আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রথম পাতাতেই আমরা পেতাম ‘তির্যক’ শিরোনামে কার্টুন চিত্র, প্রত্যেক দিন। ফাইল চিত্র।
শিশির রায় তাঁর ‘হাসি কান্না হীরাপান্না’ (২৬-৩) শীর্ষক প্রবন্ধে দেশ ও বিদেশের বহু কার্টুন শিল্পীর কাজের কথা যেমন পর্যালোচনা করেছেন, তেমনই এই শিল্পের গুরুত্ব কতখানি সেটাও বুঝিয়েছেন। কেবলমাত্র যুদ্ধ নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছে বহু কার্টুন। এগুলি একই সঙ্গে পরিস্থিতির পর্যালোচনা ও মনোরঞ্জন করেছে। প্রকৃত অর্থেই কিন্তু এই চিত্রশিল্পীগণ সত্যদ্রষ্টা।
আমাদের ছেলেবেলায় দেখে আসা সেই সব কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র এখন আর তেমন ভাবে দেখা যায় না। কয়েকটি লেখায় ও রেখায় জটিল পরিস্থিতির কথা হালকা ভাবে উপস্থাপন করে আনন্দদান করার সেই মানুষগুলি আর নেই। নেই ‘কুট্টি-অমল-চণ্ডী-সুফি’রা। নেই সেই ‘রেবতীভূষণ’ও।
আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রথম পাতাতেই আমরা পেতাম ‘তির্যক’ শিরোনামে কার্টুন চিত্র, প্রত্যেক দিন। যুগান্তর পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পেত ‘অমল আলোয়’ নাম নিয়ে প্রতি দিনের কার্টুন চিত্র। সাধারণ সময়ে তো ছিলই, তবে দেশের আইনসভা নির্বাচনের সময় এই ধরনের কার্টুনের ছবি বিশেষ ভাবে নজরে পড়ত।
তখন শহরের কিছু জায়গায় ম্যালেরিয়া রোগটি আবার দেখা দিয়েছে। সেই সময় কার্টুনের ছবিতে দেখা গেল, এ রাজ্যের তৎকালীন সরকারের প্রধান মানুষটির মতো দেখতে এক জন, বেতের তৈরি একটা মোড়া এগিয়ে দিচ্ছেন এক কঙ্কাল-মহিলার দিকে। কঙ্কালের গায়ে লেখা আছে ‘ম্যালেরিয়া’। ছবির নীচে গানের কথা, “কতদিন পরে এলে, একটু ব’সো”। হাতে টানা রিকশার এক জন চালক প্রাণপণে টেনে চলেছেন তাঁর যানটি। যাত্রীর আসনে গালে হাত দিয়ে বসা এক যাত্রী, মুখের গড়নে প্রশাসনের এক বিশিষ্ট জনের অনুকরণ। রাস্তার মাইলফলকে লেখা ‘১৯৯৬’। গানের ভাষা, “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হ’তো তুমি বলতো”। নদীর ছবি। টালমাটাল অবস্থায় নৌকা সামলাচ্ছেন বৈঠা হাতে এক কর্ণধার। নৌকার ছইয়ের ভিতর বসে আছেন কয়েক জন। তাঁদের এক-এক জনের গায়ে বামফ্রন্টের শরিক দলের এক-একটি নাম। গানের ভাষা, “ও বিধিরে, এই খেয়া বাইবো কত আর”। কী অতুলনীয় সব কাজ! কী অসাধারণ শিল্পচিন্তা!
১ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশ করেছে ‘ফিরে দেখা কুট্টির কার্টুন’ শিরোনামে অতীত দিনের বেশ কিছু ব্যঙ্গচিত্র। টাকার দাম পড়ে যাওয়ার কারণে নাস্তানাবুদ কেন্দ্রীয় সরকার। বক্সিং রিং-এর ভিতর ‘ইকনমিক ক্রাইসিস’ নামধারী বক্সারের হাতে পরাজিত এক টাকার একটি ধাতবমুদ্রারূপী বক্সারকে শুশ্রূষা করছে (জুলাই ১৯৬৫)। মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের এক রাষ্ট্রমন্ত্রী মাছ ধরার ছিপ নিয়ে ‘প্রাইস’ নামে চিহ্নিত মাছটিকে ধরতে এসে, সেই মাছের টানে জলের মধ্যেই ভেসে যাচ্ছেন (অগস্ট ১৯৬৬)। এমন আরও বেশ কিছু কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল। ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা কিছু কার্টুনের উল্লেখ এখানে করা গেল। এগুলির উপযুক্ত সংরক্ষণ বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। এই বিষয়ে অনুরোধ রাখছি।
অমলকুমার মজুমদার, শিবপুর, হাওড়া
খোপবন্দি লীলা
রুশতী সেনের ‘রাগী বাবার জেদি মেয়ে?’ (৫-৩) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই পত্রের অবতারণা। রুশতী লিখেছেন, “...ঝাঁপতাল, আয়না, চীনে লণ্ঠন সবই শেষ পর্যন্ত আধুনিক মেয়েদের পাত্রস্থ হওয়ার আখ্যান! শ্রীমতী তো লেখা শুরুই হয়েছিল এই পূর্বনির্ধারণ মেনে নিয়ে যে, প্রধান চরিত্র হবে আধুনিককালের মেয়েরা, আর শেষটা হবে সুখের।” এই কারণে বহু দিন ধরেই লীলা মজুমদারের প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাসগুলিকে পাশে সরিয়ে রেখেছেন অনেক পাঠক, কেননা তাঁর অনবদ্য কৈশোর-কেন্দ্রিক রচনাগুলির পাশে এগুলোকে কোনও নম্বর দেওয়াই যায় না।
এই ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করতে বাধ্য হই লীলার বড়দের লেখা, বিশেষত ঝাঁপতাল ও চীনে লণ্ঠন আবার পড়ে উঠে। আর কত দিন আমরা লেখকদের খোপে বন্দি রাখব? লীলার ক্ষেত্রে যে খোপ হয়ে উঠেছে শিশু-কিশোর সাহিত্যের খোপ। উপন্যাসগুলি পড়তে গিয়ে দেখি— নারীবাদী উপন্যাস, উঁচুদরের উপন্যাস, সুপাঠ্য সুসাহিত্য, যে কষ্টিপাথরেই ফেলি না কেন, এগুলি অত্যন্ত মূল্যবান লেখা। উপন্যাসগুলোকে আমার বেশ বেশি করেই নারীবাদী বলে মনে হচ্ছে। কেন? এক, উপন্যাসগুলি নির্লজ্জ ভাবে নারীকেন্দ্রিক। দুই, লেখাগুলি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা কিছু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত মেয়েদের যাপন ও যাত্রার কথা। অপরিমিত অর্থ পাওয়া মেয়ে। চাকরি করা মেয়ে। প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত শুধু নয়, হাই সোসাইটির মেয়ে। পার্টিতে যায়, রং মিলিয়ে শিফনের শাড়ি পরে। এই অগ্রগামী সচেতন মেয়েদের বাংলা সাহিত্য তো আগে দেখেনি! তাই কি এই উপেক্ষা? কিন্তু এর পরেও আছে। তিন, হ্যাঁ, লেখাগুলিতে একটি কি দু’টি মাসিমা-পিসিমা গোত্রীয় চরিত্র আছেনই, যাঁরা আশ্রিতা, অভাবী, কিন্তু বড়লোকের সংসারে সারা দিন চা বানাচ্ছেন, লুচি ভাজছেন, খেতে দিচ্ছেন, বাজার গোছাচ্ছেন, অথবা ভাঁড়ার বার করে দিচ্ছেন। অতি চেনা এই চরিত্রেরা অনেকেই আনন্দের প্রতিমূর্তি, এনার্জির উৎস। কিন্তু তাঁরা সবাই মোটেই পবিত্রতার প্রতিমূর্তি নন। সাদাকালোর বাইরেও সব রকমের পর্দায় আঁকা। তাঁরা সেবা ও যত্নের প্রতিমূর্তি। তাঁরা যে সংসারকে বাইরে থেকে এসে আগলাচ্ছেন, সে সংসারের কেন্দ্রে আছে একটি উষ্ণতাময় রান্নাঘর।
আসলে এই রান্নাঘরের সঙ্গে প্রথম বা দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদীদের প্রচণ্ড সমস্যা, অস্বীকার আছে, ছিল। এবং তাঁদের অবশ্যই ধারণা, মেয়েদের উপর এই কর্তব্যের ভার, সেবা ও যত্নের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়, ও হয়েছে চিরকাল। যেমন, সিমোন দ্য বোভোয়া মেয়েদের রোজকার অবৈতনিক গৃহকর্মকে মনে করতেন একঘেয়ে ছুটিহীন পুরস্কারহীন।
অথচ, এই রান্নাঘর-সংসার চক্রের খুঁটিনাটি যে নারীবিশ্বের কত বড় ডকুমেন্টেশন, তা ভুলে যান নারীবাদীরা। সাম্প্রতিক ‘কেয়ার এথিক্স’ বা সেবা নীতির প্রবক্তা ক্যারল গিলিগান, ভার্জিনিয়া হেল্ড, নেল নডিংস ব্যাপারটাকে অন্য ভাবে দেখেন। তাঁরা মনে করেন, এই সেবা ও যত্ন মেয়ে বা পুরুষ যে-ই করুক না কেন, এগুলোর প্রয়োজন যে সমাজে আছে, তা অনস্বীকার্য। টাকা দিয়ে আজকাল সেবা কেনা হয়, ভালবাসা বিনামূল্যের জিনিস। হয়তো সেই জন্যে আজকাল সহজে তা পাওয়া যায় না।
কেয়ার এথিক্স-এর দিক থেকে দেখলে লীলা মজুমদারের মাসিমারা বাস্তব শুধু না। তাঁদের নিজস্ব কেন্দ্রটি অক্ষত রেখেই তাঁরা পা রেখেছেন জীবন বৃত্তে। এজেন্সি তুলে নিয়েছেন। রান্নাঘরকে না ভালবাসার অধিকার যদি মেয়েদের থাকে, রান্নাঘরকে ভালবাসার অধিকারও মেয়েদের আছে। রান্নাঘরের রাজনীতি এক বাস্তব বস্তু। সেই বাস্তবতাকে এক ভাবে দেখিয়েছেন আশাপূর্ণা। অন্য ভাবে লীলা মজুমদার। সদর্থক ফিল গুড তা সর্বদা নয়।
লীলার অবহেলিত লেখাগুলি আমরা যেন উপেক্ষা না করে আর এক বার নতুন ভাবে পড়ে দেখি। তা হলে হয়তো মহাশ্বেতা দেবীর লীলা-প্রয়াণের পর বলা কথাগুলি আর এক বার অনুধাবন করতে পারব। মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন— লীলাদির বড়দের লেখা (চীনে লণ্ঠন, ঝাঁপতাল) যথেষ্ট আলোচিত নয়। অবশ্যই ওই সব লেখা সেই সমাজকে, সময়কে নিয়ে, যা তিনি জানতেন। ইতিহাস প্রত্যহ লিখে চলে মানুষ। লীলাদির মনে মানুষের মুক্ত মন, ভালবাসা ও বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ জায়গা দেওয়া, এগুলোই ছিল বিচার্য।
লীলাদির বড়দের লেখার মধ্যে যে মস্তিষ্কগ্রাহ্যতা বা ‘সেরিব্রাল অ্যাপ্রোচ’ পাই, তা বোধ হয় বাঙালি পাঠকের খুব চেনাজানা নয়। কিন্তু ‘সাহিত্য’ বুঝতে গেলে তো পাঠক এবং গবেষকদের মুক্তমনাও হতে হবে। বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক ক্ষেত্র আজও পড়ে আছে, যার প্রতি ন্যায়বিচার হয়নি। অনুরোধ, আর এক বার প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাসগুলি পড়ে দেখুন। যে আমরা ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড, ভার্জিনিয়া উলফ পড়ে ধন্যবাদ দিই, সেই আমরা লীলা মজুমদারের গল্পের ৮০ শতাংশ বাস্তবের সঙ্গে ২০ শতাংশ ফিল গুড মিশ্রিত এক আশ্চর্য ডকুমেন্টেশন পড়ে হতাশ হব না।
যশোধরা রায়চৌধুরী, বিধান নগর, উত্তর ২৪ পরগনা