‘গোড়ায় গলদ’ (৩০-৩)
শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ কমানোর অন্যতম রাস্তা দেখানো হয়েছে, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ’। কিন্তু এ ভাবে কি ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ কমানো বা ব্যাঙ্কের দুরবস্থা ঘোচানো সম্ভব? গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে তো সবই ছিল বেসরকারি। সেখানকার গলদ ঘোচাতেই না রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সংস্থাগুলিকে। ১৯১৩-১৯৬৮, এই ৫৬ বছরে এই দেশে ২১৩২টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক নানা কারণে ফেল করেছে। এর পরিণামে ব্যাঙ্কের আমানতকারী এবং ব্যাঙ্ককর্মীদের দুরবস্থা কী হয়েছিল, সহজেই অনুমেয়। ১৯৬৯-২০২০— এই ক’বছরে গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক, ইয়েস ব্যাঙ্কের মতো ২৫টি বেসরকারি ব্যাঙ্কের বেগতিক অবস্থা দেখে সেগুলিকে বাঁচাতে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অব বরোদার মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এগিয়ে এসেছিল। এর পরও কি বেসরকারিকরণকে সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে বিবেচনা করা যায়?
ব্যাঙ্কের বিপুল পরিমাণ অনুৎপাদক সম্পদের জন্য দায়ী কারা? ঋণদাতা থেকে ঋণগ্রহীতা, সবাই এ ব্যাপারে দায়ী হলেও মূল দায়ী হিসেবে ঋণগ্রহীতাকে চিহ্নিত করা যায়। তাদের অগ্রগণ্য হল বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা, ইচ্ছাকৃত ভাবে যারা ঋণ পরিশোধ করছে না। কখনও কখনও এদের বিপুল পরিমাণ ঋণ মকুব করে দেওয়া হচ্ছে, আবার দীর্ঘ দিন ধরে এই ঋণ পরিশোধ না হওয়ার ফলে এগুলো অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ হলে এই অপরাধী সংস্থা বা ব্যক্তিরাই ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রক হবেন।
এ কথা একেবারেই ঠিক নয় যে, বেসরকারি ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ তুলনামূলক কম হওয়ার কারণ তাদের সতর্কতা। প্রকল্পের ঝুঁকি, সংস্থার আর্থিক পরিস্থিতি প্রভৃতি যাচাই করে তারা ঋণ দেয়। ঋণ দেওয়ার আগে এগুলো যাচাই করা সবার কাছেই বাধ্যতামূলক। তবে ঋণ আদায়ে কঠোরতার উপর গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটা তো কেবল ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সরকারের একটা বড় ভূমিকা থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী সংখ্যা দিনের পর দিন কমছে সরকারি নির্দেশনামার পরিণামে। ঋণ আদায়ের নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া সে কারণে বহু ক্ষেত্রে মার খাচ্ছে। সঠিক নীতির ভিত্তিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ জোরদার হলেই অনুৎপাদক সম্পদ কমতে পারে।
গৌরীশঙ্কর দাস
সাধারণ সম্পাদক, ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ় ইউনিটি ফোরাম
দোষ কর্মীদের?
ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ কমাতে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ’ বিকল্প, এই পরামর্শের গোড়াতেই গলদ। আজ এক দিকে সংবিধানের পিছনের দরজা দিয়ে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বাঁকা পথে জোর করে বেসরকারিকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে, অন্য দিকে ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ি এবং খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের শায়েস্তা না করতে পেরে ব্যাঙ্ককেই ‘ব্যাড ব্যাঙ্ক’ বলে দাগিয়ে অকর্মণ্য বলা হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ যদি কম হয়, তবে তার প্রধান কারণ, সেখানে ক্ষমতাসীন রাজনীতি বা সাঙাততন্ত্রের প্রভাব কম, এবং পেশাদার ব্যাঙ্কিংয়ের স্বাধীনতা বেশি। ঠিক বিপরীত দিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক তার চরিত্র অনুযায়ী সমাজকল্যাণ, রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা ও দেশের উন্নয়নে বলিপ্রদত্ত। এই তুলনার বিচার না করে সম্পাদক বড়সড় ঋণে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের ঝুঁকি না বোঝার কথা যা লিখেছেন, তাতে ব্যাঙ্ককর্মীদের একতরফা ভাবে অভিযুক্ত করা হয়। চোখের সামনে খেলাপি ঋণগ্রহীতা, জালিয়াতরা ঘুরে বেড়াবে আর নিরীহ ব্যাঙ্ককর্মী দায়ী হবেন, এ কেমন বিচার?
সম্পাদক লিখেছেন যে, জালিয়াতি রুখতে ব্যাঙ্ককর্মীদের আরও পেশাদার হতে হবে। ভারতে তো বটেই, সারা বিশ্বের বড় বড় প্রাইভেট ব্যাঙ্কে দক্ষ, পেশাদার অফিসার সত্ত্বেও যে অঙ্কের জালিয়াতি হয়, তা সাধারণত সংবাদে আসে না, ব্যালান্স শিটের সূক্ষ্ম হিসাবে সেঁধিয়ে যায়। বেসরকারি ব্যাঙ্কের শক্তি প্রয়োগে ঋণ আদায়ই বা কত দূর গণতন্ত্র-সম্মত?
সম্পাদক শেষে লিখেছেন, “মোট কথা, কোনও প্রার্থী ঋণ পাবেন কি না, এই বিচারটিকে অন্য কোনও বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হতে দেওয়া যাবে না।” যে কোনও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের শক্তি, দুর্বলতা, সম্ভাবনা ও ঝুঁকির বিশ্লেষণ। কোন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী তা করছেন? যখন ভারতের অর্থনীতি এমনিতেই দুর্বল, লাগাতার যুদ্ধবিগ্রহের প্রভাব বিশ্ব-অর্থনীতিকে আরও সঙ্কটে ফেলেছে। ভারতীয় অর্থনীতিতে বড়সড় ঋণে “অন্য কোনও বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হতে দেওয়া যাবে না” এ আপাতত অবাস্তব। তা হলে কি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ঋণ দেবে না? অবশ্যই দেবে, কিন্তু সেখানে ঋণ ফেরতের জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মজবুত করতে হবে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়ে অর্থনৈতিক শাসনে আস্থা বাড়াতে হবে।
সম্পাদকের পরামর্শ, ব্যাঙ্কের নিজস্ব ইন্টারনাল রেটিং এজেন্সি থাকা উচিত। ক্রেডিট ইনফর্মেশন বুরো (ইন্ডিয়া) লিমিটেড বা ‘সিবিল’ এখনও আছে, যেখানে সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে মূল্যায়ন করে। তা ছাড়া কিছু ‘কনসর্টিয়াম লোন’ আছে। সে
ক্ষেত্রে ফের আলাদা করে রেটিং এজেন্সি তৈরি করলে তো মূল্যায়নে খরচ ও জটিলতা দুই-ই বাড়বে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে ক্রমশ দুর্বল করে এ জাতীয় মূল্যায়ন কার্যকর হতে পারে না।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
চন্দননগর, হুগলি
মহার্ঘ ভাতা
সপ্তম বেতন কমিশনের পরে কেন্দ্রীয় কর্মীদের মোট ডিএ-র পরিমাণ ৩৪%। অপর দিকে, রাজ্যের ষষ্ঠ বেতন কমিশন-পরবর্তী রাজ্য কর্মীরা ডিএ পান মাত্র ৩%। এই রাজ্যে বকেয়া ডিএ-র পরিমাণ ৩১%। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জবাব দিয়েছেন, কেন্দ্র বকেয়া ৯০ হাজার কোটি টাকা মিটিয়ে দিলে আরও ভাল কাজ করা যাবে। প্রশ্ন, রাজ্য সরকারি কর্মীদের নিয়োগপত্রে কি উল্লেখ থাকে যে, কেন্দ্র পাওনা মিটিয়ে দিলে তবেই রাজ্যের কর্মীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা মিলবে? মহার্ঘ ভাতার মাধ্যমে বেতনের সমতা রক্ষা হয়। এটি হিসাব করে স্বশাসিত সংস্থা ‘এআইসিপিআই’। কেন্দ্রীয় সরকার সেই অনুসারে ছ’মাস অন্তর ডিএ-র পরিমাণ মূল্যায়ন করে তাদের কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা দেয়। পরে তা রাজ্যগুলি অনুসরণ করে।
আরও বঞ্চনা আছে। কেন্দ্রের বাড়িভাড়া ভাতা ২৪%, রাজ্যে ১২%। কেন্দ্রের সর্বনিম্ন এক জন কর্মীর বেতন ১৮,০০০ টাকা। তার ৩৪% ডিএ ও ২৪% বাড়িভাড়া ভাতা ১০,৪৪০ টাকা। অপর দিকে এই রাজ্যের সর্বনিম্ন বেতন ১৭,০০০ টাকা। মহার্ঘ ভাতা ৩% ও ১২% বাড়ি ভাড়া ভাতা ২,২৫০ টাকা। রাজ্য কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা সাংবিধানিক অধিকার। একে খণ্ডন করা যাবে না।
মলয় মুখোপাধ্যায়
কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ়
চাই নিরপেক্ষতা
ইদানীং পুলিশ, সিবিআই, ইডি ইত্যাদি সংস্থা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছে— এই অভিযোগ মনগড়া নয়। দেশের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা সম্প্রতি সিবিআই-এর এক অনুষ্ঠানে তা স্বীকার করেছেন (‘সিবিআইকে নিয়ে প্রশ্ন প্রধান বিচারপতির’, ২-৪)। সরকারের প্রতি তদন্তকারী সংস্থার আনুগত্য সাধারণ মানুষের কাছেও গোপন নেই। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সহমত হয়ে বলি, পুলিশ, সিবিআই বা ইডি-র মতো সংস্থা একযোগে এবং স্বাধীন ভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন না করলে অদূর ভবিষ্যতে দেশ জুড়ে চরম অরাজকতার সৃষ্টি হবে।
বাবুলাল দাস
ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা