‘আপনার লেখা ভাল, কিন্তু নামটি ভাঁড়ানো’ (রবিবাসরীয়, ৬-৬) নিবন্ধের জন্য সুমন গুণকে ধন্যবাদ। তিনি কবি বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে-র (ছবিতে) মতো বিখ্যাত দুই কবি ও সাহিত্যিকের মধ্যে আন্তরিক বন্ধুত্ব এবং শেষ লগ্নে বিচ্ছেদের প্ৰতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। বিষ্ণু দে বাংলার সাহিত্য-আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, বাম মনোভাবাপন্ন সংগ্রামী কবি। তাঁর প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ, স্মৃতি-সত্য-ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের কবিতার জগতে এক অনন্য নজির। সাহিত্য অকাদেমি এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। বুদ্ধদেব বসুও স্বনামধন্য কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক ও সাহিত্য সমালোচক। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশ দশকের নতুন কাব্যরীতির অন্যতম কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত। নিজে নাট্যকার হলেও মনে করতেন, নাটক বহু সীমাবদ্ধতায় বন্দি। নাটকের অধিকাংশ কথা সংলাপে জানতে হয়, কিন্তু জীবনের সবচেয়ে জরুরি কথাগুলো মুখে উচ্চারিত হয় না। তাই নাটকে কৃত্রিমতা অপরিহার্য। সেই জন্য তিনি নাটক ছেড়ে, সাহিত্যতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি সাহিত্যের দুটো নাম দিয়েছেন— ‘দেশজ’ ও ‘দেশোত্তর’ সাহিত্য। তাঁর কাছে সাহিত্যের ভাষায় অনুবাদ হল ‘মৌলিক শিল্প’। বিষ্ণু দে এবং বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তাঁর প্রভাবের বাইরে এসে সাহিত্যজগতে বিখ্যাত হন।
তবে এই দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে কট্টর সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর বিদেশে থাকাকালীন ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে প্যারিসে প্রকাশিত টু সিটিজ় নামক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে এক দ্বিধাহীন সমালোচনার কথা। বিষ্ণু দে তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন। যতটুকু জানতে পারা যায়, বুদ্ধদেব বসু টু সিটিজ় পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে কিছু দুর্বলতা থাকলেও রবীন্দ্রনাথের এক-একটি রচনায় রয়েছে এক-একটি গুণ। সেগুলোকে এক সঙ্গে মিলিত করে পাঠ করলেই পাওয়া যাবে তাঁর লেখার প্রতিভার বিশেষ সত্তা। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু দেখিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথাসাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ও ব্যবধান, ঐক্য ও বিচ্ছিন্নতা, মিল ও পার্থক্য। তাঁর অভিমত, বিচ্ছিন্ন ভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখলে ভুল হবে, রচনায় তাঁর দুর্বলতা ধরে বিচার করলেও ভুল হবে। প্রতিটি উৎকৃষ্ট রচনা পাঠ করতে হবে। তার সম্মিলিত বিচার প্রকৃত রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়ার একমাত্র উপায়, যেখানে তিনি অসামান্য ঐশ্বর্যময়। এ ছাড়া তিনি বলেছেন, কোনও মতবাদের প্রচারক হয়ে পড়লে শিল্পের অপমৃত্যু ঘটতে বাধ্য। এই ভবিষ্যৎ দৃষ্টির মধ্যে যে স্বচ্ছতা ছিল, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি সমর সেনের অনাকাঙ্ক্ষিত স্তব্ধতায় এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আমৃত্যু কবি ও কর্মীর দ্বন্দ্বে।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
সম্মানে বিদায়
বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে-র বন্ধুত্বের কথা যেন তাঁদের লেখার মতোই আকর্ষক, ও চর্চিত। রবিবাসরীয় নিবন্ধটিতে তার নানা অজানা দিক পাওয়া গেল। দুই মহানুভব লেখকের সৃজনশীল ও আত্মিক বন্ধুত্ব ও তার পরিণতি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। শিক্ষা দেয়, কী ভাবে স্বল্প কথাবার্তার বিনিময়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে একে অপরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। আবার সেই সম্পর্কে মতের ও বিবেচনার অমিল প্রগাঢ় হয়ে উঠলে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে, সৌজন্যমূলক বিদায় নিয়ে চিরকালের জন্য আদানপ্রদান বন্ধ করে দেওয়া যায়। তাঁদের প্রতি পাঠকদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা চিরকালের। তবে এই দুই কালজয়ী লেখকের বন্ধুত্ব আরও বেশি দিন স্থায়ী হলে বাংলা সাহিত্য নিঃসন্দেহে আরও সমৃদ্ধ হত।
আরাত্রিকা নিয়োগী, বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া
অবিস্মৃত অমিয়
“মেলাবেন, তিনি মেলাবেন” পঙ্ক্তিটি প্রায় প্রবাদে পরিণত হলেও ‘সংগতি’ কবিতার রচয়িতা অমিয় চক্রবর্তীর (১৯০১-১৯৮৬) এ বছর ১২০তম জন্মবার্ষিকী, তা ক’জন মনে রেখেছি? রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গাঁধীর মধ্যে সম্পর্করক্ষার অন্যতম সেতু ছিলেন তিনি। জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তরঙ্গ সুহৃদ ছিলেন, যার প্রমাণ পাওয়া যাবে পারস্পরিক অজস্র চিঠিপত্রে। বাংলা কবিতার আধুনিকতার পথিকৃৎ কবিপঞ্চকের অন্যতম অমিয় কৈশোরেই প্রমথ চৌধুরীর সান্নিধ্য পান। হাজারিবাগের বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয়র পোর্ট্রেট এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ব্যক্তিগত সাহিত্য-সচিবের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। সেই পদ ছেড়ে দিলেন অমিয় ১৯৩৩-এ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে। স্ত্রী-কন্যা শান্তিনিকেতনে রয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথকে বলে গেলেন, কবির বাণী বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার কাজেই তিনি ইউরোপ যাচ্ছেন।
একটি ক্ষেত্রে অমিয় চক্রবর্তীর অবদান স্মরণীয়। যে মহাদেশটি তখনও পর্যন্ত বাঙালির, এমনকি রবীন্দ্রনাথেরও চেতনায় ছায়াচ্ছন্ন ছিল, সেই পরাভূত আফ্রিকার আদি সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মের কল্যাণব্রতী কিছু ইউরোপীয়ের চোখে দেখা আলাদা এক আফ্রিকা তখন জেগে উঠছিল। মুসোলিনির অত্যাচারে তখন পিষ্ট হচ্ছে আবিসিনিয়া। সম্রাট হাইলে সেলাসি স্বেচ্ছানির্বাসনে আছেন। এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৬-এর ১৭ নভেম্বর অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথকে দীর্ঘ একটি চিঠিতে আফ্রিকা সম্বন্ধে অবহিত করে শেষে লেখেন, “আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আফ্রিকার
এই ‘ট্রাইব ইটার্নাল’ নিয়ে আপনি
যদি একটি কবিতা লেখেন। আফ্রিকার সম্পর্কে আপনার কোনো কবিতা নেই— এইরকম কবিতা পেলে কীরকম আনন্দ হবে বলতে পারি না।”
রবীন্দ্রনাথের প্রথমে উৎসাহ হয়নি। তবুও অমিয়র বারংবার তাগাদায় আফ্রিকার লাঞ্ছিত, অপমানিত ইতিহাস বিষয়ে উদাসীন থাকতে পারলেন না। এর পরেই লিখলেন বিখ্যাত ‘আফ্রিকা’ কবিতা, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭-এ। অমিয়কে কবিতাটি পাঠিয়ে সঙ্গে লিখলেন, “বাংলা ভাষার কুলুপমারা এই কবিতা নিয়ে ওদের কী কাজে লাগাবে?” হাইলে সেলাসি সোয়াহিলি ভাষায় তা অনুবাদ করিয়ে ছড়িয়ে দিলেন সারা আফ্রিকায়।
অমিয় চক্রবর্তী ইউরোপ ছাড়াও আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন, আমেরিকা হয়ে উঠেছিল তাঁর ‘দ্বিতীয় ঘর’। পড়িয়েছেন অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে, বক্তৃতা করেছেন। সমগ্র পৃথিবীর প্রকৃতি ও মানুষ তাঁর অন্তর্দৃষ্টির উঠোনে উপস্থিত থেকেছে আত্মজনের গভীরতায়। কৈশোরে গল্পকার জেরোম কে জেরোমের পত্রবন্ধু হয়ে ওঠা অমিয় চক্রবর্তীর সারা জীবনের অর্জন জর্জ বার্নার্ড শ, আইনস্টাইন, ওপেনহাইমার, এইচ জি ওয়েলস, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, টি এস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, বরিস পাস্তেরনাক, টমাস মান প্রমুখ মনীষার সখ্য। ‘বিশ্ববাঙালি’ শব্দবন্ধটি যেন তাঁর যথার্থ বিশেষণ। জীবনসায়াহ্নে ফিরে এসেছিলেন রবীন্দ্রভূমি শান্তিনিকেতনেই। সেখানেই এই বিশ্বপথিকের দেহান্তর ঘটে ৩৫ বছর আগে, ১২ জুন ১৯৮৬।
শুভাশিস চক্রবর্তী, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
সীমাহীন সঙ্গীত
‘পরান যাহা চায়, মেলালেন সেই রবি’ (৭-৬) প্রতিবেদনে পাক ধারাবাহিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার জেনে আনন্দিত হলাম। রবীন্দ্রসঙ্গীত, তথা বিশ্বের কোনও সুর ও সঙ্গীত, কোনও সীমাতে আবদ্ধ হতে পারে না, এ তারই প্রমাণ। দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়েও সুর ও সঙ্গীত শত্রু-মিত্রের বেড়াজাল মানেনি, বর্তমান বিশ্বের পঙ্কিল রাজনীতিও তাকে রুদ্ধ করতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ নিজে বহু গানের সুর করেছিলেন অন্য দেশের গানে অনুপ্রাণিত হয়ে। দুর্ভাগ্য, স্বাধীন ভারতেও আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে
দিতে পারিনি।
ইন্দ্রানী গুহ, কলকাতা-১০৭