‘এ এক অভূতপূর্ব অসাম্য’ (২২-৬) নিবন্ধটির সূত্রে অচিন চক্রবর্তী যথার্থই বলেছেন, ভারতে বর্তমান অসাম্যের প্রকৃতি আলাদা। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে দু’-একটি কথা সংযোজন করতে চাই। কোভিডকালে এক দিকে যেমন কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে, স্টক এক্সচেঞ্জে পঞ্জীভূত কোম্পানিগুলি একই সময়ে অভাবনীয় লাভ করেছে। গত আর্থিক বছরের শেষ তিনটে কোয়ার্টারে এই কোম্পানিগুলি লাভ করেছে যথাক্রমে— ১ লক্ষ ৫৩ হাজার কোটি, ১ লক্ষ ৫৮ হাজার কোটি, আর ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম কোম্পানিগুলি এত লাভ করল। এক দিকে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে, অন্য দিকে সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলির আকাশছোঁয়া লাভ হয়েছে। পাশাপাশি আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দেখিয়েছে, একই সময়ে সব রকম কর্মীর গড়ে রোজগার মাসে ১৫ হাজার টাকা থেকে কমে ১২ হাজার টাকা হয়ে গিয়েছে। এবং প্রায় ২৩ কোটি মানুষ আবার দারিদ্রসীমার নীচে চলে গিয়েছেন।
কর্মসংস্থানের দেশব্যাপী সমীক্ষা নিয়মিত করে থাকে ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’; এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে লক্ষাধিক উত্তরদাতার মধ্যে ৫৫% বলেছেন তাঁদের রোজগার কমে গিয়েছে। মাত্র ৩% মানুষ বলেছেন তাঁদের রোজগার বেড়েছে। সাধারণ সময়ে বিপরীতটাই ঘটে। অর্থাৎ, অসাম্যের সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্রও বেড়েছে। ২০১৩ সালের রঙ্গরাজন রিপোর্টের পর থেকে দেশে দারিদ্রের হিসাব রাখা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে খাদ্য সুরক্ষা-সহ আরও অনেক প্রকল্পে। এটা এখন পরিষ্কার যে, সরকারের ঘরেও টাকা নেই। এই অবস্থায় ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থাগুলির সংগঠন ‘ফিকি’ সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে ৩ লক্ষ কোটি টাকার নোট ছাপাতে। অসাম্য কমাতে গেলে কর্পোরেটদের জন্য কেন বাড়তি কর ধার্য করা হবে না— এই প্রশ্ন কিন্তু উঠছে না। এমনকি ওই পঞ্জীভূত কোম্পানিগুলি গত বছরের অভাবনীয় লাভের কত অংশ সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা খাতে (‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’) বাস্তবিক খরচ করছে, সেই কথাও কেউ তুলছে না।
অশোক সরকার, কলকাতা-৯৯
ধনীর প্রহরী
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি ‘অটুট’ বললে কিছু আপত্তি থেকে যায় (‘ভাবমূর্তি এখনও অটুট’, ২৮-৬)। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এবং তার জেরে দিনের পর দিন সারিবদ্ধ জ্বলন্ত চিতার দৃশ্য, গঙ্গায় ভাসমান লাশ দেখেছেন দেশবাসী। আরও কিছুটা পিছিয়ে গেলে নোটবন্দি, জিএসটিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, অপরিকল্পিত লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুর্গতি-যন্ত্রণা, অসহায় মৃত্যুর কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার তথা মোদীজি চিহ্নিত হয়েছেন। এ ব্যাপারে তাঁর সম্পর্কে নানা রকম বিরূপ সমালোচনা এবং তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাসের বার্তা এসেছে দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। এ নিয়ে সময়ানুক্রমিক লেখচিত্র বিচার করলে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখর থেকে কিছুটা হলেও তাঁর অবনমন লক্ষ করা যায়। আমেরিকার এক তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ মে থেকে এ বছরের ৩০ মে পর্যন্ত এই এক বছরে মোদীর জনপ্রিয়তা ৮২ শতাংশ থেকে নেমে ৬৩ শতাংশে চলে এসেছে। তবে এই হ্রাস যতখানি হওয়া প্রত্যাশিত ছিল, ততখানি হয়নি। এ জন্য তাঁর বিবিধ ক্ষমতা, তাঁকে উচ্চে তুলে ব্যাপক প্রচার, বিপুল অর্থব্যয়, পরিকল্পিত পদক্ষেপ করা, ইত্যাদি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের বাইরে গণতন্ত্র বলতে আর বোধ করি বেশি কিছু নেই। নির্বাচন গণতন্ত্রের উৎসব। নির্বাচন কমিশন থেকে বড় বড় নির্বাচনী দল তাই এই উৎসবকে নিষ্ঠার সঙ্গে উদ্যাপনের যাবতীয় বন্দোবস্ত করে। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ৬০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ নির্বাচনী খরচ। এর ৪৫ শতাংশ হল বিজেপি দলের খরচ, যার পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, বিজয়ী ৩০৩ প্রার্থীর জন্য মাথাপিছু ৮৯ কোটি টাকা খরচ। ভাবতে অবাক লাগে। এ থেকে বলা চলে, ভোট এখন টাকার খেলা। ভোটে জিততে চাই মোটা অঙ্কের টাকা। তাই সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই ধনকুবেরদের কাছে হাত পাততে হয়। আর সেই কারণেই সরকারি ক্ষমতায় বসে ক্ষমতাসীনদের অষ্টপ্রহর চিন্তা থাকে, কী করে তাঁরা এই ধনকুবেরদের স্বার্থ রক্ষা করবেন। বর্তমানে সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ, মূল্যবৃদ্ধির অপ্রতিহত অগ্রগতি, কৃষি আইন, শ্রম বিধি, বিদ্যুৎ আইন, শিক্ষা নীতি— সবই ধনকুবেরদের মুখ চেয়ে।
নিবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, “মোদীর সবচেয়ে বিপজ্জনক অবদান হল রাজনীতির সঙ্গে ভারতীয় গুরুবাদী ঐতিহ্যের সংযোজন।” পরিকল্পিত ভাবে মোদী তাঁর কোটি কোটি ভক্ত তৈরি করেছেন। গুরুর প্রতি অনাস্থা? না, এমন পাপ শিষ্যরা করতেই পারেন না। তৎসত্ত্বেও কৃষি আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের দীর্ঘ ঐতিহাসিক আন্দোলন, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা দেশব্যাপী আন্দোলন মোদীকে জনপ্রিয়তার সিংহাসন থেকে নামিয়ে দিতেই পারে। তাতে কিছু যায় আসে না।
এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার রক্ষক রাষ্ট্র নতুন মোদীর জন্মও দিতে পারে, যিনি এই শোষণমূলক ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিশ্বস্ত পাহারাদারের কাজ করতে পারেন।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
বিপ্লব-মানিক
‘ফের প্রশ্ন, বিপ্লবে নরম কেন মানিক’ (২৯-৬) শিরোনামে কিছু সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির প্রতিবাদে এই পত্র। ২৭ জুন আগরতলার সিপিআইএম রাজ্য দফতরে সংবাদ সম্মেলনে ত্রিপুরা বিধানসভার বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার যে বক্তব্য রেখেছেন, তা বিকৃত ভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। বিপ্লব দেব-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ত্রিপুরার বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের গত ৩৯ মাসের শাসনে শাসক জোটের ফ্যাসিস্টসুলভ আক্রমণ এবং রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে মানিক সরকার বক্তব্য রেখেছিলেন। মার্চ মাসে বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে সিপিআইএম-এর বর্ষীয়ান বিধায়ক বাদল চৌধুরীর উপর আক্রমণের ঘটনা আলোচনা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব এ ধরনের রাজনৈতিক আক্রমণ বন্ধে সরকারি পদক্ষেপ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির পরেও বিরোধীদের উপর বিজেপির কত আক্রমণ হয়েছে, তার তথ্য সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত করেন মানিক সরকার। অতএব, মানিক সরকার ‘বিপ্লবে নরম’ এই অভিমত সম্পূর্ণ কুৎসামূলক। মানিক সরকারের নেতৃত্বে গত ১০ মে যে প্রতিনিধি দল দক্ষিণ ত্রিপুরার শান্তিরবাজারে পুলিশের উপস্থিতিতে বিজেপির দুর্বৃত্তবাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয়, তার এফআইআর হয়নি, এ তথ্যও ভুল। জেলা পুলিশ সুপারের মাধ্যমে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লিখিত এফআইআর হয়েছে এবং পুলিশ অ্যাকাউন্টেবিলিটি কমিশনে পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে।
গৌতম দাশ, রাজ্য সম্পাদক, ত্রিপুরা সিপিআইএম
প্রতিবেদকের উত্তর: সংবাদ সম্মেলনের ভিডিয়ো সম্পূর্ণ দেখে প্রতিবেদন করা হয়েছে। সম্মেলনে বিপ্লব দেবের নাম মানিক সরকার এক বারও উচ্চারণ করেননি। রাজনৈতিক হিংসার মামলার ক্ষেত্রে শাসক ও বিরোধী দলের প্রতি পুলিশের দ্বিচারিতার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে মানিকবাবু রাজ্যের ডিজিপি, আইজি (আইনশৃঙ্খলা) বা স্বরাষ্ট্র সচিবকে জিজ্ঞাসা করতে বলেন। মুখ্যমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায় নিয়ে কোনও কথা বলেননি। দ্বিতীয়ত, ‘শান্তিরবাজার’ কাণ্ডের চতুর্থ দিন পর্যন্ত কোনও এফআইআর সংশ্লিষ্ট থানায় দায়ের করা হয়নি, জানিয়েছেন থানার আধিকারিক। আইন অনুসারে, কোনও থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক এফআইআর না নিলে তবেই জেলা সুপারের কাছে অভিযোগ করা যায়।