সরলা দেবী চৌধুরাণী। —ফাইল চিত্র।
‘সিংহাসনটা ছেড়ে দাও’ (২৫-৬) শীর্ষক প্রবন্ধে স্বাতী ভট্টাচার্য স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে সরলা দেবী চৌধুরাণীর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের এবং চিন্তার নজির তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা যুক্ত করতে চাই। সরলা দেবী এক দিনে তৈরি হননি। তাঁর এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পিছনে কারণ কী? সেই যুগে খুবই অল্প সংখ্যক মহিলা সামাজিক কাজে এগিয়েছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা ভেবেছেন বা যোগ দিয়েছেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, সামাজিক বা রাজনৈতিক ভাবে যে মহিলারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁদের পিছনে অবশ্যই কোনও না কোনও পুরুষের সহযোগিতা তথা ভূমিকা ছিল। মোহিনী দেবীর মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর সহযোগিতায় তিনি ছিলেন ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রথম ছাত্রী। এর পর তিনি রামতনু লাহিড়ী ও শিবনাথ শাস্ত্রীর সংস্পর্শে আসেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন। বাসন্তী দেবীর আত্মত্যাগের তুলনা নেই। সংসারের দায়িত্বের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী। উর্মিলা দেবী ছিলেন দেশবন্ধুর ছোট বোন। ‘নারী সত্যাগ্রহী সমিতির’-র সভানেত্রী ছিলেন। তিনিও অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। নেলী সেনগুপ্ত ইংরেজ কন্যা হলেও বিপ্লবী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ দেশের মানুষের সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন।
ননীবালা দেবী নানা ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে বাড়ি এলে তাঁর ভাইপো বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় এগিয়ে যান। মেদিনীপুরের চারুশীলা দেবীর বাড়িতে ক্ষুদিরাম এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে যাওয়ার ঠিক আগে। যাওয়ার সময় পাতানো বিধবা দিদিকে রক্ততিলক পরিয়ে শপথ করিয়ে নেন, বাকি জীবন দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করার। তার পর চারুশীলা বিভিন্ন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সরলা দেবীর সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পরিবারের কন্যা হওয়ার কারণে। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে এবং স্ত্রী-স্বাধীনতাকে মূল্য দিতে এই পরিবারের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা পোশাকআশাকে, সঙ্গীতে, ছবি আঁকায়, সাহিত্যচর্চায়, স্বদেশপ্রেমে এবং স্বাধীন দেশ গড়ার কাজে বাংলার মেয়েদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকে এই বাড়িতে পশ্চিমি সংস্কৃতির সুগন্ধ ঢুকে পড়ে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও ছিলেন স্ত্রী শিক্ষায় উদ্যোগী। অন্তঃপুরিকাদের নিয়মিত পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল। সরলার উপর তাঁর বিদুষী, সাহিত্যিক মা স্বর্ণকুমারীর প্রভাব যেমন পড়ল, তেমনই তিনি বিভাসিত হলেন তাঁর মামাদের মনীষায়। ফলে, সরলার স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠা স্বাভাবিক।
সরলা দেবী এবং তাঁর মতো কতিপয় বাঙালি মেয়ের সঙ্গে বাংলার নারী সমাজের অনেক ফারাক ছিল। কারণ, তৎকালীন পুরুষ-সমাজের অনিচ্ছা ও অসহযোগিতা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং বিদ্যাসাগরের অনুরোধে ও উদ্যোগে বারাসতের কালীকৃষ্ণ দত্ত বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে বিশেষ বিশেষ বাড়ির মেয়েরা ছাড়া কেউ যেত না। যে সব বাবা মেয়েদের পাঠাতেন, তাঁদের অনেক টিপ্পনী শুনতে হত। প্রাচীনপন্থীরা প্রচার করত, পড়াশোনা করলে বিধবা হবে। বহুবিবাহ, গৌরীদান, বিধবা-বিবাহের বিরুদ্ধাচরণ— বেশির ভাগ পুরুষ এ সবের সমর্থক ছিলেন। ফলে সরলা দেবীর মতো মেয়েদের লড়াই ও মতামত তেমন প্রচার পেত না। তাঁদের প্রধান অন্তরায় ছিল তখনকার পুরুষ সমাজ। যে প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রে আজও রয়ে গিয়েছে।
প্রবীর চক্রবর্তী, গোচারণ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
‘তাজমহল’
রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের তিন মাসের মধ্যে সরলা দেবী ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে লিখেছিলেন, ‘রবিমামা না রবীন্দ্রনাথ?’ শীর্ষক রচনা। সেখানে তিনি লিখছেন, তাঁকে মানুষ করেছিলেন বাইরে থেকে বঙ্কিম, যেমন গাছকে বাইরের আকাশ-বাতাস অক্সিজেন প্রভৃতি দিয়ে বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু মূল থেকে রস দিয়ে তাঁর শৈশব-কৈশোরকে যিনি সিক্ত করেছিলেন, তিনি তাঁর রবিমামা। সরলাদেবী তাঁর মানসিক গঠনের উপাদান রবীন্দ্রনাথের থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন, লিখেছেন তিনি। ভারতী-তে ‘প্রেমিক’ নামে একটি অস্বাক্ষরিত রচনা পড়ে সরলার প্রশংসা করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সে লেখা যেন পাকা প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা। তাতে কিশোরী সরলা অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়েছিলেন। তাঁর এই ‘রবিমামা’ যখন থেকে ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে উঠেছেন, তার বর্ণনা মেলে সরলার ভাষায় উক্ত রচনায়— “কিন্তু রবিমামার সঙ্গে সংস্পর্শ ততই হারাতে থাকছিলুম যত তিনি রবীন্দ্রনাথে প্রসারিত হতেছিলেন। তাঁর সীমাময় গণ্ডী যতই অসীমের দিকে হাত বাড়াতে লাগল ততই আমাদের ক্ষুদ্র দুহাতের বেষ্টনে তাঁকে ঘিরে রাখা কঠিন হতে লাগল। বিশ্বভারতী তাঁকে একটা গণ্ডীর মধ্যে বাঁধলে। সেখানে গুটিকয়েক মানুষ দ্বারা তিনি পরিবেষ্টিত, তাদেরই তিনি আপনজন” (ভারতবর্ষ, কার্তিক ১৩৪৮)। ভাগ্নি সরলা তাঁর রবিমামার তিরোধানের তিন বছর পরে বলছেন, “যে সকল উৎসব অনুষ্ঠান জোড়াসাঁকোতে ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পরিবারগত, তাঁর মৃত্যুর পর থেকে ক্রমশ হয়ে গেল তাঁর কীর্তিমান কনিষ্ঠ পুত্রের প্রতিষ্ঠানগত। মহর্ষির প্রচলিত উৎসবাদিতেও আর তাঁর রক্তের বলেই কারো রক্তগত অধিকার নেই। মহর্ষি ও তাঁর বংশের জোড়াসাঁকোস্থ কীর্তিকলাপ পাশ কাটিয়ে গেছে চলে শান্তিনিকেতনে, যার ছাতিম তলার বুনিয়াদের উপর গড়ে উঠেছে অভ্রভেদী রবীন্দ্র তাজমহল” (জীবনের ঝরাপাতা, দশম অধ্যায়)।
১৯৩৫ সালে সরলার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন তাঁর গুরু বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। সরলার শেষ জীবনের কীর্তি গুরুর বাণী অবলম্বনে সঙ্কলিত গ্রন্থ বেদবাণী প্রকাশিত হয় ২৩ খণ্ডে (বর্তমানে তিন খণ্ডে সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার পুনরায় প্রকাশ করেছে)। যে সরলা বিবেকানন্দের কর্মযোগ পুস্তিকা উপহার পেয়ে ভগবদ্গীতার প্রতি প্রথম দৃষ্টি দেন, সেই সরলা শেষ দশ বছরে নিজের জীবনকে গড়ে তুললেন কৃষ্ণময় গুরু বিজয়কৃষ্ণের সান্নিধ্যে।
শৈবাল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-২৬
অনমনীয়
ঠাকুরবাড়ির ‘অগ্নিকন্যা’ সরলা দেবী তাঁর মৃত্যুর প্রায় আশি বছর পরেও কেন প্রাসঙ্গিক, সে বিষয়ে যথার্থ মত প্রকাশ করেছেন স্বাতী ভট্টাচার্য। রাজনীতিতে মেয়েদের জন্য প্রকৃত অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন অনমনীয়। তাঁর তীব্র আত্মসম্মান বোধের জন্য তাঁর কাছের দুই বিখ্যাত ব্যক্তিও তাঁকে দূরে ঠেলেছিলেন— রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী। স্বাধীনতার আগে-পরে আমরা সরোজিনী নায়ডু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, ইন্দিরা গান্ধী, জয়ললিতা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো হাতেগোনা নেত্রীকে পেয়েছি। কিন্তু রাজনীতিতে অধিকাংশ মহিলার যোগদান কোথায়? বহু ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের মহিলা প্রতিনিধির বকলমে কাজ করেন তাঁর স্বামী বা শ্বশুর, এই বাস্তব চিত্রটি সর্বজনজ্ঞাত। বরং, কোভিডকালে যে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে ‘রেড ভলান্টিয়ারস’ নাম নিয়ে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন, কলেজপড়ুয়া, বামপন্থী রাজনীতি সচেতন কিছু মেয়ে এ বার পঞ্চায়েতে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। সেই যুবনেত্রীরা মানুষের মনে আশা জাগাচ্ছেন।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
নামাঙ্কিত স্কুল
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রিয়নগরের (চাকদহ, নদিয়া) বাড়িতে সরলা দেবী চৌধুরাণীর নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানেই প্রথম সরলা দেবীর ছবি দেখি, এবং তাঁর প্রতি কৌতূহলী হয়ে উঠি। জানতে পারি, তিনি ভারতের জাতীয় আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে দেশের প্রথম মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তার শাখা খুলে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেন।
সুব্রত শঙ্কর ভদ্র, কলকাতা-১০৭