‘ভবিষ্যৎ কী, মেয়েকে নিয়ে বাবা আত্মঘাতী’ প্রতিবেদনটি (২-৩) আজকের সমাজের একটি অসহায় অবস্থার ছবি তুলে ধরল। বেহালা হো চিন মিন সরণির কষ্টকর ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এক সমস্যা গভীর ভাবে জাঁকিয়ে বসেছে বাবা-মায়েদের মনে। বিশেষত, যাঁরা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলেমেয়ে নিয়ে সমাজের সঙ্গে লড়াই করেন। গতিশীল আধুনিক জীবনযাত্রা ও নানা অভ্যাসের কারণে স্নায়ুর নানা সমস্যাযুক্ত লোকজনে সমাজ-সংসার নীরবে উপচে পড়ছে। ছেলেমেয়ে-নিকটজন যে অবস্থাতেই থাকুক, তারা তো সব সময়ই তাদের বাবা-মায়ের, পরিবারের নয়নের মণি। চোখের সামনে সন্তানদের শারীরিক বা মানসিক অস্বাভাবিকতার মধ্যে জীবন কাটাতে দেখলে কোনও বাবা-মা স্থির থাকতে পারেন না। বুকে পাথর চাপা দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে সংসারে সমাজে স্বাভাবিক জীবনের ছবি দেখালেও অন্তরে তাঁরা কাহিল হয়েই বেঁচে থাকেন।
একই দিনে প্রকাশিত, নীলোৎপল বিশ্বাসের প্রতিবেদন ‘অভিভাবকের পরিকল্পনাই ভরসা! চিন্তা বিশেষ সন্তানকে নিয়ে’ পড়ে জানা গেল, সমাজবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা রিহ্যাবিলিটেশন সাইকোলজিস্ট-সহ ভুক্তভোগী বাবা-মায়েরা বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত। অভিজ্ঞতা বলে, এঁরা পড়শিদের বা বাসে-ট্রেনে সহযাত্রীদের বিশেষ নজরের সম্মুখীন হন যা এমন পরিবারকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে নিরুৎসাহিত করে। এই পরিবারগুলিকে একটি বিস্তৃত আবাসনে এনে এক জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করলে এঁরা সবাই নিজেদের মতো করে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবেন এবং এঁদের মনের বা মেলামেশার বন্ধ দরজা খুলে যেতে পারে। অর্থাৎ, এঁদের ‘গোষ্ঠী জীবন’ উপহার দিলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বা নিত্যকার চলাফেরা নিয়ে সমস্যা দূর হতে পারে। যদি সরকারি কোনও প্রকল্পের মাধ্যমে অটিজ়ম স্পেকট্রাম ডিজ়অর্ডার কিংবা নিউরো-ডাইভারজেন্ট পরিবারের সদস্যদের এক সীমানার বাঁধনে বেঁধে ফেলা যায়, তা হলে একটা সুরাহা হয়। অভিভাবকেরা নিজেদের এমন কোনও প্রকল্পের প্রস্তাব এনে সরকারি স্তরে আলোচনা করলে সরকারের পুনর্বাসন দফতর একটা মাস্টার প্ল্যান স্থির করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়ে বা তাদের বাবা-মায়েদের একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে পারে।
বিত্তশালী মানুষজনের ঘরেও এমন সন্তান রয়েছে। তাঁরা ট্রাস্ট গড়ে নিজস্ব নিয়মে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিঃসন্দেহ, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। নিজেদের মতো করে আলাদা ছোট্ট টাউনশিপ গড়ে তাঁরা একে অপরের হাত ধরে পাশে পাশে থেকে নিজেদের ভাল রাখতে পারেন। গোষ্ঠীজীবন এ সব পরিবারকে আশ্বস্ত করতে পারে।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
রূঢ় বাস্তব
‘ভবিষ্যৎ কী, মেয়েকে নিয়ে বাবা আত্মঘাতী’ প্রতিবেদন বিষয়ে কিছু কথা। প্রয়াত সৃজা দাস অটিজ়ম স্পেকট্রাম ডিজ়অর্ডার-এ আক্রান্ত ছিল। বয়স মাত্র ২৩ বছর। ওর বাবা মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিশাহারা হয়ে শেষ পর্যন্ত দু’জনে মিলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এ ঘটনা শুধু মর্মান্তিক নয়, আমাদের এক কঠিন বাস্তবতা ও সমাজের নির্মম নির্লজ্জতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
যখন সন্তান এ রকম একটি আজীবন বিকাশজনিত প্রতিবন্ধকতা নিয়ে লড়ছে, তখন সন্তানের মা ও বাবাকে অতিরিক্ত সহিষ্ণু হতে হয়। তবে, দেশের যা হাল, অসুস্থ কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ধরে আর এক দুশ্চিন্তা। যতই অন্য সন্তান থাকুক, কেবল মনে হয়— ওর কী হবে আমার মৃত্যুর পর? এই চিন্তা থেকে জন্মানো হতাশাবোধ প্রবল ভাবে ব্যথিত করে। আর তখন আত্মবিশ্বাসটুকু তলানিতে ঠেকে।
একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে প্রায় পৌনে দু’লক্ষ মানুষ অটিজ়মে আক্রান্ত। গবেষণার মাধ্যমে উপযুক্ত সমাধানের উপায় বার করে যত দিন না রোগটিকে সামাল দেওয়া যাচ্ছে, তত দিন এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলছে কই?
আমাদের তবুও আশার আলো নিয়ে বাঁচতে হবে। আরও হাতে হাত বেঁধে থাকতে হবে। কবির কথায় বলতে হবে— “সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো/ যাবো/ কিন্তু, এখনি যাবো না ...”
সব্যসাচী পড়ুয়া, কলকাতা-৭৫
চায় না!
সম্পাদকীয় ‘নাক ও নরুন’ (১-৩)-এর পরিপ্রেক্ষিতে জানাই, এই রাজ্যের চিকিৎসাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা সীমাহীন দুর্নীতি ও অচলাবস্থার অবসানে এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে উন্নত পরিষেবা প্রদানের লক্ষ্যে অনেকেই আশা করেছিলেন যে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এ বার এক জন পূর্ণ সময়ের মন্ত্রী নিয়োগ করা হবে। কেউ কেউ এমনও ভেবেছিলেন যে, এই মন্ত্রী হবেন এক জন চিকিৎসক। কারণ, নিজে চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে তিনি রাজ্যের চিকিৎসাক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা অনিয়মের ফাঁকফোকরগুলি খুব সহজেই ধরতে পারবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল এমন কিছুই হল না, সব যে নিয়মে চলছিল, তাই আবার ফিরে এল।
আর জি করে পড়ুয়া-চিকিৎসকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিয়েছে, রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কী ভাবে ঘুণ ধরে গিয়েছে এবং ক্ষমতার দাপটও কী ভাবে বিষাক্ত ডালপালা মেলে বহুধাবিস্তৃত হয়েছে। এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে রাজ্যবাসীকে সুস্থ স্বাস্থ্য-পরিষেবা দেওয়ার বিষয়ে কি প্রশাসন একেবারেই আন্তরিক ভাবে প্রয়াসী নয়? তা হলে তো পূর্ণ সময়ের এক স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্যভার সামলাতেন। কিন্তু রাজ্যবাসী অবাক হয়ে দেখলেন, সেই সহজ পথে কেউ হাঁটলেনই না। বরং স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সুস্থ করার দাবি নিয়ে রাজ্যের সিনিয়র ও জুনিয়র ডাক্তাররা সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে সংস্কারগুলি দাবি করেছিলেন তাকে বিশেষ আমল না দিয়ে প্রশাসন বিগত কয়েক বছরের মতোই ফের এক বার চটজলদি সমাধানের পথ নিল। চিকিৎসকদের বেতন বাড়িয়ে একটা সহজ সমাধানের পথ খোঁজা হল।
কেউ কি এক বারও ভাবলেন, চিকিৎসকদের হাতে কিছু অতিরিক্ত অর্থ তুলে দিলেই ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ফেরানো যায় না! তা হলে কি ধরে নিতে হবে প্রশাসন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রকৃত উন্নতি চায় না?
সমীর কুমার ঘোষ, কলকাতা-৬৫
ঔদাসীন্য কেন?
‘বিপন্ন ভবিষ্যৎ’ (৭-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি জুড়ে ফুটে উঠেছে ভবিষ্যতের বিপদের আভাস। খেয়ালখুশি মতো ধ্বংসাত্মক কাজকর্মের ফলস্বরূপ জলবায়ুর বিপজ্জনক বিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এর প্রভাবে এবং অবশ্যই প্রশাসনের সীমাহীন ঔদাসীন্যে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বেঁচে থাকার বাতাবরণ রীতিমতো বিপর্যস্ত।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, এই মুহূর্তে আমাদের দেশ শিশুদের শিক্ষা-পুষ্টি-স্বাস্থ্য ইত্যাদি সূচকের বিচারে অনেক পিছিয়ে রয়েছে! এমন এক ব্যর্থতার বাতাবরণেও বাজেটে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ কিছু বরাদ্দ হয়নি। অর্থাৎ ‘শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ’— এই গালভরা বুলি আমাদের দেশে আজও নিতান্তই প্রহসন! প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দিই, যেখানে ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে শিশুদের জন্য বরাদ্দ ছিল মোট সরকারি ব্যয়ের ৪.৭৬ শতাংশ, সেখানে এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২.২৯ শতাংশে!
কত প্রতিবাদ, কত মিছিল, কত স্লোগান— কান পাতা দায়! অথচ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে কেউ সরব নন। শুধু আমাদের মনের ভিতরে আজও প্রতিধ্বনিত হয়ে চলে— “চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—”
বিশ্বজিৎ কর, কলকাতা-১০৩