Politics

সম্পাদক সমীপেষু: রাজনীতির নতুন পথ

মনে রাখা দরকার, ১৬০ বছর আগে সেই সময়কার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো যে রাজনীতিতে পরিচালিত হত, তার খেটে-খাওয়া মানুষের কথা ভাবার কিছুটা সুযোগ ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৫ ০৫:২৮
Share:

‘স্টিয়ারিং ধরার হাত’ (২৮-১) প্রবন্ধে এআই এসে যাওয়ায় ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে থাকা বিপুল কর্মনাশের আসন্ন সমস্যাটি স্বাতী ভট্টাচার্য যথাযথ ভাবে তুলে ধরেছেন। এই সমস্যা যাতে আমাদের গ্রাস করতে না পারে, সেই জন্য উপযুক্ত রাজনীতির প্রয়োজনের কথা তিনি বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন, কোন সেই রাজনীতি, যা এআই-এর সুবিধা ব্যবহার করে শ্রমদাসত্ব ঘোচানোর জন্য উদ্যোগী হবে? প্রবন্ধকার ১৮৬৫ সালের আমেরিকায় দাসদের মুক্তির ইতিহাস তুলে ধরে দেখিয়েছেন, সেই মুক্তি উৎপাদন বাড়িয়েছিল। মনে রাখা দরকার, ১৬০ বছর আগে সেই সময়কার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো যে রাজনীতিতে পরিচালিত হত, তার খেটে-খাওয়া মানুষের কথা ভাবার কিছুটা সুযোগ ছিল। দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য সে সব ভাবা তখন দরকারও ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এখন যে রাজনীতি করেন, তা শ্রমিকদের বহু দিনের লড়াইয়ের ফসল অধিকারগুলোকে বাতিল করে শ্রমদাস বানানোর জন্য নতুন আইন আনার পরামর্শ দেয়। যে নিয়মে আজ রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, অথর্ব মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মতো সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতাই তার ধর্ম। তাই আজ কোটি কোটি মানুষের হাতে নিত্যদিনের দরকারি জিনিসটুকু কেনার মতো পয়সাও নেই। চাহিদার অভাবে অর্থনীতির বৃদ্ধি মার খাচ্ছে দেখে বিশেষজ্ঞরা কপাল ঠুকছেন। এ দিকে ওই কোটি কোটি মানুষকে দিনে দিনে আরও নিঃস্ব আরও সম্বলহীন করে দেশের সম্পদের ৬৭ শতাংশ গিয়ে জমা হচ্ছে মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে। যে নিয়মে রাষ্ট্র চলছে রাজনীতির সেই নিয়মের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকা রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হাতে এ জিনিস রোখার উপায় নেই।

Advertisement

ফলে নতুন কাজ তৈরি আর পুরনো কাজ ধ্বংসের গতির মধ্যে ভারসাম্য আসবে— এমন আশা এই রাজনীতি দিতে পারে না। চাই নতুন রাজনীতি। সেই রাজনীতির সন্ধান করাই যুক্তিসঙ্গত কাজ।

শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৪

Advertisement

বিপ্লবের জন্ম

স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘স্টিয়ারিং ধরার হাত’ প্রবন্ধে পুঁজিবাদী সভ্যতার নিজস্ব নিয়মের ফল হিসাবে কোটি কোটি বেকার বাহিনী তৈরির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের দেশের বাস্তবচিত্রও তা বলছে। বিভিন্ন রাজ্যে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা, বাড়ছে গিগ শ্রমিকের সংখ্যা। এর উপর এআই-এর ব্যবহার যত বেশি হতে থাকবে, বাড়বে বেকার বাহিনী। খোঁজ নিলে দেখা যাবে পৃথিবীর উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে একই চিত্র।

এ সঙ্কট মেটার নয়। সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যাবে আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাসব্যবস্থা, আবার দাসব্যবস্থা ভেঙে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এসেছে। প্রতিটি সমাজে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে হাতিয়ার করে উৎপাদিকা শক্তি এগিয়েছে এবং এই শক্তির সঙ্গে স্থিতিশীল উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব হয়েছে। এর পরিণতিতে প্রচলিত সমাজ ভেঙে পরবর্তী সমাজ তৈরি হয়েছে। দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কিত লেখায় জোসেফ স্তালিনের কথাগুলো প্রণিধানযোগ্য— উৎপাদিকা শক্তিকে বিপুল ভাবে বিকশিত করে পুঁজিবাদ এমন দ্বন্দ্বের জালে জড়িয়ে পড়েছে, যা থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। উৎপন্ন পণ্যের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে, আর তার দাম কমিয়ে পুঁজিবাদ প্রতিযোগিতাকে তীব্র করেছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যক্তিমালিকদের ধ্বংস করছে, তাঁদের সর্বহারায় পরিণত করছে এবং তাঁদের কেনার ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করাই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অপর দিকে উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে বিরাট বিরাট কলকারখানায় একত্র করে পুঁজিবাদ উৎপাদনকে সামাজিক চরিত্র দিয়েছে। এর ফলে পুঁজিবাদের নিজের ভিত্তি ক্ষয় হচ্ছে। কারণ, উৎপাদন প্রক্রিয়ার এই সামাজিক চরিত্র উৎপাদন উপকরণের সামাজিক মালিকানা দাবি করে। কিন্তু উৎপাদন উপকরণ এখনও পুঁজিপতিদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এই অবস্থা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সামাজিক চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের এই ক্রমান্বয় দ্বন্দ্বের ফলে মাঝে মাঝে অতি উৎপাদনের সঙ্কট দেখা দেয়। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা নিজেরাই কমিয়ে তখন পুঁজিপতিরা দেখতে পান, তাঁদের পণ্যের কার্যকর চাহিদা নেই। তখন বাধ্য হয়ে তাঁরা উৎপন্ন দ্রব্য পুড়িয়ে ফেলেন, উৎপাদিত জিনিসপত্র নষ্ট করে দেন, উৎপাদন বন্ধ করে দেন এবং যে সময় লক্ষ লক্ষ লোক কাজ ও খাদ্যের অভাবে হাহাকার করেন, সেই সময় উৎপাদিকা শক্তিকে পঙ্গু করে দেন। পণ্যের অভাবে নয়, বরং বাড়তি পণ্য উৎপাদনের জন্যই সাধারণ মানুষ বেকার হয়ে যান, অনাহারে থাকেন। এর অর্থ হল, পুঁজিবাদে উৎপাদন সম্পর্ক সমাজের উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারছে না। বরং তার সঙ্গে অনিরসনীয় দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে।

অর্থাৎ, পুঁজিবাদের গর্ভে বিপ্লবের জন্ম হচ্ছে, যে বিপ্লবের উদ্দেশ্য হল উৎপাদন উপকরণের উপর পুঁজিবাদী মালিকানার পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা।

বিশ্বনাথ সর্দার, রায়দিঘি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

আদর্শের মৃত্যু

‘আন্দোলনে নিচুতলার অনীহা, প্রশ্ন সিপিএমে’ (৪-২) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রকাশ, কর্মীদের লড়াই-আন্দোলনে অনীহা কেন, তা নিয়ে এখন রাজ্য সম্মেলনে আলোচনা করতে হচ্ছে সিপিএম নেতাদের! সম্মেলনে এমন আলোচনা যে করতে হচ্ছে, সেটাই বোঝায় মার্ক্সবাদী আদর্শ তো দূর, সিপিএমে আজ বোধ হয় বামপন্থী আদর্শের ছিটেফোঁটাও টিকে নেই।

ষাটের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত, অর্থাৎ যত দিন পর্যন্ত সরকারি ক্ষমতার স্বাদ মেলেনি, তত দিন সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রবল বিক্রমে দলের কর্মীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছেন, মার খেয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন। কিন্তু যেই নেতারা সরকারি ক্ষমতার স্বাদ পেতে শুরু করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের হাত ধরে গোটা দলের পুরো অভিমুখটিই ঘুরে গেল শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের দিকে। আজ দলের নেতারাই সম্মেলনে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, সেই সময়কার দাদাগিরি ও দাপটের রাজনীতির অভ্যাস কর্মীরা এখনও ছাড়তে পারেননি বলেই আজ এত আন্দোলন-বিমুখতা। নেতাদের আজ এ কথাও স্বীকার করতে হচ্ছে যে, পুলিশের মার, গ্রেফতারি— এ সবের ভয়েও কর্মীরা এখন আন্দোলনে নামতে চান না।

প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে, দলের এই করুণ পরিণতির আসল কারণ চিহ্নিত না করে সংখ্যালঘু ও তফসিলি গোষ্ঠীর মানুষরা কে কোন দলে কত শতাংশ চলে গিয়েছেন তার হিসেব কষা হয়েছে সম্মেলনে। এই সব গোষ্ঠীর মানুষরাই নাকি লড়াইয়ে বেশি আসেন! মূল কারণ নেতারা আড়াল করতে চান বলেই সম্মেলনে এই সব হাস্যকর তত্ত্বের অবতারণা। তা না হলে তাঁদের স্বীকার করতে অসুবিধা হত না যে, আসলে বহু দিন ধরেই খেটে-খাওয়া, আর্থিক ভাবে সমাজের নীচের দিকে পড়ে থাকা মানুষদের পাশ থেকে দল সরে গেছে। মার্ক্সবাদী তথা বামপন্থী আদর্শের কিছুই আজ দল ও তার নেতাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই, তাই কোনও মতেই কর্মীদের তাঁরা আন্দোলনে নামাতে পারছেন না।

যন্ত্রণার বিষয় এটাই যে, এখনও নানা ভাবে অত্যাচারিত যে বিরাট অংশের মানুষ দিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা এই সিপিএম দলটিকেই মার্ক্সবাদী দল বলে মনে করেন। রাষ্ট্রের তরফেও মানুষের মনে সেই ধারণা বদ্ধমূল করার বহুবিধ চেষ্টা সচেতন মানুষমাত্রেরই চোখে পড়ে। কত দিনে এই ভুল ভাঙবে, তার উপরেই নির্ভর করে রয়েছে দেশে অন্যায়ের প্রতিবাদে জোরদার আন্দোলন গড়ে উঠবে কি না।

মিতুল মিত্র, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement