সংরক্ষণের সুবিধাভোগ
• ‘সংরক্ষণ কেন’ (৮-১) এবং ‘তাই সংরক্ষণ’ (১৭-১) দুটি চিঠিতেই একপেশে যুক্তি খাড়া করা হয়েছে। কারও জন্য সংরক্ষণ প্রয়োজন নেই এ কথা মানা যায় না। কারণ দলিতদের একটা বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে সংরক্ষণের বিশেষ কোনও সুবিধা এখনও পর্যন্ত পৌঁছয়নি। তাঁরা এখনও অশিক্ষা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে আছেন। তাঁদের জন্য এখনও সংরক্ষণ প্রয়োজন। তাই ওই সব গোষ্ঠীর সামনের সারির মানুষদের বাদ দিয়ে বাকিদের জন্য সংরক্ষণ চালু হলে, পিছনের সারির মানুষের কিছু উপকার হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। আমরা সকলেই জানি, সংরক্ষণের সুবিধার বেশির ভাগটাই কারা নিচ্ছেন। আমার জানা অনেক পরিবার আছে, যাদের বাড়ির সকলে সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে বংশানুক্রমে চাকরি পেয়ে চলেছে। আর তাদের বাড়ির কাজের মেয়েটি কিংবা কাজের লোকটি স্কুলে যাননি। ভাল চাকরির সম্ভাবনা তো অনেক দূর। তাই শত শত বছর সংরক্ষণ চালু থাকলেও ওই রামা কৈবর্তদের সমস্যা সমাধানের আশা নেই। কারণ তাঁদের গোষ্ঠীর সামনের সারির ‘সুবিধাভোগী’ শ্রেণি সব সময় তাঁদের ভাগ ছিনিয়ে নেবে।
প্রদ্যোত পালুই
বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
নরম বা গরম
• সেমন্তী ঘোষের লেখার (‘ফাঁদে পা না দিলে...’, ৭-১২) পরিপ্রেক্ষিতে তমালকান্তি দে তাঁর চিঠিতে প্রশ্ন করেছেন, ‘নরম হিন্দুত্ব খারাপ?’ (সম্পাদক সমীপেষু, ১১-১) প্রশ্নটা নরম বা গরমের নয়। প্রশ্ন হল, গণতান্ত্রিক রাজনীতির মঞ্চে ধর্মকে টেনে আনা হবে কেন? টেনে আনা হলে অনিবার্য ভাবে যা ঘটবে তার ইঙ্গিত অরুণ জেটলির সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্যেই রয়েছে: ‘হিন্দুত্বপন্থী দল বলে তো বিজেপিই পরিচিত। আসল ছেড়ে নকলকে (রাহুল তথা কংগ্রেসকে) কেন ভরসা করবেন মানুষ?’ বস্তুত রাহুল গাঁধীর প্রয়াত পিতা রাজীব গাঁধীই নরম হিন্দুত্বের তাস খেলতে গিয়ে চরম হিন্দুত্বের পথ প্রশস্ত করেছেন। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পর ১৯৮৫ সালে বাবরি মসজিদের জংধরা তালা ভেঙে পূজাপাঠের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে কার্যত ‘প্যান্ডোরার বাক্স’টিকেই খুলে দিয়েছিলেন। রাহুলজির নরম হিন্দুত্বের সাফাই দিতে গিয়ে পত্রলেখক লিখেছেন, ‘মহাত্মা গাঁধীও স্বাধীনতা সংগ্রামে আপামর ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে হিন্দুধর্মীয় বিভিন্ন প্রতীক ও রূপক ব্যবহার করেছেন।’ সেটাই তো এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে শোচনীয় দুর্বলতা বা ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি। খুব সঙ্গত কারণেই গাঁধীজির রামধনু সংগীতে গলা মেলাতে পারেনি এ দেশের বৃহত্তর মুসলিম সমাজ। বরং হিন্দুধর্মীয় বিভিন্ন ‘প্রতীক’-এর প্রতিক্রিয়ায় পরিপুষ্ট হয়েছে ধূর্ত ব্রিটিশের বিভেদনীতি।
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
বিবেকানন্দ পল্লি, বহরমপুর
দেউলিয়াপনা
• তমালকান্তি দে তাঁর চিঠিতে গুজরাত নির্বাচনের সময় রাহুল গাঁধীর বিভিন্ন হিন্দু মন্দির দর্শন ও নিজেকে পৈতেধারী হিন্দু দাবি করাকে সমর্থন করেছেন। লিখেছেন, ‘যে কেউ অন্য ধর্মের বিরোধী না হয়েও হিন্দু হতে পারেন এবং হিন্দু হওয়াটা কোনও লজ্জা বা অগৌরবের বিষয়ও নয়।’ ঠিক কথা। কিন্তু রাহুল গাঁধী যখন নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সমালোচনা করে মানুষের কাছে যাচ্ছেন, ‘অচ্ছে দিন’-এর চুপসে যাওয়া ফানুসের সামনে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে যথার্থ সুদিন এনে দেওয়ার লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন তিনি আর নিছক ‘যে কেউ’ নন। তিনি সেখানে নিজেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনসাধারণের নেতা হিসেবে, অদূর ভবিষ্যতের সুযোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরছেন। যিনি ক্ষমতায় এলেই নাকি এই ধর্মীয় হানাহানির অমানিশা কেটে গিয়ে ভারতের ভাগ্যাকাশে উন্নয়নের সূর্য উঠবে। সেখানে একটি বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের পরিচয়ের প্রয়োজন তাঁর হবে কেন?
ব্যক্তি রাহুল গাঁধী হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী হতে পারেন, কিন্তু দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে যদি তিনি সত্যিই চিন্তিত হতেন তা হলে বিজেপির বিরোধিতা করতে নেমে, ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে, অশিক্ষা, দারিদ্র, বেকারির মতো আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়েই কথা বলতেন। সংবাদমাধ্যমের সামনে ‘আমিও কিছু কম হিন্দু নই’ গোছের প্রমাণ দিতে ব্যস্ত হতেন না। লেখক উদার হিন্দুধর্মের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু উদার হিন্দু হওয়ার জন্য নিজেকে হিন্দু বলে দাবি করা বা পৈতে দেখিয়ে প্রচার করার দরকার পড়ে কি? মুসলিম ভোটব্যাংকের দিকে তাকিয়ে মাথায় ফেজ টুপি পরে নমাজে যোগ দেওয়া অথবা ভোটের আগে নিজেকে হিন্দু বোঝাতে তিলক কেটে মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বেড়ানো— এগুলো সবই রাজনীতির আদর্শগত দেউলিয়াপনার নিদর্শন।
পত্রলেখক মহাত্মা গাঁধীর হিন্দুধর্মীয় প্রতীক ও রূপক ব্যবহারের প্রসঙ্গ এনেছেন। গাঁধীজিসহ কংগ্রেসের নেতারা বরাবর এমনটা করে এসেছেন বলেই ক্রমশ অনিবার্য হয়েছে দেশভাগ। সেই সংকটকালে গভীর ব্যথায় গাঁধীজি বলেছেন, ‘আজ আমি একা। এমনকী সর্দার (বল্লভভাই প্যাটেল) এবং জওহরলালও মনে করছেন যে, আমি অবস্থার যে বিশ্লেষণ করছি, তা ভুল এবং দেশ বিভাগ স্বীকার করে নিলে শান্তি ফিরে আসবে... আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, এ মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকারময়’।
অন্য দিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে ধর্মের ঊর্ধ্বে রাখার। আজাদ হিন্দ ফৌজে সর্বধর্মসমন্বয়ের গান প্রসঙ্গে আবিদ হাসানকে তিনি বলেছেন, ‘শোনো, একটা কথা তোমাকে খুব স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি। আমাদের কাজকর্মের সঙ্গে কিছুতেই ধর্মকে মেশাতে দেব না আমি। আমাদের সব কিছুরই একমাত্র ভিত্তি হল জাতীয়তাবাদ। তুমি ওদের ধর্মের নামে এক করতে চাও? তাই যদি হয়, তা হলে এক দিন ধর্মের নামে ওরা আবার আলাদা হয়ে যাবে’।
সঙ্ঘমিত্রা চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা-৭৭
ধর্মরক্ষা
• সহজ সরল বিষয়কে জটিল ভাবে ভাবার বিলাসিতাকেই ‘দর্শনশাস্ত্র’ বলে মনে করা আমার মতো অর্ধ-অশিক্ষিত মানুষের পক্ষে, দর্শনের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় অরিন্দম চক্রবর্তীর ‘ধর্মরক্ষার মানেটা বুঝতে হবে’ শীর্ষক নিবন্ধটি (১০-১) সম্পর্কে কিছু লেখাটাই অর্বাচীনের কাজ হবে জেনেও লিখছি। তিনি লিখেছেন, ‘প্রকৃত ধার্মিক মন্দির রক্ষার জন্য, নির্মাণের জন্য, হিংসা করবে না। তাতে একটাও হিন্দু মন্দির যদি না থাকে, তা-ও ভাল।’ কল্পিত ‘ঈশ্বর’-কেন্দ্রিক প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অবসানকামী এক জন সাধারণ পাঠক হিসেবে মনে হল, তিনি ‘প্রকৃত ধার্মিক’ অভিধাটির প্রয়োগে ধর্মরক্ষার মানেটা যে ভাবে বুঝিয়েছেন, তাতে ‘ধর্ম’ রক্ষা হলেও লেখকের ধর্মদর্শিতায় একটু হলেও টাল খেয়েছে। অরিন্দমবাবুর ‘প্রকৃত ধার্মিক’-এর অনুসারে ‘প্রকৃত চোর’ হলে কিছুতেই ধরা পড়ত না জাতীয় কথা বলে চৌর্যবৃত্তিকেও রক্ষা করা যায়। কারণ, ‘প্রকৃত’ বিষেশণটির তো কোনও নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই, যে কোনও পেশা, আদর্শ ও মতবাদের ক্ষেত্রে। ‘প্রকৃত’ কথাটি তো এ ক্ষেত্রে একটা আড়াল।
এমন বাক্ছলনা কিংবা আড়ালের দ্বারা ধর্মীয় সংস্কৃতির আদিকাল থেকে ‘ধর্ম’কে রক্ষা করার ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। মহৎ ও আদর্শ ধার্মিকের ধারণা নির্মাণ করে এবং তার সুখপাঠ্য ব্যাখ্যার দ্বারা সেই মহাভারতের কাল থেকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস পর্যন্ত অগণিত হিংসাশ্রয়ী ঘটনার একটিও রোধ করা তো যায়ইনি। উলটে আদর্শচ্যুতকে ‘অধার্মিক’ তকমা দিয়ে অসংখ্য অসংগতি থাকা সত্ত্বেও ‘ধর্ম’কেই শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকিয়ে রাখার কাজে আরও অনেক প্রাজ্ঞজনের মতো লেখকও নিজেকে শামিল করেছেন।
কৃষ্ণ ঘোষ
সুভাষপল্লি, পশ্চিম মেদিনীপুর
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়