রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক।
ফেব্রুয়ারির শেষের দিকেও দক্ষিণ কোরিয়ার করোনাভাইরাসের ছবিটা ছিল ভীষণ বিপদজ্জনক। তখন সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করেছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। প্রতি দিন আক্রান্তের সংখ্যা ঝড়ের গতিতে বাড়ছে। ডেগু শহরে সে সময় বড় ধরণের গণসংক্রমণ শুরু হয়েছে। করোনা আক্রান্তের পরিপ্রেক্ষিতে চিনের বাইরে সেই সময় দক্ষিণ কোরিয়ার পরিস্থিতিই সবচেয়ে খারাপ। ১৮ ফেব্রুয়ারি ডেগু শহরে করোনা সংক্রমণের খবর প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তি দু’সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুই শত গুণ বেড়ে যায়। ২৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছয় প্রায় হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু পরবর্তী দু’সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়া এই বিপদজ্জনক পরিস্থিতিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামাল দিতে সক্ষম হয়। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকে। ৭ মে পর্যন্ত এ দেশের মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ৮১০ জন এবং মৃতের সংখ্যা ২৫৬। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা এই মুহূর্তে ৫-এরও কমে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের করোনা পরিস্থিতি এই মুহূর্তে খুবই বিপদজ্জনক। সংক্রমণ আটকানোর জন্য বিভিন্ন দেশ কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে। কোথাও কঠোর ভাবে লকডাউন করা হচ্ছে, আবার কোথায় সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়া দেখিয়েছে যে কোনও শহর তালাবন্ধ না করেও এবং দেশের সীমানা উন্মুক্ত রেখেও এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনার আরও একটি উপায় রয়েছে, যার ফলে দেশ জুড়ে ব্যবসায় সে ভাবে ভাটা পড়েনি, অর্থব্যবস্থার উপর চাপও বেশি পড়েনি। ফলে এই মুহূর্তে নতুন কেস কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ায় জীবনও ক্রমশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।
এই সাফল্যের প্রধান কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা যে কৌশলের কথা উল্লেখ করছেন, তা ‘ট্রাস্ট’(TRUST)। ট্রান্সপারেন্সি; রোবাস্ট স্ক্রিনিং অ্যান্ড কোয়রান্টিন, ইউনিভার্সাল টেস্টিং; স্ট্রিক্ট কন্ট্রোল; এন্ড ট্রিটমেন্ট।
আরও পড়ুন: আটকে আছি কানাডায়, অপেক্ষায় রয়েছি ভ্যাকসিনের
তবে আমার মতে ভারতের মতো বিশাল দেশের তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়া তুলনামূলক ভাবে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থান থেকে এই যুদ্ধ শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়ার কম জনসংখ্যা, যা ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় সব বড় শহরের জনঘনত্ব ভারতীয় মহানগরগুলোর তুলনায় অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতা ও মুম্বইয়ের জনঘনত্ব সিওলের তুলনায় যথাক্রমে প্রায় চার গুন এবং দু’গুণ। এর সঙ্গে আছে একজাতিক সমাজ, অত্যন্ত উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, এবং সার্স (SARS) ও মার্স (MERS) মহামারীর পূর্ব অভিজ্ঞতা।
দ্বিতীয়ত, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ায় যখন করোনা সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছড়াতে শুরু করে, তখনও তা কিছু কিছু ক্লাস্টারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তার ফলে সরকারের পক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সুবিধা হয়েছিল, এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে সংক্রমণ সমাজের সর্বস্তরে ছড়াতে পারেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ সামনে থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের দেশগুলো পরবর্তী কালে সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে দেরি করে, এবং দ্রুত ব্যবস্থা না নিতে পারার দরুন করোনা সংক্রমণ সমাজের প্রায় সর্বস্তরে ছড়িয়ে পরে।
প্রত্যেকে মাস্ক ব্যবহার করছেন।
তৃতীয়ত, যে সুপার স্প্রেডার (পেশেন্ট ৩১, এই নামেই তাঁকে ডাকা হচ্ছে) ডেগু শহরে প্রথম সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করেন, সেই ব্যক্তি একটি ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যাঁর অনুগামীর সংখ্যা প্রায় দু’লাখ। তাই এই অনুগামীদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশি ছিল, তাই মূলত এঁদের চিহ্নিত করেই সংক্রমণের শিকলটা ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়।
চতুর্থত, স্বাস্থ্যকর্মীরা এত দ্রুততার সঙ্গে প্রত্যকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা পরীক্ষা শুরু করেন যে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যেই এই ধর্মীয় সংগঠনের দু’লাখ অনুগামীর প্রায় প্রত্যেকের করোনা পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে অনেকেরই পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসে, এবং সেই মতো চিকিৎসা করা হয় ও কোয়রান্টিন করা হয়। কিন্তু বাকিদেরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে অন্তত দু’সপ্তাহের জন্য হোম কোয়রান্টিনে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন: এই লকডাউন অবসর দিল আত্মসমীক্ষার, একাকিত্বকে অনুভব করার
এখনও পর্যন্ত, দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা সংক্রমিত রোগীদের প্রায় ষাট শতাংশ উপরিউক্ত ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বাকি চল্লিশ শতাংশ সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও চিকিৎসা করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করে:
• প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে করোনা-পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং পৃথকীকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়, যাতে কেউ কোনও অস্বাভাবিকতা অনুভব করলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরীক্ষা করাতে পারে।
• দ্রুত করোনা পরীক্ষার জন্য শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ভ্রাম্যমান টেস্টিং ভ্যান এবং ড্রাইভ-থ্রু-টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়।
• নাগরিকদের সচেতন করার জন্য সেলফোন ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি, হট-স্পট সম্পর্কিত তথ্য, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রমাগত তথ্য পরিবেশন করা হয়।
• দক্ষিণ কোরিয়া কখনওই আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশে লকডাউন ঘোষণা করেনি, তবে সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় সমাবেশ, শপিং মল, থিয়েটার হল, বিনোদনমূলক সমাবেশ ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট হটস্পটগুলিতে যাতায়াতের বিষয়ে আংশিক ভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। প্রতিটি বিমানবন্দরে আগত যাত্রীদের করোনা টেস্টিং বাধ্যতামূলক করা হয়।
• কিছু কিছু সংক্রমিত ব্যক্তির স্থানীয় ভ্রমণবৃত্তান্ত অন্যদের মোবাইল মারফত জানিয়ে দেওয়া হতে থাকে। যেমন সেই ব্যক্তি কবে, কখন, কত নম্বর বাসে করে কোথা থেকে কোথায় যাত্রা করেছেন, কোথা থেকে উঠেছেন, কোথায় নেমেছেন ইত্যাদি। যাতে তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা নিজেদের চিহ্নিত করে আইসোলেশনে যেতে পারে বা প্রয়োজনে পরীক্ষা করাতে পারে।
• পরবর্তী কালে, বিশেষত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে করোনায় আক্রান্ত অন্যান্য দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ দক্ষিণ কোরিয়ায় ফের বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই এই দেশের সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নতুন নিয়ম চালু করে। বিদেশ থেকে আগত প্রতি ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তত দু’সপ্তাহের জন্য নিভৃতবাসে যেতে বলা হয়।
প্রতিটি নাগরিকও সরকারের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। আজও প্রত্যেকে নিয়মিত মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করে চলেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারেও সবাই এখনও খুব সজাগ। কোরিয়া সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল শরৎকালে আবার করোনার প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করছে, যা বর্তমান অবস্থার চেয়েও বড় আকার ধারণ করতে পারে বলে তারা জানিয়েছে। তা মোকাবিলার জন্য ইতিমধ্যেই যথাযথ কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেছে।
অর্ঘ্য নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়
দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়ংন্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেকানিক্যাল অ্যান্ড আইটি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষক ও ন্যানোটেকনোলজিস্ট।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)