Hindutva Politics

সম্পাদক সমীপেষু: বিভ্রমের বিরুদ্ধে

বঙ্গভঙ্গের চেষ্টা করে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ পুঁতে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরাই। জন্ম দিয়ে গিয়েছিল মুসলিম লীগের (১৯০৬)। তারই প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হল হিন্দু মহাসভা (১৯১৫)। শুধু কি তাই?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৪ ০৬:০৬
Share:

ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধ “‘যা হচ্ছে, ঠিক হচ্ছে’?” (১৩-৫) নিঃসন্দেহে এ রাজ্যের সমাজসচেতন নাগরিকের বিবেকে ঘা দিতে সমর্থ। সত্যিই তো, গলা ফুলিয়ে বলার অধিকার আজ আমরা হারিয়েছি, “হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো।” উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভাবনা এ রাজ্যে ক্রমশ স্থান করে নিতে পারছে। বাঙালিরাও সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টভঙ্গি অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। প্রবন্ধকারের আফসোস এইখানেই।

Advertisement

কিন্তু এই পরিস্থিতি কি আকস্মিক? বঙ্গভঙ্গের চেষ্টা করে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ পুঁতে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরাই। জন্ম দিয়ে গিয়েছিল মুসলিম লীগের (১৯০৬)। তারই প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হল হিন্দু মহাসভা (১৯১৫)। শুধু কি তাই? জাতীয়তাবাদী নেতাদের মননের গভীরে সুপ্ত ছিল হিন্দু চেতনা। এমনকি ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’— এমন ভাবনার অধিকারী বিপ্লবীরাও এর থেকে মুক্ত হতে পারেননি।

এ ইতিহাস ভুল গেলে চলবে না। এই ধারায় ব্যতিক্রমী ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজির প্রতিষ্ঠিত আজ়াদ হিন্দ সরকারের জাতীয়তাবাদী প্রেরণার মূলে ছিল না কোনও ধর্ম। কারণ, তিনি গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন, ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠন হয় না। ধর্মাচরণ হোক ব্যক্তিগত জীবনচর্যায়, রাষ্ট্রীয় জীবনে তার কোনও ছায়া যেন না পড়ে, এই ছিল সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি। ভারতে কি এমন ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা হয়েছে? সমস্ত ধর্মকে সমান উৎসাহ দানের কথা বলা হয়ে থাকে। যদিও বাস্তবে তা যে হয় না, তা কেন্দ্রে অতীতের কংগ্রেস সরকার এবং ক্ষমতাসীন বর্তমান বিজেপি সরকারকে দেখে যথার্থ বোঝা যায়। তবে এর জন্য হতাশার কারণ নেই। এখনও বাঙালি মনন থেকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শরৎ, সুভাষ, নজরুলের মতো মহাপুরুষেরা একেবারে মুছে যাননি।

Advertisement

বড় বড় শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষাই সাধারণত শাসকদের কাজ। অতিমারি পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকেরা রাস্তায় রাস্তায় বেঘোরে মারা গিয়েছেন। চাষিরা ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সমস্ত দ্রব্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু শিল্পপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি অব্যাহত। আর দুর্নীতির শিখরে বসে এঁদের পৃষ্ঠপোষকরাই দেশের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে। এই বিভ্রমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে জাতিধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে। কারণ আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর যারা এই কদর্য খেলার স্রষ্টা, তারা সংখ্যালঘু। এই উপলব্ধির দিন আজ উপস্থিত।

তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা-১২

মোদীর বচন

নরেন্দ্র মোদীর ‘অপশাসন থেকে নজর ঘোরাতেই হিন্দি বলয়ের দল বলে: মোদী’ (৮-৫) শীর্ষক যে সাক্ষাৎকার এই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটি অভিযোগই তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে নস্যাৎ করেছেন। প্রথমেই শিল্পায়নে পূর্ব ভারত পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে তিনি দু’টি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন— উন্নয়ন বিরোধী রাজনীতি এবং প্রশাসনের খামতি। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, কোনও সরকারের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে এই কথাগুলোর ব্যবহার বহুচর্চিত। কথাগুলি আংশিক সত্য হলেও, সেটাই একমাত্র কারণ নয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই একই দোষে দুষ্ট। লোকসভা নির্বাচনে প্রচারের ক্ষেত্রে তা আড়াল করার জন্য, ধর্মীয় মেরুকরণের নেতিবাচক পথকেই প্রাধান্য দিয়েছে। গ্রামে বিদ্যুতের জোগান, সড়ক, রেল ও বন্দরের পরিকাঠামোর জোগান প্রভৃতির জন্য বিরাট কোনও কৃতিত্ব নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের আর্থিক উন্নতির অভাবের জন্য তৃণমূল দায়ী হলে, বিজেপিকেও সমান ভাবে দায়ী করা চলে। ছোট ও মাঝারি শিল্পের দিকে নজর না দেওয়া, শ্রমিক-বিরোধী শিল্প আইন চালু করা এবং মুষ্টিমেয় শিল্পপতিদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনৈতিক ভাবে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া, এমন অনেক অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। শিল্পপতিদের ১৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুবের মাধ্যমে আত্মনির্ভরতা দানের অভিযোগের তিরও ধেয়ে এসেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে। এতে দেশে যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব, খর্ব হচ্ছে শ্রমিকের অধিকার, তেমনই ওষুধ-সমেত অন্যান্য অনেক পণ্যের অযৌক্তিক দাম ও গুণগত মান নিয়েও আপসের অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন দিক থেকে।

দুর্নীতির অভিযোগ থাকা নেতাদের দলে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, বিজেপিতে সম্প্রতি যোগ দেওয়া কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি তদন্ত বা মামলাও বন্ধ করা হয়নি। এই কথার মাধ্যমে তিনি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের কথাতেই চলে। আবার মামলা জিইয়ে রাখার অর্থ, দলবদলকারী নেতাকে বাগে রেখে অন্য দলে পুনরায় ফেরত যাওয়ার রাস্তা এক প্রকার বন্ধ করে দেওয়া।

সন্দেশখালির যে অভিযোগ নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়, সেটা রাজ্যের শাসক দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিজেপির কাছে সুবিধাজনক মনে হতেই পারে। কিন্তু মণিপুর, হাথরস কিংবা মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থার অভিযোগের সঠিক উত্তর প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে বলে মনে হয় না।

সাধারণ মানুষ চান রুটি, রুজির সংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার। প্রধানমন্ত্রী যদি শুধুমাত্র এগুলিকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখেন, তবে দেশের সঙ্গে তাঁর দলেরও যে আগামী দিনে ভিত মজবুত হবে, এ কথা বলা যায়।

অশোক দাশ,রিষড়া, হুগলি

বদলের ইঙ্গিত

শ্রীমন্তী রায় তাঁর ‘আহা রে, বেচারা পুরুষ’ (২৮-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, পুরুষত্বের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা হয় না। সমাজ, দেশ, কালের উপর ভিত্তি করে পাল্টাতে থাকে পুরুষত্বের ধরন। যে পুরুষ এক দিন সমাজে নিজেদের অবস্থান নিয়ে গর্ব করত, আজ তারাও অত্যাচারিত, যা নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ চিন্তিত। এনসিআরবি রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৩৩ জন, যার মধ্যে বিবাহিত ৮১,০৬৩। প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজের চিরাচরিত প্রথার দৌলতে পুরুষ নিজেকে শক্তিশালী একচ্ছত্র বলে দাবি করলেও পরবর্তী কালে তার জীবনপ্রবাহ অন্য খাতে বয়। আসলে সংসার এমন এক ‘সিস্টেম’, যেখানে সময়ের সঙ্গে এক জনের রূপান্তর ঘটে যায়। এ ক্ষেত্রে শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ নাটকের ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে।

যে লিঙ্গ মানুষের পরিচয় বহন করে, আজ বিবর্তনের ধারাতে মানুষের সেই লিঙ্গ পরিচিতি অনিশ্চিত। শরীর-মন চাইলে মানুষ নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করছে। রাষ্ট্র যে পুরুষালি ভঙ্গি নিয়ে অহঙ্কার করে, তা নেহাতই তার বহু প্রাচীন চিন্তার ফসল। বর্তমান ভারতে দেখা যায় মণিপুর থেকে সন্দেশখালি— প্রতিবাদের ক্ষেত্রে সর্বত্র নারীর দাপট। চলতি নির্বাচনেও তাই মহিলারাই হয়ে উঠেছেন প্রধান ফ্যাক্টর। নরেন্দ্র মোদী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— সকলেই মহিলাদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। জেলা আদালতে শতকরা ৭০ ভাগই মহিলা। শেখ হাসিনা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— সবাই নির্ভীকতার মতো ‘পুরুষালি’ গুণের অধিকারী হয়ে প্রশাসন চালাচ্ছেন। আসলে, সময়ই এক জন মানুষকে মেয়েলি থেকে পুরুষালি আবার পুরুষালি থেকে মেয়েলি করে তোলে। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজ লিঙ্গের পরিচয় ঘটলে, তবেই প্রকৃত বৈশিষ্ট্যের জন্ম হয়।

সচেতন পুরুষ নিজেও বুঝতে পারছে তার একাধিপত্য ক্রমশ কমছে। আধুনিকতায় তাই কটাক্ষ করা উচিত নয়, বরং উদারতা দিয়ে এ সব পরিবর্তন গ্রহণ করা উচিত।

তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement