Food

সম্পাদক সমীপেষু: কিনে আনা তালের বড়া

বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই গ্রামের চরিত্র বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে তালের এই সব জিনিস তৈরি এক রকম উধাও হয়ে গিয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:১৮
Share:

—প্রতীকী ছবি।

এক সময় আমাদের গ্রামে প্রচুর তালগাছ ছিল। কলাপাতা করে তালশাঁস বিক্রি হত। খেতে খুবই সুস্বাদু। শ্রাবণ মাস থেকে তাল পাকতে শুরু করে। তাল গাছের নীচ দিয়ে যাওয়া আমাদের বারণ ছিল, যদি তাল মাথায় পড়ে। দিনেরবেলায় তাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকে গাছের দিকে দৌড়ে যেত, কে আগে তাল কুড়োবে। যে পাবে, বিজয়ীর হাসি নিয়ে মাথায় করে তাল নিয়ে বাড়ি ফিরত। অনেকে আবার ভোররাতে তাল কুড়োনোর জন্য বেরিয়ে পড়ত। পাকা তাল বাড়িতে ভাল করে ধোয়ার পর ছাল ছাড়িয়ে ছোট ঝোড়া বা বড় চুপড়ির গায়ের চাঁছা হত। তখন তাল দিয়ে তালের বড়া, রুটি, বড় থালাতে তালের মালপো তৈরি হত। এ ছাড়া বাঁকে করে পাড়াতে তালের পাটালি বিক্রি হত। তালের আঁটিগুলো সযত্নে পরিষ্কার করে এক জায়গায় জমা করে রাখা হত। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন তালের আঁটিগুলো কেটে ফোঁপর খাওয়া হত।

Advertisement

বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই গ্রামের চরিত্র বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে তালের এই সব জিনিস তৈরি এক রকম উধাও হয়ে গিয়েছে। এর কারণ, এখন বেশির ভাগ গ্রামে তালগাছ নেই। বাজারে একটা তালের দাম ৩০০ টাকা। বেশির ভাগ মানুষ বাড়িতে তাল দিয়ে মিষ্টি তৈরির ঝামেলা চাইছেন না। তালের বড়া-সহ তালের অন্যান্য পদ মিষ্টির দোকান থেকে কিনে নিয়েই কাজ সারছেন। তাল চাঁছা থেকে বড়া তৈরি হওয়া না পর্যন্ত বাড়ির কচিকাঁচাদের মধ্যে যে উন্মাদনা ছিল, তা এখনকার শিশুদের মধ্যে নেই। এখনকার অনেক শিশু তাল দেখেইনি। আধুনিকতা, ব্যস্ততা, যৌথ পরিবারের বিলোপ, টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির ফলে গ্রামে তালের মতো অনেক ঐতিহ্যবাহী জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে গেলে হয়তো এখনও দেখা যাবে শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে তালের বিভিন্ন পদ তৈরি করছেন গ্রামবাসী। তাঁরাই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

অপূর্বলাল নস্কর, ভান্ডারদহ, হাওড়া

Advertisement

মহার্ঘ

প্রবাদ বাক্যে শুনেছি তিল থেকে তাল হয়, ২০২৩-এ জন্মাষ্টমীর দিন কলকাতার বাজারে তার প্রমাণ মিলল। ১০-২০ টাকার তাল এক লাফে ২৫০ টাকায় বিক্রি হল। বিক্রেতারা হাঁকছেন জোড়া ৫০০ টাকা। তালের কী মহিমা, এ বছর দেখতে পেলাম। জন্মাষ্টমীর দিন গোপালের ভোগ হিসাবে দেওয়া হয় তালের বড়া, তালের ফুলুরি, তালের লুচি ও নানা মুখরোচক পদ। চাষি ও তাল বিক্রেতাদের অভিমত, এ বছর দীর্ঘ কয়েক মাস টানা গরম থাকায়, এবং বাজারে চাহিদা থাকায়, চাষিরা কচি তাল গাছ থেকে পাড়িয়ে তালশাঁস বিক্রেতাদের বেচে দিয়েছেন। তার পরেও গাছে যে তালগুলি ছিল, তা শ্রাবণ মাসেই অধিকাংশ ঝরে গিয়েছে। ভাদ্র মাস, তথা জন্মাষ্টমীর সময় বাজারে পাকা তালের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে, তাই সাধের গোপালকে তালের নানান পদ তৈরি করে খাওয়াতে গিয়ে পকেট পুড়েছে গৃহস্থের।

তবে আশা করা যায়, তাল চাষিরা এ বছর বেশ খানিকটা লাভের মুখ দেখেছেন। অনেক চাষি এবং বিক্রেতা তাল কিনে কোল্ড স্টোরে রেখে দেওয়ার চিন্তাভাবনাও শুরু করে দিয়েছেন।

শ্রীমন্ত পাঁজা, গঙ্গাধরপুর, হাওড়া

তালের খোঁজে

ছোট-বড়-মাঝারি, কোনও বাজারেই এ বছর তালের দেখা মেলেনি। ভাদ্রের ভরা মরসুমেও তালের দেখা মেলেনি, যা দেখে সকলেই রীতিমতো হতবাক। চড়া রোদে পিঠ পুড়িয়ে, ছাতার মধ্যে মাথা গুঁজে, অনেককেই হন্যে হয়ে এ দিক সে দিক পাগলের মতো তালের খোঁজ করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তালের তো দেখা মেলা ভার। অবাক হওয়ারই কথা যে, জন্মাষ্টমীর সময় বাজারে একটিও তাল চোখে পড়ল না। অথচ, বেশ কয়েক সপ্তাহ আগেই বাজারে আনাজের দোকানিদের রাশি রাশি তাল নিয়ে পসরা গুছিয়ে বিক্রি করতে দেখা গিয়েছে। জন্মাষ্টমীর দিন প্রয়োজনের সময় ম্যাজিকের মতোই যেন বাজার থেকে হাপিস হয়ে গেল সেই তাল।

আমাদের জগদ্দল এলাকার মধ্যে ভাটপাড়া, গোলঘর, ক্যালকাটা টকিজ় সিনেমাতলা, স্থিরপাড়া, কাঁকিনাড়া রথতলা, মণ্ডলপাড়া, আতপুর, শ্যামনগর, নতুনগ্রাম-সহ একাধিক বাজারে জন্মাষ্টমীতে দেখা গেল, তাল নিরুদ্দেশ। দু’-একটা জায়গায় কয়েক জন দোকানি তাল বিক্রি করলেও, তার দাম জিজ্ঞেসা করতেই গৃহস্থের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। একশো থেকে দেড়শো টাকা এক-একটি তালের দাম, তা-ও হাতের মুঠোয় ধরা যাবে। ক্রিকেট খেলার বলের থেকে সামান্য একটু বড় তার মাপ। এতে অনেকের জন্মাষ্টমীর কেনাকাটার ‘তাল’ কাটল নিঃসন্দেহে। আনাজপাতির দামও এ দিন ছিল আকাশছোঁয়া। তবে লোকজনের মুখে সর্বত্র সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে তালের মহার্ঘ দর। অথচ, মাত্র কয়েক দিন আগেও সেই তাল ২০-৩০ টাকা দামের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করছিল, এবং আকারেও বেশ বড়ই মিলছিল।

অবশ্য এর পিছনে যথেষ্ট কারণও আছে। সারা বাংলা জুড়ে তালগাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে। আগে বিশেষ করে গ্রামের দিকে মেঠো রাস্তার ধারে, নদী কিংবা পুকুর, এমনকি বড় বড় জলাশয় ও দিঘির পাড়ে সারি সারি তাল গাছের দেখা মিলত। বাজারে হাটে তখন ছিল তালের ছড়াছড়ি। কিন্তু আজ খেজুরগাছের মতোই তালগাছের সংখ্যাও সব জায়গাতেই ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তাল বাজারে অগ্নিমূল্য হয়েছে। আজ থেকে দশ বছর পরে এক পিস তালের দাম ৫০০ টাকা বললেও কিছুই বলার থাকবে না।

সৌরভ সাঁতরা, জগদ্দল, উত্তর ২৪ পরগনা

তালের গুণ

“তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে”— কবির এই কবিতায় তালগাছকে চিনেছিলাম অন্য সব গাছেদের মধ্যে অন্য ভাবে, অন্য রূপে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তালগাছ। যে তালগাছ একদা পুকুর, জলাশয়, খাল, বিল, নদীনালা থেকে শুরু করে বসতবাড়ির চার পাশে দৃশ্যমান ছিল, আজ যেন তারা অস্তিত্ব সঙ্কটে। গ্রামবাংলার আনাচকানাচে তালগাছের ডালে ডালে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ছিল। সে সবও হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাল ও নারকেল গাছ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও বজ্রপাত প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বলা হয়, যে সব এলাকায় তালগাছের সংখ্যা বেশি, সেখানে বজ্রবিদ্যুতে মানুষ ও পশু-পাখির মৃত্যুর হার খুব কম। তা ছাড়া তালের ফল এবং বীজ দুই-ই বাঙালির জন্য সুস্বাদু খাদ্য। আমরা অনেকেই তালের শাঁস, তালের বীজ শৈশবে কতই না খেয়েছি আনন্দে। তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি ইত্যাদি তৈরি হয়। পাকা তাল থেকেও অনেক মুখরোচক খাবার তৈরি হয়। তালের বড়া তো আছেই, তৈরি হয় তালের কেক, তালের পরোটাও।

খাদ্যগুণের পাশাপাশি তালপাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, লেখার পুঁথি, পুতুল ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরি হয়। ফলে এই গাছ থেকে নানা ভাবে মানুষ উপকৃত হন। অথচ, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তালগাছ আস্তে আস্তে হারিয়ে যাওয়ার কারণে এই প্রজন্ম অনেকটাই তালগাছের উপকারিতা ও তালের স্বাদ ভুলতে বসেছে। কয়েক বছর আগেও বাজারে প্রচুর তাল বিক্রি হত। অথচ, আজ যেন মানুষের উদাসীনতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে ভরা ভাদ্র মাসেও বাজারে ভাল তালের দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে।

এখনও সময় আছে সম্পূর্ণ বিনাশের হাত থেকে এই গাছকে বাঁচানোর। তালগাছের উপকারিতা পেতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের তালগাছ লাগানোর প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হওয়া ও অন্যদেরও উৎসাহিত করা একান্ত প্রয়োজন।

পাভেল আমান, হরিহরপাড়া, মুর্শিদাবাদ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement