—ফাইল চিত্র।
ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বামপন্থী যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-আহূত জনসভায় প্রবল ভিড়ের তাৎপর্য বিশ্লেষণে লেখা ‘সম্ভাবনা’ (১০-১) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি সময়োপযোগী। গত দেড় দশকে উপর্যুপরি একটার পর একটা নির্বাচনে পর্যদুস্ত সিপিএম দল। ২০১১ সালে শাসনক্ষমতা হারানোর পর থেকে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা, ও টিভি চ্যানেলের সান্ধ্যকালীন বিতর্ক সভায় গলাবাজি করতেই দেখা গিয়েছে বাম নেতাদের। বৃহত্তর জনগণের স্বার্থবাহী কোনও উল্লেখযোগ্য আন্দোলন এ-যাবৎ কাল গড়ে তুলতে পারেননি তাঁরা। হয়তো তিন দশকের বেশি শাসনক্ষমতা ভোগ করা সিপিএমের নেতানেত্রীদের বিরোধী রাজনীতির জন্য পরিশ্রম করার কোনও মানসিকতাই আর অবশিষ্ট ছিল না। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্-মুহূর্তে দলের যুব সংগঠনের ডাকে ব্রিগেড গ্রাউন্ডের জমায়েত যে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বাড়তি অক্সিজেন দিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। বিগত নির্বাচনগুলিতে আসনসংখ্যা ও ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে সিপিএম-কে রাজ্য-রাজনীতিতে আপাত গুরুত্বহীন মনে হলেও, বর্তমান পরিস্থিতি তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করেছে। নানাবিধ দুর্নীতিতে ডুবে-থাকা রাজ্যের শাসক দল ও ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি আঁকড়ে থাকা প্রধান বিরোধী দলের উপর থেকে রাজ্যবাসীর একাংশের আস্থা কমেছে। কর্মহীনতা আজ এই রাজ্যের প্রধান সমস্যা। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে, ও একক ব্যক্তির হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো দ্রুত ভেঙে পড়ছে। রাজ্যে আপাত গণতন্ত্রের আড়ালে বইছে শাসক দলের সন্ত্রাস, ও তজ্জনিত ভয়ের চোরাস্রোত। যা অনেকাংশে বাম রাজত্বের সন্ত্রাসের কালো দিনগুলোর স্মৃতিই ফিরিয়ে আনছে। এমন পরিস্থিতিতে সিপিএমের তরুণ ব্রিগেড ডাক দিয়েছিল রুটি-রুজি-কর্মসংস্থান, ও ভেঙে-পড়া শিক্ষা-স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের জন্য। তার সাফল্য বিকল্প রাজনীতির উত্থানের আশা জাগায় বইকি। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়, ভিড়ের সমর্থন কি ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হবে?
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
নতুন ইঙ্গিত
‘সম্ভাবনা’ সম্পাদকীয় যথেষ্ট অর্থবহ। এই প্রসঙ্গে আমার কিছু নিবেদন। ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডে অনুষ্ঠিত ডিওয়াইএফআই-এর সমাবেশে দেখা গেল জনজোয়ার। যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পরিচালনায় সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের অবহেলিত প্রান্তিক মানুষের সান্নিধ্য ও আতিথেয়তায় দীর্ঘ ইনসাফ পদযাত্রা শুরু হয়েছিল, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্রিগেডের ওই জনজোয়ারে। রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দলের কদর্য রাজনীতির মুখে এই সমাবেশ ছিল মানুষের কাছে একটা বিকল্প পথের দিশা। নানা সমস্যা-বিধ্বস্ত মানুষ যে ভাবে শীতের রাতে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটিয়ে ওই সমাবেশকে ঐতিহাসিক করে তুলেছেন, তা যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এই সমাবেশ কতখানি ছাপ ফেলতে পারে, সেটা অবশ্যই একটি প্রশ্ন। কিন্তু গ্রাম-শহরের অবহেলিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সমাবেশের একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে, তা আগাম ঘোষণা করা যায়।
সারনাথ হাজরা, হেম চক্রবর্তী লেন, হাওড়া
ভরসাস্থল
‘সম্ভাবনা’ সম্পাদকীয়তে সঠিক ভাবেই বলা হয়েছে, “প্রতিস্পর্ধী হিসাবে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এখন অত্যন্ত জরুরি।” আমাদের দেশ এখন সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ বজায় রাখার কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। জনগণ যখন প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের চিন্তাচেতনাকে উন্নত করে ভোটের বাক্সে তা প্রতিফলিত করার জন্য ব্যক্তিস্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সামগ্রিক বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে আসেন, তখনই ‘রাজনীতির অভিমুখ’ পরিবর্তন করা সম্ভব। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের ভরসাস্থল এইটুকুই। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার অব্যবহিত পরেই কয়েক মাসের ব্যবধানে লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন হয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা জনতা পার্টির সঙ্গে জোট করে ভোটের লড়াইতে যোগদান করলেও পরের বিধানসভা নির্বাচনে জনতা পার্টির সঙ্গে তাঁদের আর আসন রফা হল না। বাম দলগুলো ‘বামফ্রন্ট’ গঠন করে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকার গঠনে সমর্থ হয়। এই সময় বুথ স্তরে কাজ করার মতো যথেষ্ট কর্মী বামপন্থীদের বহু বুথেই ছিল না। জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোট দিয়ে তাঁদের জয়ী করে সরকার গঠনে সহায়তা করে। এই জয়ের নেপথ্যে অনুঘটকের কাজ করেছে, ১৯৭২ সালের সাধারণ নির্বাচনে লাগামছাড়া সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করে বুথের পর বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট ও জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতা। মানুষ গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারীদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন। আবার ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে অপসারণ করতে তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনে জয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। তার পর তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ক্রমাগত তার শক্তি বৃদ্ধি করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারা অব্যাহত রেখেছে। বুথ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা ও সরকারের কোষাগার থেকে বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে নিয়মিত প্রান্তিক মানুষের কাছে আর্থিক সুবিধা সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ ভোটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করছে বলেই ভোট বিশ্লেষকদের বিশ্বাস।
স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ একটি সমস্যাসঙ্কুল রাজ্য। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বের শুরুতে যে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সমাজচিন্তা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ভারতের অগ্রণী রাজ্য হিসাবে বিবেচিত হত, সেই রাজ্যই ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণে বারে বারে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি, অনিয়ম। পাশাপাশি ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশ্যে মন্দির-মসজিদ নিয়ে এমন এক অস্বাস্থ্যকর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, যা সমগ্র দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়টিকেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ইনসাফ যাত্রার সূত্র ধরে ব্রিগেডের সমাবেশ থেকে রাজ্য রাজনীতির ‘মূল অ্যাজেন্ডা’ পুনরুদ্ধারের যে আহ্বান শোনা গিয়েছে, তা ভোটের বাক্সে কতটা প্রতিফলিত হবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাই এ বারের ভোট ব্যক্তিস্বার্থের কথা ভেবে নয়, হোক দেশের জনগণের সার্বিক উন্নয়ন, সামাজিক সুস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সুরক্ষার কথা ভেবে।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
দৃষ্টান্ত
সিপিআই(এম)-এর যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-এর ব্রিগেড সমাবেশে বিপুল জনসমাগম রাজ্য-রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এক দিকে শাসক দলের বিপুল দুর্নীতি, অন্য দিকে প্রধান বিরোধী দলের হিন্দু-মুসলমান বিভাজন নিয়ে রাজনীতি, এই দুইয়ের জেরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরটি দূষিত এবং বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে রাজ্যের বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের দাবি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি-সহ জনজীবনের মূল সমস্যা। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা রাজ্য-রাজনীতির অঙ্গনকে নিজেদের মুক্তাঞ্চল করে তুলেছেন। এই পরিস্থিতিতে সিপিআইএম নেতৃত্ব নিজেরা দর্শক আসনে বসে যে ভাবে এক ঝাঁক যুবক-যুবতীকে মঞ্চ ছেড়ে দিলেন, তা রাজ্য রাজনীতিতে দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এই অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার করার জন্য যে আন্দোলনের ডাক এই সমাবেশ থেকে দেওয়া হয়েছে, তা রাজ্য রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে নতুন এক ‘সম্ভাবনা’র সূচনা।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি