নামিবিয়ার আটটি চিতা মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যানে ছাড়া হয়েছে।
‘চিতা-রাজনীতি মোদীর, চাকরি নিয়ে বিরোধী খোঁচা’ (১৮-৯) শীর্ষক সংবাদ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ভারতে চাকরির আকাল আছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরও তীব্র হবে। উল্টো দিকে, সরকারি উদাসীনতাও থাকবে। কিন্তু চিতা নিয়ে বিরোধীদের মুখে চাকরির প্রসঙ্গ কেন উঠে এল, বোঝা গেল না। নামিবিয়া থেকে ভারতে আটটি চিতা নিয়ে এসে মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যানে ছাড়া হয়েছে। সে তো ভাল। সেই সিদ্ধান্তকে ঘিরে এত বিতর্ক কেন?
ভারতে চিতার অস্তিত্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল সেই স্বাধীনতার আগেই। যে দু’-চারটি চিতা এ ধার-ও ধার এ দেশের জঙ্গলে টিকে ছিল, তা-ও ১৯৫২ সালেই শেষ হয়ে যায়। মধ্যপ্রদেশের কুনো অভয়ারণ্যে শুকনো পাতার আধিক্য বেশি। কিছুটা ফাঁকা-ফাঁকা খালি উদ্যান রয়েছে। সেই কুনো জাতীয় উদ্যানে আটটি চিতা আফ্রিকা থেকে এনে ছাড়া হয়েছে। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে ভারতে এই চিতা আনার উদ্যোগ হয়েছিল। চিতা আনার ব্যবস্থা করতে তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ আফ্রিকাও গিয়েছিলেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিগত ইউপিএ সরকারের সেই উদ্যোগকে সফল ও বাস্তবায়িত করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারতে পঞ্চাশটির মতো জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য আছে। ছত্তীসগঢ় থেকে ঝাড়খণ্ড— দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য রয়েছে। ছত্তীসগঢ়ের অচানকমার, ইন্দ্রবতী অভয়ারণ্য, উত্তরাখণ্ডের করবেট, মধ্যপ্রদেশের কানহা, পেঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গের গরুমারা, বক্সা পাহাড়, মহারাষ্ট্রের তাড়োবা, অরুণাচল প্রদেশের নামদাফা, ওড়িশার ভিতরকণিকা, সিমলিপাল প্রভৃতি অভয়ারণ্যে চিতাবাঘ আছে। কিন্তু চিতা ভারতের কোনও অভয়ারণ্যে নেই। চিতা ও লেপার্ড এক প্রাণী নয়। উভয় প্রাণী বিড়াল শ্রেণিভুক্ত হলেও চিতা মূলত চেনা যায় তাদের চোখ থেকে নাকের পাশ দিয়ে মুখ অবধি কালো টানা অশ্রুদাগ দেখে। লেপার্ডের এই দাগ থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, চিতা থাকার মতো জঙ্গল ভারতে নেই। ভারতের জঙ্গল ঘন সবুজ গাছপালাতে ভরা। কিন্তু চিতা থাকার জঙ্গলে ঘাস ও ফাঁকা প্রান্তর দরকার। ভারতের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই ভাল বুঝেছেন। তাই কুনো জাতীয় উদ্যানকে চিতার উপযুক্ত আবাস মনে করেছেন। আপাতত এই আটটি চিতা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে জনসাধারণ খুব আনন্দিত।
১৯৮১ সালে কুনো-কে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এই সময় থেকেই অরণ্যটি জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। চিতাগুলো এখন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও দেশের সরকারের নজরে থাকবে। আশা, তারা এই জঙ্গলের পরিবেশকে দ্রুত আপন করে নিতে পারবে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এক্তেশ্বর, বাঁকুড়া
আর অন্যরা?
এক সময় এশীয় চিতার আঁতুড়ঘর ছিল ভারত। কিন্তু ক্রমেই তা বিলুপ্ত হতে থাকে। ১৯৫২ সালে চিতাকে বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করেছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। দীর্ঘ সত্তর বছর পর বর্তমান সরকারের উদ্যোগে নামিবিয়া থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিশেষ বিমানে আটটি চিতাশাবক নিয়ে এসে রীতিমতো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রদেশের কুনোর জঙ্গলে ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিষয়টি নিয়ে দেশ জুড়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আমি এই পদক্ষেপের আলোচনা-সমালোচনার প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমার বক্তব্য, চিতার মতো বর্তমানে বহু পশু আমাদের দেশে খাদ্যসঙ্কট এবং নিশ্চিত আস্তানার অভাবে বিলুপ্ত হতে বসেছে। সে দিকে কেন্দ্রীয় সরকার একটু নজর দিলে মনে হয় তাদের বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো যেতে পারে। তা না হলে তো এমন একটা দিন আসবে, যে দিন কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে এই পশুদেরও চিতার মতো নিয়ে এসে এ দেশে ছাড়তে হবে। ভবিষ্যতে এমন বোকামির কবলে যাতে পড়তে না হয়, সে জন্য এ বিষয়ে শুরু থেকেই সজাগ এবং সচেষ্ট হওয়াটা বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণতার পরিচয় নয় কি?
রবীন্দ্রনাথ রায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
থমকে উন্নয়ন
১৯৫২ সালে ভারতে চিতাকে বিলুপ্ত প্রাণী বলে ঘোষণা করে তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার। তখন থেকে সত্তর বছর ধরে চিতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ করেনি কোনও সরকার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তা সফল করেছেন। মধ্যপ্রদেশের শেওপুর এলাকার কুনো জাতীয় অরণ্যে ৮টি চিতা ছেড়েছেন নিজের জন্মদিবসে। এই পদক্ষেপ এক দিকে ইতিবাচক এবং স্বাগত হলেও দেশের বা ওই এলাকার মানুষদের কতখানি কাজে লাগবে, সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকারি কর্তাদের বক্তব্য, এর দ্বারা পর্যটন শিল্পের উন্নতি হবে, মানুষের আগ্রহ বাড়বে, এলাকার মানুষদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি হবে। তবে এই প্রকল্পের সুবিধা সরাসরি পেতে সময় লাগবে প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর।
১৯৮১ সালে কুনো-পালপুর অভয়ারণ্য বলে ঘোষিত হওয়ার পর ১৯৯৮ থেকে ২০০৩-এর মধ্যে ২৪টি গ্রাম উচ্ছেদ হয়। যদিও তখনকার প্রস্তাবমতো সিংহরা আসেনি গির অরণ্য থেকে। গুজরাতের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা আজকের প্রধানমন্ত্রী মোদীজি নিজে বাধা দিয়েছিলেন। যদিও এখন তিনি তাঁর ৭২তম জন্মদিনটিতে চিতা ছেড়ে একক কৃতিত্ব নিতে চাইছেন, যা অনৈতিক ও হিটলারোচিত আচরণ। ২০১৮ সালে কুনো-পালপুর অরণ্য ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে গণ্য হওয়ার পর থেকেই বাগচা গ্রামের অধিবাসীদের উচ্ছেদের তোড়জোড় শুরু হয় নতুন করে।
বাগচার অধিবাসীরা বিশেষ ভাবে বিপন্ন জনজাতির তালিকায় রয়েছেন, যাঁদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতির এখনই প্রয়োজন। অথচ, সরকার তাঁদের ভাল না করে মেতে উঠেছে চিতা নিয়ে রাজনীতির খেলায়, যা দুর্ভাগ্যজনক এবং অনভিপ্রেত। যদিও বন দফতর থেকে বলা হয়েছে যে, কারও ক্ষতি হবে না। সবাইকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে উচ্ছেদের আগে, তবে তা যে কতটা বাস্তবায়িত হবে, সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
সরকারের উচিত ছিল, বিদেশ থেকে চিতা আনলে বা না আনলেও ৯০ বা ১০০ কোটি টাকা বাগচা গ্রাম ও শেওপুর এলাকার উন্নয়নে খরচ করা। যেমন— তাদের পাকা বাড়ি করে দেওয়ার ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট উন্নয়ন, এবং নিকাশিব্যবস্থা ও পানীয় জল তথা বিদ্যুৎ সংযোগের দ্রুত ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে প্রাথমিক স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা। তাতে এলাকার বাসিন্দারা এখনই এর সুফল পেতে পারতেন। আরও কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর অপেক্ষা করতে হত না। অনেক বেকারের চাকরি হত, কর্মসংস্থান হত এবং বিজেপি সরকারও প্রশংসিত হত।
পরিবেশবিদরা আফ্রিকান চিতার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত। তাঁদের বক্তব্য, ১৯৫২ সালের ভারতীয় বন্যপ্রাণী আইনের ধারা অনুযায়ী, অন্য দেশ থেকে কোনও বিশেষ প্রজাতির প্রাণী এ দেশের অরণ্যে আনা যায় না। যে জন্য মোদীজির সরকার চিতা প্রকল্পকে ‘রিইন্ট্রোডাকশন’ বা পুনঃপ্রবর্তন বলে উল্লেখ করেছেন। যে চিতা লুপ্ত হয়েছিল, সেটা ছিল এশীয় চিতা। আর যা আনা হল এবং জঙ্গলে ছাড়া হল, তা হল আফ্রিকান চিতা, ঘাসজমি ও ফাঁকা জায়গায় যার বাস ও বিচরণ। সুতরাং, তাদের বেড়ে ওঠা ও সংরক্ষণ তথা প্রজননের জন্য অরণ্য কেটে তার জন্য আবাস তৈরি করা হচ্ছে।
চিতাদের সংখ্যা ভবিষ্যতে বৃদ্ধি পেলে অরণ্যের চরিত্র পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়বে, যা পরিবেশের পক্ষে ভাল হবে, না মন্দ হবে— তা নিয়ে পরিবেশবিদদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
পঙ্কজ সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি