Aged People in Social Media

সম্পাদক সমীপেষু: স্মৃতির পথ বেয়ে

যৌথ পরিবারে পাত পেড়ে খাওয়া ছিল, সুতোয় কাটা ডিম ছিল, ইত্যাদি বিষয় সমাজমাধ্যমে খুব ঘুরে বেড়ায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৩৮
Share:

মোহিত রায় লিখিত ‘সুখী মানুষের অতীতবিলাস’ (২৯-৩) প্রবন্ধটি সম্পর্কে কিছু কথা। বর্তমান দিনে দেখা যায় যে, বয়স্ক মানুষরা কমবয়সিদের পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে সমান ভাবে সক্রিয়। প্রবন্ধকার নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, তাঁরা উচ্চশিক্ষিত এবং সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তিনি যেটা বলেননি তা হল— এই মানুষরা বেশির ভাগই বাড়ি বা ফ্ল্যাটে একা থাকেন বা স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন। এঁদের ছেলেমেয়েরাও সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বাইরে থাকে। সুতরাং সমাজমাধ্যম এঁদের পক্ষে সময় কাটানোর একটা বড় মাধ্যম। আর এটাও নিঃসন্দেহে ঠিক যে, বয়স্ক মানুষরা বেশির ভাগই অতীতের চর্চা করে সময় কাটান। মানুষ যত বয়স্ক হয়, ফেলে আসা ছেলেবেলা তাঁকে পিছন ফিরে ডাকে। ছোটবেলার যৌথ পরিবার, ফেরিওয়ালার ডাক— এই সব স্মৃতি রোমন্থন করতে বয়স্করা ভালবাসেন। যৌথ পরিবারে পাত পেড়ে খাওয়া ছিল, সুতোয় কাটা ডিম ছিল, ইত্যাদি বিষয় সমাজমাধ্যমে খুব ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সত্যিই কি যৌথ পরিবারের সব বিষয় খুব ভাল ছিল! বয়স্ক মানুষরা অতীত নিয়ে বিলাসিতা করলেও তাঁরা নিজেরাও জানেন যে, তাঁদের ছোটবেলা খুব একটা মসৃণ ছিল না। আগেকার দিনের মানুষরা খুব ভাল ছিল, এখন সবই খুব খারাপ হয়ে গেছে— বয়স্ক মানুষদের এটাও একটা আলোচনার বিষয়বস্তু। কিন্তু আগেকার দিনের মানুষরাও যে কত স্বার্থপর ও ক্ষতিকর ছিল, তা আমরা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পল্লীসমাজ পড়লেই জানতে পারি।

Advertisement

এখনকার দিনে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যোগাযোগ কমে গেলেও একটা বৃহত্তর সমাজ মানুষের সামনে খুলে গেছে। বয়স্ক মানুষরা যদিও বর্তমান প্রজন্মের সমালোচনা করেন এই বলে যে, বর্তমান প্রজন্ম মোবাইলে মোহগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। কিন্তু তাঁরা নিজেরাও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নিজেদের একটা জগৎ গড়ে তুলেছেন। তাঁরা নিজেদের স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে গ্রুপ খুলে বা অন্য গ্রুপে যোগদান করে নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করেন, কবিতা বলেন, বেড়াতে যান। মোবাইল ফোন এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বিনোদনেরও একটা প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু নিঃসঙ্গ মানুষ যদি এর সাহায্য নিয়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে চান, তাতে ক্ষতি কী! বরং ছেলেমেয়েরা এ কথা ভেবে অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারে যে, বাবা-মা নিজেদের মতো করে তাঁদের অবসর জীবন উপভোগ করছেন।

দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৬

Advertisement

প্রাণের আরাম

‘সুখী মানুষের অতীতবিলাস’ প্রবন্ধটি আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সব মানুষ এক সঙ্গে কোনও বিষয়ে এক রকম না-ও ভাবতে পারেন। অনেক বয়স্ক মানুষই অতীতবিলাসী হয়ে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ জাতীয় ভাবনা ভাবেন। যখন সেই অতীত বর্তমান ছিল, তখনও কি তাঁরা ভাবতেন বর্তমানটা ভারী ভাল? এখন মানুষ সুখী কি না, বলা মুশকিল। মানুষ বলতে যদি দেশের মানুষের কথা বলা হয়, তা হলে ভারতের জায়গাটা যে কোথায়, সেটা জানা গেছে গ্যালাপ, অক্সফোর্ড ওয়েলবিইং রিসার্চ সেন্টার, ইউএন সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক এবং ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’স এডিটোরিয়াল বোর্ড-এর এক যৌথ সমীক্ষা থেকে। সেই ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ থেকে দেখা যাচ্ছে, সুখের নিরিখে আমাদের দেশের স্থান প্রায় শেষের সারিতে। ফিনল্যান্ডের স্থান সবার উপরে। তাদের সুখীতম হওয়ার কারণ সে দেশের জনগণের পিছনে সরকারি ব্যয় মাথাপিছু অনেক বেশি, যা সেই দেশের মানুষকে সব রকম ভাবে নিশ্চিত সামাজিক সুরক্ষা দিয়েছে। আমাদের দেশের কথা ধরলে কোন চিত্র ফুটে ওঠে, তা নতুন করে বলার নয়। বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শিশুঅপুষ্টি, প্রসূতি-মৃত্যু, দু’-বেলা ভরপেট অন্নের অভাব, স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় শিথিলতা, কর্মমুখী শিক্ষার অপ্রতুলতা— সততই মানুষকে ভবিষ্যতের জন্য অসুরক্ষিত এবং মানসিক চাপের মধ্যে রেখেছে।

ছোট বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালারা ছিলেন সমাজ পরিচয় বন্ধনের অংশীদার। পরস্পরের নিকট ও সমাজবদ্ধ ভাবে থাকার যে স্থিতাবস্থা, মানুষকে তা এক ধরনের শান্তি দিত। এমনিতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি, বৃহৎ পুঁজির বিস্তার, বিজ্ঞাপনী কৌশল আর বিভিন্ন স্তরের মানুষের আর্থিক অসঙ্গতি অনেক মানুষকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে তুলছিল। সেটা আরও বিধ্বংসী আকার নিল অতিমারির ধাক্কায়। এত কাল ধরে তৈরি হওয়া নানা স্তরের পরিকাঠামোগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। কর্মহারা দরিদ্র মানুষ সম্বলহীন হয়ে বিভিন্ন দিকে যেমন ছিটকে পড়লেন পেটের দায়ে, অন্য দিকে বিভিন্ন প্রকার অনুদানকে মানুষ খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরলেন। ‘অবক্ষয়জনিত দুর্দশার হিসাব রাখার অবকাশ মিলল না’। দেশীয় বৃহৎ পুঁজি এই সুযোগে ছড়িয়ে দিল প্যাকেজিং টেকনোলজি-তে সমৃদ্ধ ঝকঝকে অনলাইন ব্যবসার মায়াজাল। অনেকটাই ফিকে হয়ে গেল মুদির দোকানের, পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডাখানা।

মানুষ ক্রমশ মুখোমুখি হওয়ার বদলে সমাজমাধ্যমেই প্রাণের আরাম খুঁজে পেলেন।

শান্তি প্রামাণিক, উলুবেড়িয়া, হাওড়া

রঙিন চশমা

মোহিত রায়ের প্রবন্ধটি পড়ে যারপরনাই অবাক হলাম। তিনি সম্পূর্ণ একপেশে ‘ইউটোপিয়ান থিয়োরি’র আমদানি করলেন। দেশে যেন ক্ষুধা, অনাহার, বেকারত্ব— এ সব কিছু নেই, স্বর্ণযুগ বা রামরাজত্ব চলছে। তিনি লিখেছেন, আজকের দিন হলে পথের পাঁচালী-র সর্বজয়াকে অনাহারে দিন কাটাতে হত না, তিনি রেশন পেতেন, দুর্গাও স্বাস্থ্যের কার্ড নিয়ে বেঁচে যেত। কিন্তু আমরা বাস্তবে ভিন্ন চিত্র দেখছি। ক্ষুধাসূচকে আমাদের দেশ একেবারে তলার দিকে, অপুষ্টিতে ভোগা অভুক্ত শিশুর সংখ্যা বেশি, বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। পরিকাঠামোর অভাবে গ্রামের হাসপাতাল শহরের হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দিলে অনেক সময় পথেই রোগীর মৃত্যু হয়। দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর নন। তিনি লিখেছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে যে অতীতচর্চা হয়, পুরনো দিনের ফেরিওয়ালা বা ছোট দোকানদারদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো হয়, সেগুলো আসলে সুখী মানুষের বিলাসিতার নামান্তর। এই অতীতবিলাসী মানুষজন কখনও তাঁদের সাহায্য করেননি। কিন্তু এই সাধারণ মানুষই তো পাড়ার মুদির দোকান থেকেই জিনিস কিনতেন, বাচ্চাকে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে খেলনা বা আইসক্রিম কিনে দিতেন, আর তাতেই তাঁদের ব্যবসাটা টিকে থাকত, যখন বহুজাতিক শপিং মল গরিব মানুষের রুজিরোজগার গিলে খায়নি।

রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে তৈরি সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা চলচ্চিত্রে আমরা প্রথমেই দেখি শুনশান দুপুরে চারু রাস্তায় ফেরিওয়ালার ডাক শুনছে, খড়খড়ি তুলে বাইনোকুলার দিয়ে তাদের দেখছে। আজও গ্রামে, মফস‌্‌সলে তাঁরা কঠিন জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মোবাইল ফোন আধুনিক প্রযুক্তির অবদান। পাড়া কালচারে সবার সঙ্গে যে ব্যক্তিগত সৌহার্দ তৈরি হত, মোবাইল ফোনে অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও সেই ব্যক্তিগত ছোঁয়াটি নেই। এটি আসলে মানুষকে একা করে দিচ্ছে। অনলাইন অ্যাপে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার কিছুটা সাহায্য হলেও তীব্র মোবাইল আসক্তি তাদের ঘরকুনো, খেলার মাঠ বিমুখ করে দিচ্ছে। প্রবন্ধকার আরও সাংঘাতিক কথা লিখেছেন যে, বিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখার দরকার নেই, ইউটিউব দেখে সুন্দরবনে নৌকা চালাতে বা কেরলে ঢালাই কারখানায় কাজ করতে যাওয়া যাবে। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, এ সব কাজ হাতেকলমে শিখতে হয়। তা হলে শিক্ষা যে চেতনা আনে, তা যেন না হয়! দেশে বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিবিদ, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক অধ্যাপকদের আর দরকার নেই! প্রবন্ধকার সম্ভবত ‘সবকা বিকাশ’ দেখতে পাচ্ছেন। চোখ থেকে সেই রঙিন চশমাটি খুলে দেখলে বাস্তব সত্যটি বুঝতে পারতেন।

শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement