‘অপরাজিতা বিল’ সম্পর্কে স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘পাশের আগেই ফেল’ (১১-৯) আলোচনাটি অনেক বিবেকবান মানুষকে বিলটি বুঝতে সাহায্য করবে। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে যখন উত্তাল গোটা দেশ, তখন হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপরাজিতা বিল আনলেন। এ কি তিলোত্তমার বিচার পাওয়ার ইঙ্গিত, না কি ক্রন্দনরত শিশুর হাতে ললিপপ ধরিয়ে দেওয়া? এ ভাবে কি খানিকটা ঠান্ডা করার চেষ্টা করা হল আন্দোলনকারীদের? তড়িঘড়ি পাশ-করানো এই বিলটিতে নতুন কিছু আছে কি? ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় আইনের কঠোরতাকেই বাড়ানো হয়েছে। আইনে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। অথচ, ১৯৮৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে ‘মিঠু বনাম স্টেট অব পঞ্জাব’ মামলায় শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছিল, অপরাধের সাজা হিসাবে যদি একমাত্র মৃত্যুদণ্ডের সংস্থান থাকে, তবে সেই আইন ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। তাই শেষ বিচারে অপরাজিতা বিল ধোপে টিকবে কি না, সে সন্দেহ থেকেই যায়। বিল কার্যকর করতে গেলে প্রয়োজন স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, বিচারক, মুহুরি, পেশকার। কেন্দ্রীয় পোর্টাল বলছে, এখনও ৮০,৫৬২টি ধর্ষণ মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। দেশে তো আইন কম নেই। ধর্ষণ, পাচার, বাল্যবিবাহ, গার্হস্থ নির্যাতন, পণপ্রথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে আইন আছে। নির্যাতিতারা খোরপোশ পাবেন, তারও আইন আছে।
কিন্তু জেলায় জেলায় জমছে মামলার পাহাড়। শুধু মুর্শিদাবাদ জেলাতেই ৫০ হাজারের বেশি মামলা জমে আছে। গরিব মেয়েরা ঘটি-বাটি বিক্রি করে উকিলের পয়সা সংগ্রহ করে বিচারের আশায় দিন-রাত কোর্টে ঘোরাঘুরি করেন, কিন্তু বিচারের দিন পড়ে কয়েক বছর পরে। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দ্রুত বিচারের দাবিতে জেলা বিচারকদের নিকট ডেপুটেশন দিলে তাঁরা জানান, বিচারকদের সংখ্যা খুব কম, তাই মামলা জমে যাচ্ছে। এ দায় কার? বিচারক নিয়োগ করবে কে? ২১ দিনে তদন্ত, দ্রুত বিচারের শেষে ধর্ষকের ফাঁসি, এ যেন গল্প। অপরাধীদের তো ধরাই হয় না, তার পর তো বিচার। যে ক্ষমতাবলে অপরাধীদের আড়াল করতে পারে সরকার, সেই ক্ষমতাবলেই অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে পারত না কি? বিচারের দাবিতে উত্তাল আন্দোলনের এতটুকু মর্যাদা কি দিতে পারত না রাজ্য সরকার? তাই অপরাজিতা বিলে জনগণের মনকে ভোলানো যাবে না। আগামীতে বিচারের দাবিতে আরও উত্তাল হয়ে উঠবে দেশ।
খাদিজা বানু, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
সদিচ্ছায় ঘাটতি
স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্ন যোগ করতেই এই চিঠি। আর জি করের ঘটনায় দোষীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে যখন গোটা সমাজ উত্তাল হয়ে উঠেছে, অপরাধীদের আড়াল করার দায়ে পুলিশ ও রাজ্য সরকারকে দুষছে জনগণ, তখন রাজ্য সরকার ‘অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল ২০২৪’ নিয়ে এল। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, সরকারের উদ্দেশ্য কী? এই বিলের কি সত্যিই কোনও প্রয়োজন ছিল? যে আইন ইতিমধ্যেই রয়েছে তাতেই কি দোষীকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায় না?
সরকারের আনা এই বিলের কঠোরতা কার বিরুদ্ধে— অপরাধী না অপরাধ? অপরাধীই কি এই বিলের লক্ষ্য? যদি তা-ই হয় তবে তো তিনিও জানেন, আর জি করের ঘটনা এই আইন হওয়ার আগে ঘটেছে। অতএব তা এই আইনের আওতার বাইরে। দ্বিতীয়ত, এক জন অপরাধীর যত দিনে ফাঁসি হবে, তত দিনে আরও অনেকগুলি অপরাধের ঘটনা ঘটে যাবে। অথচ, যে সামাজিক পরিবেশ প্রতি মুহূর্তে সমাজে এমন অসংখ্য অপরাধীর জন্ম দিয়ে চলেছে, সেই পরিবেশকে বদলানোর কোনও কথা সরকারের ভাবনাতেও নেই, আইনেও নেই। সরকারের রাজ্যপাট চালানোর গোটা প্রক্রিয়াতেই তা নেই। বরং তাঁদের শাসন-নীতিই অপরাধী তৈরি হওয়ার জমি ক্রমেই উর্বর করে চলেছে।
সত্যিই কি অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া এই আইনের লক্ষ্য? প্রথম থেকেই আর জি করের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার চেষ্টা প্রশাসনের সমস্ত স্তরে প্রকট। চিকিৎসকের মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালানোর চেষ্টা, এফআইআর করতে অযথা দেরি করা, অধ্যক্ষকে অতি দ্রুত আর একটি মেডিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগপত্র দেওয়া, মৃতদেহ যেখানে পাওয়া যায় সেই সেমিনার রুম সংলগ্ন অংশ অতি দ্রুততায় ভেঙে ফেলা, বহিরাগত দুষ্কৃতীদের দ্বারা আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের মঞ্চ ও হাসপাতালে ভাঙচুর আটকাতে এবং তাদের পিছনে আসল মাথাগুলিকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হওয়া— এ সব ঘটনার কোনওটিই সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ নয়। পার্ক স্ট্রিট-কামদুনি-কাটোয়ার ধর্ষণের ঘটনাগুলির কোনওটিতেই সরকারের এই আগ্রহ প্রকাশ পায়নি। পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে মুখ্যমন্ত্রী এক কথায় তাকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। পরে তদন্তে ধর্ষণের প্রমাণ মিললে তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসারকে অন্যত্র বদলি করে দিয়েছেন। কামদুনির ঘটনায় প্রতিবাদকারীদের ‘মাওবাদী’ বলে ধমক দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে কাটোয়ায় ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে, ঘটনাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছিলেন, মহিলার স্বামী বিরোধী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। হাঁসখালির ঘটনাতেও ধর্ষণকে লঘু করে দেখাতে তিনি বলেছিলেন, মেয়েটির সঙ্গে ধর্ষকের প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
ধর্ষণের এই ঘটনাগুলির কোনওটিতেই মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যান্য নেতার আচরণে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার মনোভাব প্রকাশ পায়নি। সমাজ পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে যে কারণগুলি— যেমন, মদের ঢালাও লাইসেন্স, পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি, সরকার ও শাসক দলের উচ্চস্তর থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত দুর্নীতি— সেগুলি প্রকারান্তরে ধর্ষণের মতো ঘটনাকে বাড়িয়ে তুলতেই সাহায্য করছে। এগুলির কোনওটির বিরুদ্ধেই তৃণমূল নেতৃত্বকে কার্যকর পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। তা হলে হঠাৎ আর জি করের ঘটনায় পর তড়িঘড়ি আইন আনার উদ্দেশ্য যে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দেওয়া, এ কথা মানুষ বিশ্বাস করবেন কী করে?
সমর মিত্র, কলকাতা-৩১
হতাশার ফল
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার তড়িঘড়ি করে ডাকা অধিবেশনে ধর্ষণ বিরোধী বিল ‘অপরাজিতা’ পাশ হয়। ধর্ষিত হয়ে কোনও নারী মারা গেলে বিলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এক তরুণী চিকিৎসককে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ ও হত্যার পর পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তা চাপা দিতে এ একটা রাজনৈতিক কৌশল। বিলটি এসেছে জনতার প্রতিবাদের পর। জনসাধারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে ন্যায়বিচার ও দায়বদ্ধতা দাবি করছে। রাজ্যের মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা এই কারণে ক্ষুব্ধ, যে রাজ্যে এক জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, সেই রাজ্যের সরকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সততার সঙ্গে জবাব দেয়নি।
অপরাজিতা বিল ভারতের জাতীয় ফৌজদারি আইনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র সরকারের অনুরূপ বিল আরও আগে পাশ করা হলেও, রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য এখনও অপেক্ষা করছে। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে মৃত্যুদণ্ড এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। এ ধরনের দ্রুত শাস্তি মানবাধিকারের পরিপন্থী বলে অভিহিত করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। সেই কারণেই মনে হচ্ছে, এই বিল পাশ তৃণমূল সরকারের হতাশা থেকে জন্ম নেওয়া একটি পদক্ষেপ। সময়ই বলে দেবে বিলটি আইন হওয়ার পর কোনও পরিবর্তন আনবে, না কি ভারতে অগণিত আইনের দীর্ঘ তালিকায় যোগ হবে।
অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর