্টিক ব্যাগ কুড়োতে দেখা যায়নি, অথবা মধ্যরাতে নিজের নির্বাচনী এলাকার রেল স্টেশনে ঘুরতে হয়নি। সব সময় ক্যামেরার সামনেও দাঁড়াতে হয়নি। কিন্তু মোদীজিকে প্রায়ই এগুলোর আশ্রয় নিতে দেখেছি আমরা, কারণ এই যুগ দৃশ্যমাধ্যমের। মানুষ এখন তাঁদের মোবাইলের পর্দায় সব কিছু দেখতে চান।
‘এক দেশ এক নির্বাচন’ এই দাবি সংবিধান সংশোধন করে কার্যকর করতে হলে অনেকটাই জটিলতা দেখা দিতে পারে, তা নরেন্দ্র মোদী জানেন। কিন্তু এই দাবিটি জারি রেখে ভোটবাক্স ভরাতে তো বাধা নেই। তাই প্রবন্ধকার সঠিক বলেছেন, এই দাবি জোরালো করার মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক দিশা ঠিক করতে চাইছেন। এমনিতেই বিগত লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদী ব্র্যান্ড’ ‘মোদী কি গ্যারান্টি’ শব্দবন্ধ দু’টি যথেষ্ট ধাক্কা খেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মেন্টরদের অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবেই। বিরোধী পালে হাওয়া লাগার আগেই তাঁরা পুরনো দাবিটি ফিরিয়ে আনতে চাইছেন দ্রুত। তবে জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে কতটা সক্ষম হবেন, সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। পূর্বতন সরকারে তিনি যা বলতেন, এই আমলে তিনি ততটা দৃঢ়তা দেখাতে পারেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি