সুমনা রায়ের ‘নীরব জীবনের স্বাক্ষর’ (৯-৭) শীর্ষক প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান-বিষয়ক লেখার সঙ্কলন অব্যক্ত প্রকাশভঙ্গিতে ছিল ভারমুক্ত লাবণ্যময়। মানুষের সঙ্গে গাছের জীবনের তুলনামূলক আলোচনা করে দেখিয়েছিলেন, “গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়ামাত্র” (গাছের কথা)। প্রবাসী, মুকুল, সাহিত্য, মোসলেম ভারত, ভারতবর্ষ-এ প্রকাশিত তাঁর ১৯টি প্রবন্ধ ও একটি গল্প নিয়ে অব্যক্ত বার হলে একটি কপি পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, “আজ জোনাকির আলো রবির প্রখর আলোর নিকট পাঠাইলাম।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, “তোমার ‘অব্যক্ত’-র অনেক লেখাই আমার পূর্ব পরিচিত এবং এগুলি পড়িয়া ভাবিয়াছি যে, যদিও বিজ্ঞানবাণীকেই তুমি তোমার সুয়োরাণী করিয়াছ, তবু সাহিত্যসরস্বতী সে পদের দাবী করিতে পারিত— কেবল অনবধানেই সে অনাদৃত হইয়া আছে।”
তবে প্যারিস শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান আলোচনাচক্রে (১৮৯৯) তাঁর জড় পদার্থের সাড়া বিষয়ক মতবাদ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। যদিও স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় সে দিন জগদীশচন্দ্র... ‘মাতৃভূমির মৃতপ্রায় শরীরে নবজীবনতরঙ্গ সঞ্চার’ করেছিলেন। ১৯০২-এর অক্টোবরে তাঁর প্রথম গবেষণা গ্রন্থ রেসপন্স ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন লিভিং প্রকাশিত হলে বিজ্ঞানী মহলে সাড়া পড়ে যায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁকে প্রশংসা করে বিজ্ঞানীরা তাঁর প্রতি সে দিন শ্রদ্ধা জানান।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি
অনুবাদের অভাব
সুমনা রায় তাঁর ‘নীরব জীবনের স্বাক্ষর’ শীর্ষক প্রবন্ধে জেমস জয়েসের ইউলিসিস বা টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ড-এর শতবর্ষ পূর্তিকে ঘিরে পাশ্চাত্যের উচ্ছ্বাস, এবং পাশাপাশি জগদীশচন্দ্র বসুর অব্যক্ত-র প্রতি সর্বজনীন উদাসীনতা দেখে বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ তো দুঃখ-বিলাসিতার নামান্তর। অনুমান করা যায়, অব্যক্ত-র ইংরেজি অনুবাদ না থাকায় বইটি পশ্চিমের (এমনকি অবাঙালি ভারতীয়দের) অজানা থেকে গিয়েছে। স্বীকৃতি অনেক সময় বিলম্বিত লয়ে আসে, জীবৎকালে জুটতে পারে ব্যঙ্গ— অব্যক্ত বইয়েরই একটি প্রবন্ধে জানতে পারি, গ্যালভানিকে ‘ব্যাঙ-নাচানো অধ্যাপক’ বলা হত! তাই, শতবর্ষ পরেও যদি কারও নামে চাঁদের গহ্বরের নামকরণ করা হয়, ৫০ পাউন্ডের নোটে ছবি ছাপা হয়, এমনকি গুগল ডুডল-এর অভ্যর্থনা যদি কেউ লাভ করেন, তা কি নিতান্তই সম্মানের অভাব?
এ দেশেও যদি এ বছর দ্য ওয়েস্টল্যান্ড নিয়ে একটু হইচই হয়, তাতে সঙ্কুচিত হওয়ার কিছু নেই। মহৎ সাহিত্য পূর্ব-পশ্চিম ভেদাভেদের অপেক্ষা রাখে না। অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ সম্পর্কে মহাকবি গ্যোয়টের প্রশস্তি স্মর্তব্য। দ্য ওয়েস্টল্যান্ড কবিতার প্রভাবেই তো বিষ্ণু দে, সমর সেনের কাব্যের আধুনিকতা নতুন মাত্রা পেয়েছিল। ২০২২-এ এই বিশ্বগ্রামে উত্তর-ঔপনিবেশিকতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। মনকে উপনিবেশ-মুক্ত করা তো আর সম্ভব হয়ে উঠল না! বুকার, এশিয়ান বুকারের ‘লং লিস্ট’-এ থাকতে পারার শ্লাঘা আমরা কি উপেক্ষা করতে পারলাম?
চন্দন আশিস লাহা, শিলিগুড়ি
বিপন্ন বন
‘অরণ্যের অধিকার’ (১৪-৭) সম্পাদকীয়টি কমলাকান্তের যুক্তি মনে করিয়ে দেয়। আদালতে কমলাকান্ত মানতে চায়নি গরুর উপর প্রসন্ন গোয়ালিনির মালিকানা। তার যুক্তি ছিল, যে দুধ খায়, গরু তার। প্রসন্ন যে হেতু গরুর দুধ খায় না, তাই সে গরুর মালকিন হতে পারে না। মনে হয়, সেই যুক্তির বশেই আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধিত অরণ্য আইনে অরণ্যবাসীদের অধিকার মানতে চায়নি। অরণ্যবাসী জনজাতিরা শুকনো কাঠ, ফলমূল ইত্যাদির সাহায্যে জীবনযাপন করেন। মাটির তলার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে ‘উন্নয়ন’ করেন না। তাই, বর্তমান সরকার ঠিক করেছে, অরণ্যভূমি ব্যবহারের ব্যাপারে তাঁদের মতামতের কোনও মূল্য নেই। অতএব ২০০৯ সালে ইউপিএ সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে অরণ্যবাসীর অধিকার সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অরণ্যের জমি অন্য কোনও কাজে ব্যবহারের ছাড়পত্র না দেওয়ার যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, বর্তমান সরকার তা নাকচ করে দিয়েছে।
২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী, তফসিলভুক্ত জনজাতির সংখ্যা সাড়ে দশ কোটি এবং তাঁদের প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রাম ও বনভূমিতে বাস করেন। সুতরাং, তাঁদের ভোট জরুরি। কিন্তু অরণ্যবাসী জনজাতির স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার, পরিবেশ রক্ষার কোনও দায় কেন্দ্রের শাসক দলের নেই। লক্ষণীয়, যে সব রাজ্যে বনভূমি ও অরণ্যবাসী জনজাতির সংখ্যা বেশি, তাদের বেশির ভাগের সরকার কেন্দ্রের শাসক দলের হাতে। তাই পরিকল্পিত ভাবেই ছাড়পত্র দেওয়ার অধিকার রাজ্য সরকারগুলিকে দেওয়া হয়েছে, যাতে অনুগামী পুঁজিপতিরা সহজেই জমি পেতে পারেন। তল্পিবাহক পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাই যেন সরকারের একমাত্র কাজ।
সুনীল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৪
কাঠকুটোই ভরসা
প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনায় রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার শূন্য। সকাল হলে মেয়েরা ছুটছেন জঙ্গলে কাঠ ও শুকনো পাতা জোগাড়ে। জঙ্গলমহলের ৮৪ শতাংশের বেশি পরিবারের হাঁড়ি চড়ে বনের শুকনো কাঠে। যাঁরা অতি কষ্টে ৪৫০-৬০০ টাকা জোগাড় করে গ্যাস সিলিন্ডার সংযোগ নিয়েছিলেন, তাঁদের এখন ইচ্ছে থাকলেও নতুন গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি করার সুযোগও নেই। কারণ, ফড়েদের কাছে থাকে গ্যাসের বই। গ্যাস নিয়ে এক বারও ব্যবহার করেনি, এমন বহু পরিবার আছে। অনেককে দেখেছি, সিলিন্ডার রয়েছে, কিন্তু গ্যাসের আভেন কোথায়, খোঁজ রাখেন না। প্রায় ৯৫ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায় গ্যাস সিলিন্ডার নেওয়া বন্ধ করেছে। ফলে বন-নির্ভর জ্বালানির দিকে ঝোঁক বাড়ছে। এই সব তথ্য এসেছে বিগত তিন বছর ধরে জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ছয়টি ব্লকের ২৪৫টি গ্রামে ৩৫১০টি পরিবারের উপর ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৯০ শতাংশ মহিলা জঙ্গল থেকে শুকনো জ্বালানি সংগ্রহ করতে ব্যয় করে দিনের অনেকটা সময়। তা ছাড়াও বছরে তিন-চার মাস হাতির আনাগোনা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রহ করতে হয় জ্বালানি কাঠ। যাঁরা সরাসরি জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করেন না, তাঁদেরও এক হাজার টাকার জ্বালানি কাঠ কিনলে তিন থেকে চার মাস চলে।
২০০৬ সালে ভারত সরকারের অরণ্যের অধিকার আইন কার্যকর হয়েছিল। তাতে উল্লেখ ছিল, চিরাচরিত ভাবে জঙ্গলে যাঁদের বাস তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করা ও তাঁদের অনুমোদনক্রমে জঙ্গল ব্যবহার করা যেতে পারে। সম্প্রতি ইউপিএ সরকারের তৈরি অরণ্যের অধিকার আইনকে লঘু করে শিল্পপতিদের সুযোগ করে দিচ্ছে মোদী সরকার। গত ২৮ জুন বন ও পরিবেশ মন্ত্রক নতুন নিয়ম বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তাতে দাবি করা হচ্ছে, পরিকাঠামো তৈরি ও উন্নয়নের কাজে জঙ্গলের জমি কাজে লাগানো হবে। অনেক সময় আদিবাসীরা বন পরিচালনা কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন। বন দফতরের যুক্তি, আদিবাসীদের বন পরিচালনার ক্ষমতা নেই। অথচ, আদিবাসীরা বন সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেলে বন ধ্বংস হওয়ার প্রবণতা কমে। শুধু তা-ই নয়, মহিলা পরিচালিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আড়াবাড়ি জঙ্গলে বনবাসীদের উন্নয়ন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলে বিপন্ন হবেন দরিদ্র, মহিলা, ভূমিহীন, দলিত ও আদিবাসীরা।
প্রভাত কুমার শীট, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর