রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে’ (১৫-২) প্রসঙ্গে কিছু কথা। এই সমান্তরাল ব্যবস্থা আসলে বাজার অর্থনীতির অবদান। সমুদ্রযাত্রা থেকে ভুবনায়নের দাপট বাড়লে আন্তর্জাতিক বাজার প্রসারিত হয় ভারতে। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির প্রভাব কাটিয়ে স্বাধীন ভারত নিজেদের সংবিধান তৈরি করেছে গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক ও সাধারণতান্ত্রিক মতে। এটাই আপাতত ধরে নেওয়া যাক মূল ব্যবস্থা।
এর মধ্যে বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ঠান্ডা যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব চলছে। ফলে রাষ্ট্রের গঠন ও চরিত্র সর্বদাই বদলাচ্ছে। আশির দশকে আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থার বিবর্তনের মধ্যে অবধারিত ভাবে প্রবেশ করতেই হয় ভারতকে। শুরু হয় বাজার ব্যবস্থার মুখোশে বেসরকারিকরণ, বিরাষ্ট্রীয়করণ, বিলগ্নিকরণ যা আদতে বাজার ব্যবস্থার এক ক্ষতিকারক দিক এবং তা আজ ভারতের অর্থনীতির তথাকথিত ‘উন্নয়নশীল’ দুর্বল চরিত্রে প্রমাণিত। এটাই সমান্তরাল ব্যবস্থা। ভারতের শাসক রাজনীতি জানত বাজার ব্যবস্থার এই দুর্নীতিপরায়ণ চরিত্রের কথা। যে কারণেই হোক, আজকে ভারতে স্বঘোষিত স্বদেশবাদী গেরুয়া চরিত্রের রাষ্ট্রও অনেকটাই আত্মসমর্পণ করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে বাজার ব্যবস্থার দুষ্টচক্রে। এর ফলে বর্তমানে ইতিমধ্যে দুর্নীতি গভীর ও ব্যাপক ভাবে ঢুকে গিয়েছে যা লেখক নানা উদাহরণ-সহ লিখেছেন। ১৯৪৮-১৯৫৬, শিল্পনীতির মাধ্যমে মিশ্র অর্থনীতির চেহারায় দেখা গেল ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সখ্যে প্রাইভেট, পাবলিক ও জয়েন্ট সেক্টরের সহাবস্থান। প্রতিরক্ষা, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, খনি ইত্যাদি কিছু ক্ষেত্র থাকবে সরকারি আওতায়। আর আজ দেখা গেল সমান্তরাল ব্যবস্থাই প্রধান হয়ে উঠেছে। আর মূল ব্যবস্থাকে অপ্রয়োজনীয়, দুর্বল, অপাঙ্ক্তেয় করে দেওয়া হচ্ছে বাজার ব্যবস্থার প্রচারসর্বস্ব সর্বরোগহরা টনিকে। পৃথিবীতে আজ সবচেয়ে আশ্চর্য স্ববিরোধী ধাঁধা— নানা ভাবে ভারত রাষ্ট্রের সরকারি আইনসভায় নির্বাচিত শাসক প্রতিনিধিরাই পাকেপ্রকারে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত চরিত্রের বেসরকারিকরণ ও বিরাষ্ট্রীয়করণে মদত দিয়ে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রের শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে প্রতিরক্ষা, খনি, আর্থিক ক্ষেত্রের মতো কুশলী ক্ষেত্র আক্রান্ত। একই দিনে আবির্ভাব ভট্টাচার্যের ‘সমাধান হলে সমস্যা কোথায়’ (১৫-২) প্রবন্ধে স্পষ্ট, এক দিকে সরকার আছে, আবার সমান্তরাল এক ব্যবস্থা (‘দিদিকে বলো’, ‘দুয়ারে সরকার’ ইত্যাদি) সরকারি নির্দেশেই চালু হয়েছে। শাসন ব্যবস্থায় সেনা, পুলিশ, সিআরপিএফ, বিএসএফ থাকলে সিবিআই, ইডি ইত্যাদি এজেন্সির কী দরকার? যেমন সিভিক পুলিশ অপ্রয়োজনীয়।
আর যদি এই সমান্তরাল ব্যবস্থা এতই গুরুত্বপূর্ণ হয় তা হলে মূল ব্যবস্থায় এত মন্ত্রীর দরকার কী? দেশে দুর্নীতি বা দুরবস্থা কিছুই তো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
সয়ে গিয়েছে
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের শেষ অবধি আমি কয়েকটি কলেজে পর্যায়ক্রমে আংশিক সময়ের লেকচারার পদে কাজ করেছি। একটি স্কুলেও পড়ানোর সুযোগ ঘটে। ক্লাস করানো, খাতা দেখা, পরীক্ষার নজরদারি সবই করতে হয়েছে। চাকরি যাওয়ার ভয়ে পড়ানোর মানের দিকে আমাদের তীক্ষ্ণ নজর থাকত। প্রথমে ভাতা ছিল মাসে ১২৫ টাকা। পরে বেড়ে হয় ৪০০ টাকা। আন্দোলন হলেও বেতন বৃদ্ধি বা স্থায়ীকরণ কোনওটাই হয়নি। পরবর্তী কালে বেতন ভদ্রস্থ জায়গায় আসে। তথাপি বৈষম্য কমেনি। গৃহশিক্ষকতা করে জীবনধারণ করতাম। টিউশনির সুবাদেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতে আমার মতো অনেকেই সফল হয়ে স্থায়ী চাকরিতে যুক্ত হয়েছিলাম।
বর্তমানে আমার অবসর চলছে। এখনও ইগনু-তে পড়াই। এখানেও সমান্তরাল ব্যবস্থা। ক্লাস পিছু বেতন। তাও আবার ন্যূনতম পাঁচ জন ছাত্রের উপস্থিতি প্রয়োজন। এই ভাবে সমাজের বিভিন্ন কর্মস্থলে সমান্তরাল ব্যবস্থা চলছে। আমরা অনিচ্ছা সহকারে মেনেও নিচ্ছি। কারণ স্থায়ী চাকরি যেখানে নেই সেখানে এই সমান্তরাল ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে যা রোজগার হয় সেটাই ভাল। সংসারে কিছুটা অর্থের জোগান হবে। অর্থনীতিতে আবার সমান্তরাল অর্থনীতির আলাদা সংজ্ঞা আছে। সেটি হল— জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে কালো টাকার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। একেই বলে সমান্তরাল অর্থনীতি। এক শ্রেণির মানুষ কর দিতে হবে বলে এই আয় অবৈধ ভাবে সরকারি হিসাবের খাতায় দেখান না। বর্তমানে এ নিয়ে আর হইচই দেখি না। সবই গা-সহা হয়ে গিয়েছে।
সুদেব কুমার ঘোষ, সাহামাঠ, পশ্চিম মেদিনীপুর
ব্যয়সঙ্কোচন কেন
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা আগে বাসে টাঙানো থাকত। তাতে যাত্রীদের সঙ্গে কন্ডাক্টরের বচসার সুযোগ থাকত না। কিন্তু বিগত দশ বছরের বেশি সময় ধরে সরকার কোনও বাসের ভাড়া বাড়ায়নি বলে ভাড়া কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি। ট্যাক্সির ক্ষেত্রেও একই হাল, ভাড়া বাড়ানোর দায়িত্ব থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিল। ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকার স্থায়ী বন্দোবস্ত হাতে তুলে দিচ্ছে।
চুক্তিবদ্ধ কর্মীতে ভরে গিয়েছে জেলার বিভিন্ন অফিস। প্রশ্ন উঠতেই পারে এত ব্যয়সঙ্কোচন কেন, কোথায় যাচ্ছে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ? সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার অঙ্গন। গত এক দশকের বেশি সময় স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ, অথচ কালের নিয়মে শিক্ষক অবসর চলছে। শিক্ষকের অভাবে পড়াশোনা একেবারে শিকেয় ওঠার মতো। স্কুল কর্তৃপক্ষ সামান্য সামর্থ্যের মধ্যে কিছু চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করছেন। অনেক তরুণ-তরুণী সেই চাকরিই লুফে নিচ্ছেন।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
পশ্চাদ্গামী
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে’ প্রসঙ্গে জানাই, প্রশাসন ২০১৮-র পর থেকে বাস ভাড়া না বাড়ানোয় সরকারি পরিবহণ নিগমগুলির নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। অন্য দিকে, রাজ্যের গণপরিবহণের অধিকাংশের অংশীদার বেসরকারি বাসমালিকেরা ইচ্ছেমতো পাঁচের গুণিতকে ভাড়া আদায় করে চলেছেন। ভাড়ার তালিকা ঝুলিয়ে রাখার আর বালাই নেই। যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি, ডিজ়েলের চড়া দাম, আনুষঙ্গিক খরচ (টোল ট্যাক্স ইত্যাদি) প্রভৃতির কারণে সরকারি পরিবহণ নিগমগুলিতে খরচ ক্রমবর্ধমান, অথচ সরকার ভাড়া না বাড়ানোর নীতি নিয়েছে। অতএব, রাজস্ব নিম্নগামী। তদুপরি ঋণের বোঝায় এই নিগমগুলি ধুঁকছে। তেলের টাকা বাকি থাকায়, যন্ত্রাংশ কেনার অপারগতায় বাস রক্ষণাবেক্ষণ শিকেয়। ডিপোয় ডিপোয় বিকল বাসের জাদুঘর অতি পরিচিত দৃশ্য। স্থায়ী কর্মীদের অবসর গ্রহণের কারণে সামান্য বেতনের ঠিকাশ্রমিক দিয়ে বাস মেরামতির কাজ চলছে। বাস চালকদের সিংহভাগ এক দশক ধরে এজেন্সির অধীনে অল্প বেতনে কাজ করছেন।
বাস কন্ডাক্টরদের চালু সংলাপ, ‘পিছন দিকে এগিয়ে যান’। সেটাই এই সমান্তরাল সামগ্রিক অব্যবস্থাকেও ব্যাখ্যা করে।
ডি রাজশেখর, কলকাতা-১২২