‘নিজের গলাটা ছাড়তে হবে’, (৩১-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে সেমন্তী ঘোষের অভিমত, নিজের মতো চলার রাজনীতিটা পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষ অনেকের চেয়ে ভাল জানেন। সত্যিই কি তাই? সামাজিক কাজের সূত্রে নানা জেলায় ঘোরার পরে আমার মনে হয়েছে, এই প্রতিবাদী আন্দোলন মূলত শহর-শহরতলির। কিছু অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বিষয়টিকে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হিসাবে নিয়েছেন। ভুলে গেলে চলবে না যে, এই প্রতিবাদের পিছনে মিডিয়া ও সমাজমাধ্যমগুলির ভূমিকাও যথেষ্ট। শুনতে অপ্রিয় লাগলেও বিষয়টার মধ্যে যতটা না আবেগ সঞ্চারিত হয়েছে, তার চেয়ে হুজুগেপনাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বত্র। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলছে, মোমবাতি ও মোবাইল হাতে ‘রাত দখল’ উৎসবে দুঃখজনক পরিপ্রেক্ষিত আড়ালে চলে গিয়েছে বহু ক্ষেত্রেই, ভিডিয়ো আর সেল্ফি তোলার ব্যস্ততাই বেশি।
এক জন মহিলা-চিকিৎসকের নৃশংস মৃত্যু যতই ঘৃণ্য বলে বিবেচিত হোক, অন্য অনেক উদাহরণ সরিয়ে রেখেও ২০১৩ সালের কামদুনির কলেজ-ছাত্রীর অপহরণ, গণধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা নৃশংসতার নিরিখে কিছু মাত্রায় কম ছিল না। এবং সে ক্ষেত্রেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঠিক কী ভূমিকা নিয়েছিলেন, সে-কথাও আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাইনি। তবে বাস্তবিক অর্থে তফাতটা হল— আর জি করের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে অভিজাত, উচ্চবিত্ত চিকিৎসকদের আবেগ। আর কামদুনিতে অপরাধ ঘটেছিল একটি সাধারণ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের উপর। অতি দুর্বিষহ, দুঃখজনক হলেও সেই ঘটনার আখ্যান সমাজকে সে ভাবে নাড়িয়ে দিতে পারেনি।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের ছবিটাকে সামনে রেখে একটা খোয়াব দেখার মানসিকতাও এখানে প্রচ্ছন্ন ভাবে কাজ করছে, তা অস্বীকার করা সহজ নয়। বিশেষত দীর্ঘ দিন ‘শূন্য’ আসনে অবস্থান করা সিপিএম— যারা হারানো রাজ্যের ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া। আশানুরূপ আসন লাভে ব্যর্থ বিজেপিও চাইছে, পশ্চিমবঙ্গের শাসকের গদিটা যে-কোনও উপায়ে উল্টে দিতে। আমরা যেন ভুলে না যাই, রাজ্যের সমস্ত জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততার ছবি কিন্তু সে ভাবে প্রতিফলিত হয়নি, যা জনজাগরণ বা গণ-অভ্যুত্থানের সমার্থক।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
অবিচ্ছিন্ন
সেমন্তী ঘোষের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে আমার কিছু নিবেদন। আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে নাগরিক সমাজ উত্তাল। এটার পিছনে আছে দীর্ঘ দিন ধরে চলা শাসকের নানা দুর্নীতি— স্কুলে নিয়োগ, রেশন, কয়লা, বালি, গরু পাচার, একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, প্রভৃতি প্রকল্পে। সন্দেশখালিতে নারী-নির্যাতনেও ক্ষোভ ঘনিয়েছিল। এই প্রতিবাদ তারই বহিঃপ্রকাশ। এই আন্দোলনকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ‘রাম-বামের চক্রান্ত’ বলে অভিহিত করলেন, তা কি রাজনীতি নয়? যে সব নাগরিক আজ দাবি করছেন যে, রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের যোগ নেই, তাঁদের কাছে সবিনয় নিবেদন, আমরা সত্যিই কি রাজনীতি-নিরপেক্ষ? প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আমরা কি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই? যদি আমরা রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন না হই, তবে এই অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে আজকের জনরোষকে সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। না হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
সারনাথ হাজরা, হাওড়া
দলবিহীন
‘নিজের গলাটা ছাড়তে হবে’ খুব তাৎপর্যপূর্ণ। আর জি কর কাণ্ডের পর এই রাজ্যে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অপশাসন ও দুর্নীতি মানুষের মনে তুমুল ক্ষোভ ও তীব্র হতাশার জন্ম দিয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। আর জি করের ঘটনাতে সরকারের সন্দেহজনক ভূমিকা সাধারণ মানুষের ক্ষোভে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।
এই নির্মম ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা সাধারণ লোক মেনে নিতে পারেননি। সত্য প্রকাশ ও ন্যায়বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে প্রতিবাদের এই রূপ এর আগে এই রাজ্য কখনও দেখেনি। এই ক্ষোভের মুখে রাজ্য সরকারের যতটা নমনীয় হওয়া উচিত ছিল, তা হতে আমরা দেখিনি। সে জন্যও সাধারণ লোক রাজ্য সরকারের ভূমিকাকে আরও সন্দেহের চোখে দেখেছে।
প্রবন্ধকার শুধু রাজ্য সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেননি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য অন্য রাজ্যে, ও কেন্দ্রীয় স্তরে যে সব পদক্ষেপ করা হয়েছে, সেগুলির তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন। এই পদক্ষেপগুলি গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী। মহারাষ্ট্রের বদলাপুরের স্কুলে দু’জন শিশুর উপর নিগ্রহকে প্রশাসন চেপে যেতে চায়, এবং প্রতিবাদীদের বিপক্ষে নানা মামলা রুজু করা হয়। উত্তরপ্রদেশের একটি ঘটনায় দুই দলিত কিশোরী জন্মাষ্টমীর রাতে পুজো দিতে বেরোয়, পরের দিন গাছের উপর তাদের ঝুলন্ত মৃতদেহ চোখে পড়ে। সেখানকার প্রশাসন এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে। সারা দেশেই প্রশাসন নারীদের উপর অন্যায় অত্যাচারকে চেপে যেতে চেষ্টা করে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে, বা কায়েমি স্বার্থকে বাঁচাতে। এ রাজ্যে আমরা দেখেছি প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আর জি কর কাণ্ডের গণ-আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে নেমেছে। সাধারণ মানুষের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ, কিন্তু তার পটভূমিকায় নবান্ন অভিযান ও বাংলা বন্ধের ডাক দিয়ে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা দেখা গিয়েছে।
আর জি কর কাণ্ড সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। এই পাশাপাশি আসা, এক সঙ্গে পথে নামা এক ধরনের অভিনব দলবিহীন রাজনীতি, যা প্রচলিত দলভিত্তিক রাজনীতির বৃত্তের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ‘যৌবন জলতরঙ্গ’ রোধ করার বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা শাসক বা বিরোধী, কোনও দলের নেই। এই জনজাগরণ রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে কোন খাতে প্রবাহিত করে, তা দেখার জন্য এখন আমরা অপেক্ষা করব।
সরোজ উপাধ্যায়, কলকাতা-৫০
নবজাগরণ
সেমন্তী ঘোষ আমাদের এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন। গত ৯ অগস্টের ওই নৃশংস ঘটনার পর সমাজের বিভিন্ন স্তরের, পেশার এবং বয়সের মানুষজনের প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়, সারা দেশে, এমনকি বিদেশেও। এই সম্মিলিত প্রতিবাদ কি রাজনৈতিক, না কি অরাজনৈতিক? এই লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাঁরা দিনে এবং রাতে মিছিল করে, রাস্তার উপর বসে তাঁদের প্রতিবাদ উচ্চারিত করছেন, এঁরা প্রত্যেকেই এক-এক জন আলাদা ব্যক্তিসত্তা। প্রত্যেকের মধ্যেই এক সুপ্ত রাজনৈতিক সত্তা বর্তমান। কেউ সেটাকে নিজের পেশা হিসাবে বেছে নেন, আবার কেউ অন্য পেশায় নিযুক্ত হন। তথাপি এই রাজনৈতিক সত্তাটির অস্তিত্ব বিলোপ হয় না। শাসকের পক্ষ থেকে যখন অন্যায়, দুর্নীতি মানুষের সহ্যের সীমা পার হয়ে যায়, তখনই জনসাধারণের ভিতরের সুপ্ত রাজনৈতিক সত্তাটি প্রতিবাদরূপে বেরিয়ে আসে।
সাধারণ মানুষ কিন্তু কখনও দেশ, রাজ্য ইত্যাদি বিষয়ে ঔৎসুক্যহীন থাকে না। আমরা নানা সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমের মধ্য দিয়ে খবর রাখি, এবং ট্রেনে-বাসে যাতায়াতের সময়, চায়ের দোকানে আড্ডার সময় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনা নিজের মতো বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। কিন্তু যখন কোনও নৃশংস ঘটনার পরে দেখা যায় যে, সরকার অপরাধীদের সাজা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের আড়াল করার চেষ্টা করছে, তখনই মানুষের ভয়, ক্রোধ এবং ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫