বাঙালির উচিত ইংরেজি শিখে বাংলাকে আরও উন্নত করে তোলার চেষ্টা করা। প্রতীকী ছবি।
‘ইংরেজির জোর’ (সম্পাদক সমীপেষু, ২৫-৩) শীর্ষক চিঠি প্রসঙ্গে এই লেখা। পত্রলেখক বাঙালির বাংলা ভাষাপ্রীতিকে (যদি তা আদৌ থেকে থাকে) ‘আদিখ্যেতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, “ব্যবহারিক কী লাভ হবে বাংলা শিখে? সেই সময় ইংরেজি শিখলে বরং পেটের ভাত জোটা সহজতর হবে।” এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, পত্রলেখকের মতে বাংলা শিক্ষার জন্য সময় ব্যয় করলে ‘পেটের ভাত জোটা’-র মতো ইংরেজি শেখা যায় না। তাঁর এই মত সমর্থন করতে গেলে বর্তমানে বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক, বা কর্পোরেট চাকুরে, বা সর্বভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক, তাঁদের কত জন বাংলা মাধ্যমে আর কত জন ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছেন, তার পরিসংখ্যান দরকার এবং সেই পরিসংখ্যানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া বাঙালিদের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার। তা না পাওয়া গেলে এই বিশ্লেষণের মূল্য কতটুকু?
এই পত্রে লেখক বলেছেন, নিজের ভাষা ছেড়ে অন্যের ভাষা আপন করাই জাতির উন্নতির উপায়। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির দিকে তাকালে অবশ্য অন্য কথাই মনে হয়। চিনে সমস্ত কাজ হয় ম্যান্ডারিন ভাষায়। জাপানি মাত্র ১২ কোটি মানুষের মাতৃভাষা, যেখানে বাংলাই ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। কিন্তু জাপানের শিক্ষা-সহ সব কাজ হয় জাপানি ভাষায়। অতএব পত্রলেখক-নির্দেশিত পন্থায় বাঙালির উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
বাঙালির উচিত ইংরেজি শিখে বাংলাকে আরও উন্নত করে তোলার চেষ্টা করা। এর জন্য চাই বাংলায় নতুন নতুন পরিভাষা তৈরি, বিজ্ঞানের বিষয়কে সহজে উপস্থাপন করা, ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যের অনুবাদে খটমট বাংলা এড়িয়ে সহজবোধ্য ভাষায় লেখার রীতি আয়ত্ত করা। সারা দেশে আজ ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’এর জিগির তুলে বাংলা-সহ ভারতের সকল অ-হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রান্তিক করে দেওয়ার ফ্যাসিবাদী চক্রান্ত চলছে। আলোচ্য পত্রে প্রকট ইংরেজি-সাম্রাজ্যবাদ এই হিন্দি আগ্রাসনের হাতই শক্ত করবে।
জিতাংশু নাথ, কলকাতা-৫৯
দল ও দুর্নীতি
‘চক্রগতির দোহাই’ (২৬-৩) সম্পাদকীয়তে যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তার মূল সুরের সঙ্গে একমত হয়েও দু’-একটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। এ কথা ঠিক যে, দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা সকলেই অন্যরা কত দুর্নীতিগ্রস্ত, সেটা দেখিয়ে নিজেদের অপরাধকে লঘু করে দেখাতে চাইছে। এটা শুধু যে তৃণমূল কংগ্রেস করছে তাই নয়, অতীতে বামফ্রন্ট শাসনের সময়েও এই একই যুক্তি উত্থাপন করতে দেখেছি। যখনই বামেদের বিরুদ্ধে কোনও গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে, তখনই অন্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করে তাঁরা বলেছেন, অন্য রাজ্যে যত অপরাধ হয় তার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কত ভাল। আর সে দিনের কথা যাঁদের স্মরণে আছে, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, পার্টি অফিস থেকে ‘অ্যাপ্রুভ’ হওয়া তালিকায় কারও নাম না থাকলে তার চাকরি হওয়া তখন কঠিন ছিল। আর্থিক লেনদেন যে খুব কম হত, তা-ও নয়। তবে সে দিন দুর্নীতির উপরও দলীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল, আজকের মতো বেলাগাম ছিল না।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাক্ষেত্র-সহ সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা যে ভাবে দুর্নীতিকে একেবারে নিচু স্তর পর্যন্ত প্রসারিত করেছেন, তা এক কথায় নজিরবিহীন। তাই একবাক্যে সকলেই নিন্দা করেছেন। কিন্তু সেই দুর্নীতি মোদী-আদানির দুর্নীতির তুলনায় কতটুকু? শুধু তো কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতিই নয়, বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে দুর্নীতির বাইরে কে আছে? কেন এমন হচ্ছে, তার উত্তর খোঁজা দরকার।
আমরা জানি, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ প্রজা শাসন ও শোষণের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। তবু সেই সমাজের সূচনা পর্বে অনেক প্রজাবৎসল, গুণিজনের পৃষ্ঠপোষক রাজার কথা শোনা যায়। কিন্তু ওই সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শেষ পর্যায়ে দেখা যায় চূড়ান্ত স্বৈরাচারী, ব্যভিচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজকর্মচারী, রাজা বা সামন্তপ্রভুদের। এটাই সমাজ বিকাশের নিয়ম। পুরনো একটা অবক্ষয়ী সমাজকে ভেঙে যখন নতুন একটা সমাজ গঠনের সূচনাপর্বে প্রগতিশীলতা দেখা যায়, ক্রমে তা প্রতিক্রিয়াবাদী শক্তিতে পরিণত হয়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অবক্ষয়ের যুগে তার গর্ভেই নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হয় নতুন শক্তি— প্রথমে বণিক শ্রেণি, পরে শিল্পপতি শ্রেণি। এঁরাই সে দিন নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষকতা করে সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে ভাঙার জন্য নতুন শক্তির জন্ম দিয়েছিল। তাতে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশও দ্রুত বেগে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এই নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হল লাভ, সর্বোচ্চ লাভ। এই নতুন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা তার নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই আটকে গেল। শ্রমিককে শোষণের ফলে মালিকের লাভ যত বাড়ে, শ্রমিকের কেনার ক্ষমতা তত কমতে থাকে। সৃষ্টি হয় বাজার সঙ্কট। মালিক লাভের আশায় নানা অনৈতিক পথ নিতে থাকেন। আদানির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ায় এমন আকছার ঘটছে। ধনতান্ত্রিক সমাজকে টিকিয়ে রেখে নৈতিক উন্নতি কি সম্ভব? বরং যারা এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে, তাদের মনের গভীরে সংক্রমিত হবে দুর্নীতির ছায়া। আজ কেন্দ্রে বা রাজ্যে যে দল যেখানে সরকার চালাচ্ছে, সেখানে তার লক্ষ্য এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা। তাই দুর্নীতি কারও পিছু ছাড়ছে না।
সুব্রত গৌড়ী, কলকাতা-১২
আনাজ-বাগান
‘মিড-ডে মিলের খরচ কমাতে স্কুলে আনাজ ফলানোর নির্দেশিকা’ (২৬-৩) শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, স্কুলে স্কুলে ‘কিচেন গার্ডেন’, অর্থাৎ ‘আনাজের বাগান’ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই আনাজের বাগান মিড-ডে মিলে সহায়ক হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষা দফতরের এই নির্দেশ অবশ্যই ভাল পদক্ষেপ। এখন প্রাথমিক স্কুলে মিড-ডে মিলে পড়ুয়াপিছু বরাদ্দ মাত্র ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের বরাদ্দ ৮ টাকা ১৫ পয়সা। সঙ্গে অবশ্য ভাতের চালটা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এই কম বরাদ্দে মিড-ডে মিল চালাতে আছে নানা সমস্যা। পড়ুয়াদের পুষ্টি বাড়ানোর জন্য জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি গত দু’মাসে পড়ুয়াপিছু সপ্তাহে অতিরিক্ত বরাদ্দ ছিল ২০ টাকা করে। মার্চ ও এপ্রিল মাসের জন্য পড়ুয়াপিছু সপ্তাহে সেই বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ টাকা করে। এই অতিরিক্ত বরাদ্দে পড়ুয়াদের ডিম, ফল ও মাংস খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। এপ্রিল মাসের পর অতিরিক্ত বরাদ্দ কমে গেলে আবার দেখা দেবে পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য পয়সা জোগানোর সমস্যা।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা দফতরের নির্দেশ, স্কুলে স্কুলে চালু হোক ‘কিচেন গার্ডেন’। এই বাগান করার জন্য প্রাথমিক স্কুলপিছু বরাদ্দ করা হয়েছে ৫০০০ টাকা। উদ্দেশ্য মহৎ— নিজেদের বাগানে আনাজ চাষে আনন্দ, আর সেই আনাজপাতি মিড-ডে মিলে ব্যবহার করে কিছুটা খরচে সাশ্রয়। আমি হাওড়া জেলার আমতার অনেক জায়গায় সরকারি এই নির্দেশের আগে থেকেই স্কুলগুলিতে আনাজের বাগান দেখেছি। এখন প্রায় আমতার সব স্কুলেই এই বাগান হয়েছে। কুমড়ো, ঢেঁড়স, টমেটো, পটল, চিচিঙ্গা, লঙ্কা ও নানা ধরনের আনাজপাতি চাষ করে তারা বেশ আনন্দে আছে। ছোট থেকেই পড়ুয়াদের বিভিন্ন ধরনের আনাজ চেনা ও গাছ পরিচর্যায় আগ্ৰহ বাড়ছে।
তাজা আনাজপাতি পেয়ে পড়ুয়ারাও খুশি। যাদের স্কুলে জায়গা নেই, তারা ‘ছাদ বাগান’ করে আনন্দ পেয়েছে। সামান্য কিছু অসুবিধা থাকলেও, স্কুলে আনাজের বাগান তৈরি করার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। মিড-ডে মিলে সহায়ক তো বটেই। সব স্কুলেই চালু হোক এই বাগান, তবে দেখতে হবে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে, যাতে জৈব পদ্ধতির চাষে জোর দেওয়া যায়।
দীপংকর মান্না, আমতা, হাওড়া