যে কোনও প্রাচীন ভাস্কর্য নিছক শিল্প নয়, তা দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। সে সব ভাস্কর্য দেশের ইতিহাস ও জাতীয়তাবোধের ধারা বহন করে চলে। মৌর্য শাসনপর্বে সম্রাট অশোকের নির্মিত সিংহমূর্তি দ্বারা গঠিত ভাস্কর্য ‘অশোক স্তম্ভ’ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের জাতীয় প্রতীক রূপে স্বীকৃত হয়। এত বছর ধরে এই স্তম্ভ ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে। তাই নতুন সংসদ ভবনের শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত হতে চলা জাতীয় প্রতীকে সিংহের মূর্তিগুলি দেখে দেশের ইতিহাস-সচেতন ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষরা হতবাক হয়ে গিয়েছেন। নতুন স্তম্ভে সিংহগুলির পেশিবহুল চেহারা ও দন্ত-বিকশিত, হিংস্র মুখ যেন নতুন ভারতের দিকনির্দেশ করছে। সম্রাট অশোকের আমলে নির্মিত অশোকস্তম্ভের সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক। দেশের বর্তমান সরকার আমাদের নতুন করে ইতিহাসের পাঠ দিচ্ছে। ঐতিহ্যশালী প্রাচীন শহর, জনপদের নাম পরিবর্তন করছে, আবার মা কালী থেকে হজরত মহম্মদ-এর নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অর্থ কখনওই এটা নয় যে, ইতিহাস ও সভ্যতা নিয়ে খেয়ালখুশি মতো খেলা করা যেতে পারে। আসলে রাষ্ট্রনায়করা বোধ হয় নিজেদের সভ্যতার ধারণার ছায়ায় নতুন ভারতের ইতিহাস রচনা করতে চাইছেন। অধ্যাপক ইরফান হাবিবের ভাষায়, এ হল ‘ইতিহাসের বিকৃতি’। রাষ্ট্রশক্তির ইচ্ছায় অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাস্কর্য তথা ইতিহাসের বিকৃতি দেশবাসীর কাছে কখনওই গৌরবময় নয়। বরং তা বেদনাদায়ক ও লজ্জাজনক।
ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, শিলিগুড়ি
রাষ্ট্র ও ধর্ম
‘বিদায়ক্ষণ’ (১৩-৭) সম্পাদকীয় বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে জানাই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রতিনিয়ত গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক রীতিনীতি, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে পদদলিত করে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ প্রকল্পে নির্মীয়মাণ নতুন সংসদ ভবনের উপর জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভের উন্মোচন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, হিন্দু রীতিতে পুজোর মধ্যে দিয়ে। সংবিধান অনুযায়ী, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সংবিধান বলছে, সরকার বা রাষ্ট্রের কোনও একটি বিশেষ ধর্মের প্রচার বা পক্ষপাতের অধিকার নেই। এ যুগের চিন্তানায়ক দার্শনিকদের অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি, ‘সেকুলার’ কথাটার প্রকৃত অর্থ পার্থিব। ‘সেকুলারিজ়ম’ এর প্রথম নীতি হচ্ছে, কোনও অতি-জাগতিক সত্তাকে অস্বীকার করা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে বোঝায় সেই রাষ্ট্রকে, ধর্ম সম্বন্ধে যার কোনও আগ্রহ নেই। রাষ্ট্র ধর্মকে বাধাও দেয় না, উৎসাহও দেয় না। অথচ, দেশের প্রধানমন্ত্রীর আচরণে কোথাও কি ধর্মনিরপেক্ষতার চিহ্ন প্রতিফলিত হচ্ছে?
এ ছাড়াও, জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভের রূপ বিকৃত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে সেই ছবি সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। মূল অশোক স্তম্ভের ক্ষমতা, শৌর্য, আত্মবিশ্বাস, সাহসের প্রতীক কমনীয় সিংহরা বীভৎস, রক্তলোলুপ, হিংস্রতায় পরিপূর্ণ; বর্তমানে যা ক্ষমতায় আসীন কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
স্বপন মুনশি, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
ভীতিপ্রদ
সম্পাদকীয় ‘এই সব সিংহেরা’ (১৭-৭) যথার্থ ও প্রাসঙ্গিক। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের পুণ্য লগ্নে আনুষ্ঠানিক ভাবে অশোক স্তম্ভকে দেশের ‘জাতীয় প্রতীক’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। দেশ কিংবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতীক অর্থবহ। প্রতীকে যে চারটি এশীয় সিংহ পরস্পরের দিকে পিঠ করে একটি গোলাকার ভিত্তির উপর বসে আছে, তারা শক্তি, সাহস, আত্মবিশ্বাস ও গর্বের প্রতীক। এর ঠিক নীচে, কেন্দ্রে রয়েছে একটি ধর্মচক্র, এবং তার দু’পাশে রয়েছে একটি ঘোড়া ও একটি ষাঁড়। ষাঁড় কঠোর পরিশ্রম এবং অবিচলতার প্রতীক। ঘোড়াটি আনুগত্য, গতি এবং শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। সবশেষে সংস্কৃত অক্ষরে লেখা ‘সত্যমেব জয়তে’।
ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রতীকের গুরুত্ব অসীম। উদার, মানবপ্রেমিক অশোক তাঁর স্তম্ভে ঠাঁই দিয়েছিলেন শান্ত, সৌম্য সিংহদের। আজ সেই সিংহেরাই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বসবে সংসদ ভবনের চূড়ায়। প্রশ্ন জাগে, এ কি তবে বর্তমান শাসকের প্রতীক? এখন দেশে উন্নত ও নিরপেক্ষ ভাবনার কোনও গুরুত্ব নেই। শাসকের বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে নিজের মতামত দিতে গেলে উমর খলিদ কিংবা মহম্মদ জ়ুবেরের মতো পরিণতিই ভবিতব্য। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি, বেকারদের কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি রোধ এখন দেশনায়কদের কাছে গৌণ। মুখ্য হল তাঁদের স্তুতি এবং কাজের প্রতি সমর্থন। ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান’-এর লক্ষ্যে দেশের কান্ডারিদের পদক্ষেপে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এখন কথার কথা। তাই সংসদ ভবনের শীর্ষে বসে এই সব সিংহেরা অচিরেই জনগণের ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠবে।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
হিন্দুত্বের বাহন
‘এই সব সিংহেরা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে যথার্থই মন্তব্য করা হয়েছে, “দূর থেকে দেখলে মূর্তিগুলিকে হিংস্র মনে হবে না— এই অভাবনীয় গূঢ় অর্থটিও কি প্রণিধানযোগ্য নয়?” ইন্ডিয়া গেট থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন, এই ৩.২ কিমি এলাকা জুড়ে, ঐতিহ্যবাহী ভবন গুঁড়িয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ গড়ে ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন লাভ করতে চায় মোদী সরকার। সর্দার পটেলের সুউচ্চ মূর্তি বা বারাণসীতে নয়া বিশ্বনাথ করিডর নির্মাণের মতো ঘটনা আম আদমির সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে সর্বরোগহর বটিকার কাজ করেছে। এই বার এল নতুন অশোক স্তম্ভ।
জাতীয় প্রতীক খোঁজার জন্য গণপরিষদের অন্যতম কর্মকর্তা বদরুদ্দিন তৈয়েবজিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরু। প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করেছিলেন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অনুরাগী তৈয়েবজি দম্পতি। পরে বিশ্বভারতীর কলাবিভাগের অধ্যক্ষ আচার্য নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে জাতীয় প্রতীকের ডিজ়াইন করেন ফাইন আর্টসের ছাত্র দীননাথ ভার্গব। বৌদ্ধ স্থাপত্য রীতির অনুপম নিদর্শন সারনাথের অশোক স্তম্ভের পশুরাজ সিংহেরা এযাবৎ শৌর্য ও অহিংসার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। মোদী জমানায় তাই পশুরাজদের ক্রুদ্ধ মূর্তি প্রদর্শন করতে দেখে অন্তরে ভীতি সঞ্চার হওয়াই স্বাভাবিক, যতই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অভয়বাণী শোনানো হোক।
পণ্য চিনতে মোড়ক যেমন সাহায্য করে, ঠিক তেমনই অনেক ভাবনা-চিন্তা করেই উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার ও প্রসারের পক্ষে অশোক স্তম্ভের এই নয়া রূপ বেছে নেওয়া হয়েছে বলে বিরোধীদের অনেকে আজ মনে করছেন। এবং তা করা হল স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে।
সরিৎশেখর দাস, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
ফিরিয়ে দাও
উত্তরপ্রদেশের সারনাথেই অশোক স্তম্ভের প্রথম হদিস মেলে। পরে কোশাম্বী (ইলাহাবাদ, অধুনা প্রয়াগরাজ) ও মধ্যপ্রদেশের সাঁচিতেও অনুরূপ দু’টি স্তম্ভ মিলেছে। এগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে নতুন সংসদ ভবনে যে বিকৃত, হিংস্র, দন্তবিকশিত সিংহমুখ-সম্বলিত প্রতিকৃতি স্থাপিত হয়েছে, তাতে মহামতি অশোকের অবদান আঘাত পেয়েছে। প্রাচীন ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায় এতে যারপরনাই বেদনাহত ও বিস্ময়াবিষ্ট। অবিলম্বে শান্তি ও সৌহার্দের বার্তাবহ প্রতীকরূপে অশোক স্তম্ভকে ফিরে পেতে চাই।
ইন্দ্রনীল বড়ুয়া, কলকাতা-১৫