Politics And Corruption

সম্পাদক সমীপেষু: সোনার পাথরবাটি

শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে জনসমর্থন আদায় করে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসার কিছু দিনের মধ্যে তারাও আবার দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:৫০
Share:

তৃণাঞ্জন চক্রবর্তীর ‘দুর্নীতি বিদায়ের রাজনীতি’ (১৫-১১) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বর্তমানে রাজনীতি আর দুর্নীতি একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে জনসমর্থন আদায় করে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসার কিছু দিনের মধ্যে তারাও আবার দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক নেতাদের (ডান ও বাম) সাদাসিধে এবং আটপৌরে জীবন সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করত। রাজনীতি ছিল আদর্শ ও মূল্যবোধ নির্ভর। সমাজের শিক্ষিত ও বিশিষ্টজনেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে নেতৃত্ব দিতেন। সেই কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের নেতৃত্বে জোরদার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আন্দোলন গড়ে উঠত। রাজনীতিটা তখনও পেশা হয়ে যায়নি।

Advertisement

আর এখন রাজনীতি পুঁজিবিহীন লাভজনক পেশা। সেই কারণেই দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী। প্রবন্ধে ঠিকই উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্নীতিকে সমূলে উৎখাত করতে গেলে উৎপাদনের সুষম বণ্টনের প্রয়োজন। প্রশ্ন এখানেই বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা কে বাঁধবে? যে পুঁজিবাদী সমাজে আমরা বাস করি সেখানে সম্পদের সুষম বণ্টন কথাটা অনেকটা ‘সোনার পাথরবাটি’র মতো। সুতরাং সৎ এবং দক্ষ নেতাদের দ্বারা পরিচালিত সরকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারলেও, এই সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতিকে সমূলে উৎখাত করা অত্যন্ত দুরূহ।

শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি

Advertisement

প্রকৃত দায়ী

‘দুর্নীতি বিদায়ের রাজনীতি’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকারের সঙ্গে কিছু মতপার্থক্য রয়ে গেল। তাঁর বক্তব্য, অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা নিম্ন আয়ের কর্মচারীর বেশি। কিন্তু, সমাজ জুড়ে আজ দুর্নীতির যে বিরাট রমরমা তার জন্য নিম্ন আয়ের মানুষ কতটুকু দায়ী? প্রবন্ধকার নিজেই ইউপিএ সরকারের আমলে কমনওয়েলথ, টুজি, কয়লা প্রভৃতি কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি কি নিম্ন আয়ের কর্মচারীর কাজ? না কি মন্ত্রী-আমলাদের মতো রাঘববোয়াল, যাঁদের আয় বিরাট অঙ্কের, তাঁদেরই কাজ? মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারি কি নিম্ন আয়ের কর্মচারীদের কাজ ছিল? সেই কেলেঙ্কারিতে যুক্ত তো বিজেপির মন্ত্রী, নেতা, বিধায়ক, সাংসদ, আমলা, সরকার-ঘনিষ্ঠ বিরোধী শিবিরের নেতা-মন্ত্রীরা। এঁদের কেউই এই জন্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েননি যে, তাঁদের আয় কম।

এ রাজ্যেও কয়লা থেকে গরু পাচার— একাধিক দুর্নীতির তদন্তে আদালতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি বলেছে, প্রশাসনিক স্তরে বোঝাপড়া ছাড়া এত সুনিপুণ ভাবে দীর্ঘ দিন ধরে এমন বিরাট আর্থিক লেনদেন চলতে পারে না। অর্থাৎ, এখানেও দুর্নীতিতে জড়িত সমাজ ও প্রশাসনের উচ্চকোটির মানুষরাই।

এই সব বিরাট বিরাট দুর্নীতির পিছনে আছে যে কোনও উপায়ে আরও বেশি ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নীতিবোধ নেই, মান-সম্মান নেই, আত্মমর্যাদা বোধ নেই, যে কোনও উপায়ে ধনবৃদ্ধিই একমাত্র উদ্দেশ্য। তাতে কে মরল, কে বাঁচল— কিছুই আসে যায় না। সম্প্রতি নির্বাচনী বন্ডের দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসতে দেখা গেল নেতা-মন্ত্রীরা কী ভাবে শত শত কোটি টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন সংস্থাকে সরকারি বরাত পাইয়ে দিয়েছেন। তাতে ব্রিজই ভেঙে পড়ুক, নির্মাণের পরই রাস্তা আবার বেহাল হয়ে যাক কিংবা জাল ওষুধে বাজার ছেয়ে যাক, নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের তাতে কিছুই যায় আসে না।

একটা কথা পরিষ্কার। কোনও একটা সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা যদি নীতিনিষ্ঠ হন, নিজেদের কাজকে যদি জনগণের প্রতি দায়িত্ব হিসাবে দেখেন, তবে দুর্নীতিকে অনেকখানিই কমিয়ে আনা যায়। তা না হলে দুর্নীতি শুধু উপরতলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা নীচের তলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। তখন উপরতলার নেতা-মন্ত্রীরা যেমন কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেন তেমনই দেখা যায়, নীচের তলার পঞ্চায়েত সদস্যরাও দিব্যি নিঃস্ব বিধবার ভাতা কেড়ে নিচ্ছেন, গৃহহীন হতদরিদ্রের আবাসের টাকা আত্মসাৎ করছেন। উপরতলার মানুষরা সৎ হলে, নীচের তলায় কোথাও দুর্নীতি হলেও তা গুরুতর বিপদের কারণ হয় না। বরং দুর্নীতিগ্রস্তকে শাস্তি দেওয়া সে ক্ষেত্রে সহজ হয়। রাজনীতি থেকে যত নীতি-আদর্শ, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে, ততই দুর্নীতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনীতিতে মূল্যবোধ ফিরে না এলে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

সমর মিত্র, কলকাতা-১৩

শ্বাসবায়ুর জন্য

‘বিষচক্র’ ( ১২-১১) একটি অত্যন্ত সময়োচিত সম্পাদকীয়। জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভর গাড়ির বাড়বাড়ন্তে দিল্লি, কলকাতা-সহ ভারতের বড় শহরগুলিতে বাতাসের গুণগত মান যে ‘খারাপ’ থেকে ‘অতি খারাপ’ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে সেই উদ্বেগ যথার্থ। প্রতিকার হিসাবে ব্যক্তিগত পরিবহণ থেকে যথাসম্ভব গণপরিবহণের দিকে সরে আসার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে তা কার্যকর করা সম্ভব হলে আগামী দিনে জনবহুল শহরগুলি অন্তত একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারবে। জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভর গাড়ি কমিয়ে গণপরিবহণের উপযোগী বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ালে তা যেমন শহরের বায়ুর গুণমানের সূচক স্বাস্থ্যকর রাখার জন্য কার্যকর হবে, অন্য দিকে দুর্বিষহ যানজট, যত্রতত্র পথ-দুর্ঘটনা এড়ানোও সম্ভব হবে। শহরে যান চলাচলে গতি আসবে।

তবে, একটা খটকা থেকে যায়। ‘চাহিদাহীন’ সম্পাদকীয়তে (১-১১) আর্থিক অসাম্য বোঝাতে অপেক্ষাকৃত কম দামি অবিক্রীত গাড়ির পরিসংখ্যানকে প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ভারতে গাড়ি নির্মাতা সংস্থাগুলির ঘরে বিক্রি না-হওয়া গাড়ির সংখ্যা সর্বকালীন রেকর্ড স্পর্শ করেছে। এর অর্থ হল, ব্যক্তিগত গাড়ি বিক্রির সঙ্গে দেশের অর্থনীতির হালহকিকত জড়িয়ে আছে। সে দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। আবার ‘বিষচক্র’ সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভর গাড়ির দূষণ থেকে রেহাই পেতে যেখানে ব্যক্তিগত পরিবহণ থেকে গণপরিবহণের দিকে সরে আসার প্রয়োজন ছিল, সেখানে গোটা দেশ জুড়ে গাড়ি এবং মোটরসাইকেলের মতো ব্যক্তিগত পরিবহণের উপরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তবে, এমন দোলাচল সর্বত্র। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থায় রয়েছে সরকারও। যার প্রমাণ মিলেছে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যে। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে সতর্ক করে জানিয়েছে, দূষণমুক্ত পরিবেশের অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং তা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু দূষণ প্রতিরোধের নামে সরকারের পদক্ষেপগুলো কেবলই ছলনা। শীতের শুরুতে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের চাষিরা খেতের নাড়া পুড়িয়ে রবি শস্য বপনের জন্য জমি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন। ফলে, প্রতি বছর এই সময়ে দিল্লি, নয়ডা, গুরুগ্রাম-সহ বেশ কিছু জনবহুল এলাকায় বায়ুদূষণের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য। অথচ দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, রাজনৈতিক দলগুলি পরিবেশ সাম্য নিয়ে ভাবিত নয়।

‘বিষচক্র’ সম্পাদকীয়তে বৈদ্যুতিক যান ব্যবহারে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাতে হয়তো শহরের বায়ুদূষণের পরিমাণ কমানো যাবে, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দেশের বায়ুদূষণ কতটুকুই বা কমানো যেতে পারে? ভারতের ৭০%-এরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জীবাশ্ম-জ্বালানি, বিশেষত কয়লা থেকে। তবে আশার কথা, জীবাশ্ম-জ্বালানির ভান্ডার অফুরন্ত নয়, সীমিত। তাই জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে কিছুটা হলেও উদ্যোগী হয়েছে সরকার।

অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement