ভারতীয় সংবিধানের ১২৪(ক) ধারায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলতে এমন অপরাধকে বোঝায়, যেখানে কেউ তাঁর কথা, লেখা, বা আচরণের মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ালে, আইন অমান্য করলে বা অন্যায় করায় উস্কানি দিলে বা করার চেষ্টা করলে, যা আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে; তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা যায়। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬০ সালে টমাস মেকলে প্রবর্তিত ভারতীয় দণ্ডবিধির আইনটি ১৮৯০ সালে সংবিধানের ১২৪(ক) ধারায় যুক্ত হয় দেশদ্রোহিতার একটি বিশেষ আইনের ধারা হিসেবে। সেই সময় দমন-পীড়নমূলক এই আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সভা-সমাবেশ দমন করা, বিপ্লবীদের কার্যধারা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিকে শ্লথ করে দেওয়া।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই ঔপনিবেশিক আইনের কোনও যৌক্তিকতা আছে কি? ভারত দেশটি তো স্বাধীন দেশ, সংবিধানের মৌলিক অধিকারে বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সেখানে সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে নাগরিকরা কথা বলতে পারবেন না! রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে আটক করে জেলে ঢোকানো হবে কেন? এই ভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার নাগরিকদের স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে দমন করে রাখার জন্য এই আইন প্রয়োগের জুজু দেখাবে, একে কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। প্রশ্ন জাগে, ঔপনিবেশিক আইনগুলো কেনই বা বহন করল স্বাধীন ভারত? বলা যায়, ১৯৬০ সালের পরে ক্রমশ ওই আইনের প্রভাব বেড়েছে, কমবেশি সব দলই সব রাজ্যে এই আইনের প্রয়োগ করেছে। আমরা দেখেছি, আফস্পা বা এই ধরনের জুলুমবাজির আইন প্রয়োগ করে নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসীকে প্রজা বানিয়ে রাখার রাষ্ট্রীয় কৌশল এটা।
সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক অবস্থান গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে অনেকটাই স্বস্তির বাতাস এনেছে। সময় এসেছে পর্যালোচনার— রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের আর কোনও প্রয়োজন আছে কি? দেশবিরোধী কাজ কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত মত প্রকাশের অধিকার থাকুক। স্বাধীন দেশে এটাই কাম্য, কারণ দেশটি গণতান্ত্রিক। এখানে বিরোধীদের গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার থাকুক। আমরা আশা করতেই পারি, সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকদের যুক্তিসঙ্গত মতামত প্রকাশের অধিকার বহাল রাখবে, আর এর জন্য রাষ্ট্রের কশাঘাত নাগরিকদের উপর নেমে আসবে না।
পরেশনাথ কর্মকার, রানাঘাট, নদিয়া
অগ্নিমূল্য ওষুধ
প্রতিটি পরিবারকেই আয়ের একটি বড় অংশ ওষুধের জন্য ব্যয় করতে হয়। উৎপাদিত ওষুধের পরিমাণের হিসেবে পৃথিবীতে ভারতের স্থান চার নম্বরে। মূল্যের হিসেবে তার স্থান চোদ্দো নম্বরে। এমন ফারাকের কারণ হল, অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ওষুধের দাম কম। তা সত্ত্বেও দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরেই থেকে যায় অত্যাবশ্যক ওষুধ। শুরুর দিকে সরকার ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ব্যবস্থা করলেও, এখন মূল্যনিয়ন্ত্রিত ওষুধের সংখ্যা কমছে। আইনের ফাঁক খুঁজে ওষুধ-কোম্পানি বাড়িয়ে চলেছে ওষুধের দাম।
১৯৪৭ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি ওষুধের দামের উপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ১৯৬২-র চিন-ভারত যুদ্ধের সময় যাতে ওষুধের দাম না বাড়ে, তাই ১৯৬২-তে ওষুধের মূল্য প্রদর্শন আদেশ ও ১৯৬৩-তে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ আদেশ ঘোষিত হয়। ১৯৬৩-এর আদেশের বলে সে বছর ১ এপ্রিল যে ওষুধের যা দাম ছিল সে দামেই বেঁধে রাখা হয়।
১৯৬৬-র ওষুধের মূল্য প্রদর্শন ও নিয়ন্ত্রণ আদেশে বলা হয় সরকারের অনুমতি না নিয়ে কোনও ওষুধ-কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়াতে পারবে না। ১৯৭০-এ অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের তিন নম্বর ধারায় ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ আদেশ জারি করা হয়। এই আদেশের ফলে ওষুধের দামের উপর সরকারের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আসে, আর ওষুধ-কোম্পানিগুলো কতটা লাভ করতে পারবে, তার উপর আসে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ। বলা হয় কোনও কোম্পানির কর দেওয়ার আগে (প্রি-ট্যাক্স) লাভ তার মোট ওষুধ বিক্রির ১৫%-র বেশি হতে পারবে না। অন্যথায় অতিরিক্ত লাভ সরকারের ঘরে জমা পড়বে। ১৯৭৪ সালে ভারত সরকার তৎকালীন কংগ্রেস সাংসদ জয়সুখলাল হাতির নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করে ওষুধ-শিল্পের অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য। ১৯৭৫-এ ‘হাতি কমিটি’ তার রিপোর্ট পেশ করে। তার সুপারিশ ছিল, সরকারি ক্ষেত্র যেন ওষুধ উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা নেয়। দেশীয় ওষুধ-কোম্পানিগুলোর উন্নতির জন্য কিছু ওষুধের উৎপাদন কেবল দেশীয় সংস্থার জন্য সংরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়েছিল। ওষুধ-কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগের মাত্রা তৎক্ষণাৎ কমিয়ে ৪০% করা এবং তার পর কমিয়ে ২৬% করার কথা বলা হয়েছিল, এমনকি বিদেশি ওষুধ-কোম্পানিগুলোর জাতীয়করণের পক্ষে ছিল হাতি কমিটি। এই কমিটি বলে, মাত্র ১১৭টা ওষুধ দিয়ে অধিকাংশ মানুষের অধিকাংশ রোগের চিকিৎসা করা যায়। অথচ, ভারতের ওষুধ-বাজারে তখন প্রায় ৬০ হাজার ফর্মুলেশন ছিল।
১৯৭৯-এর ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ আদেশে ওষুধগুলোকে কয়েকটা শ্রেণিতে বিন্যস্ত করে, কাঁচামালের দাম, উৎপাদন খরচ, প্যাকেজিংয়ের খরচ ধরে ওষুধের সর্বোচ্চ দাম নির্ণয় করার নিয়মও ঠিক করা হয়েছিল। তবে ১৯৮৪ সালে কেলকার কমিটি বেশ কিছু ওষুধের দামে নিয়ন্ত্রণ হটিয়ে দেয়। এর পরে ১৯৮৬-র ওষুধ নীতিতে মোড় ঘুরল— কম খরচে ভাল মানের ওষুধ উৎপাদনের স্বার্থে এবং নতুন প্রযুক্তির স্বার্থে ওষুধ-শিল্পে পুঁজি নিবেশে উৎসাহ দেওয়া হল। এ বার মোট ১৫টা ওষুধকে রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানির উৎপাদনের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। মূল্যনিয়ন্ত্রিত ওষুধের সংখ্যাও ৩৪৭টা থেকে কমিয়ে করা হয় ১৪২। ওষুধের কাঁচামালের উপর বাণিজ্যিক লাইসেন্স তুলে দেওয়া হল। ওষুধের সমস্ত কাঁচামাল, মধ্যবর্তী উৎপাদন ও ফর্মুলেশন তৈরিতে ৫১% অবধি বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করা হল। ১৯৮৬-র পর থেকে সরকারি সংস্থার জন্য সংরক্ষিত ওষুধের সংখ্যাও ক্রমশ কমেছে।
এই সব কিছুর ফলে ক্রমশ বেড়েছে ওষুধের দাম। সরকার যাতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করতে পারে, তার জন্য স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচের অন্তত ১৫% নির্দিষ্ট করতে হবে। অত্যাবশ্যক তালিকায় থাকা ওষুধ সরকারকেই সরবরাহ করতে হবে। ভাল গুণমানের জেনেরিক ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
গৌতম সিংহ রায়, জঙ্গিপুর, মুর্শিদাবাদ
দৃষ্টান্ত
নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার প্রতাপপুর গ্রামের প্রদীপ হালদারের অধ্যবসায়ের প্রশংসা করা উচিত (‘বলতে হবে, ওই যে প্রদীপ ডাক্তার’, ২৬-৫)। তিনি বাইশ বারের প্রচেষ্টায় ডাক্তারির জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। বিজ্ঞান শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে এই পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর কলকাতা হোমিয়োপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পান। তাঁকে দেখে সহজে হার না মানার সঙ্কল্প করা উচিত।
সৌরভ মালিক, বিষ্ণুপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা