—প্রতীকী ছবি।
ইদানীং সংবাদপত্র খুললেই সন্দেহভাজন অভিযুক্তকে মারধরের বিভিন্ন খবর আমাদের প্রত্যেকেরই নজরে আসছে! বৌবাজারের সরকারি ছাত্রাবাসে মোবাইল চুরির ঘটনায় মৃত ইরশাদ আলমের কথা প্রকাশিত হয়েছিল “ছাত্রাবাসে ‘পিটিয়ে খুনের’ অভিযোগ” (২৯-৬) শীর্ষক প্রতিবেদনে। সল্টলেকের পোলেনাইট এলাকাতেও মোবাইল চুরির অভিযোগে এক যুবককে পিটিয়ে মারা হয়! এ ছাড়া সম্প্রতি ছেলেধরা সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন অনেক মহিলাকে শারীরিক ভাবে হেনস্থা করার বিভিন্ন খবরও সংবাদপত্র পড়েই জানতে পেরেছি! মোদ্দা কথাটা হল— কোনও একটা ঘটনা ঘটলে পুলিশ-প্রশাসনের দ্বারস্থ না হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে! এর অন্যতম কারণ হল— হতাশা অথবা অবসাদ!
জীবনে চলার পথে প্রত্যেক মানুষেরই নানান ধরনের অপূর্ণতা ও অপ্রাপ্তি থাকে! রক্তমাংসের মানুষ আমরা! স্বভাবতই আমাদের প্রত্যেকের মনে আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা— এগুলো থাকবেই! আর এগুলি যখন পূর্ণতা না পায়, তখন তৈরি হয় সুতীব্র ক্ষোভ! আর এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে হতাশা বা অবসাদে পর্যবসিত হয়! আর্থিক অনটন, সাংসারিক টানাপড়েন, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, অফিসে বসের চাপ, দাম্পত্য কলহ— ইত্যাদির অভিঘাতে জর্জরিত মানুষ সঠিক জায়গায় ক্ষোভ উগরাতে না পেরে ছটফট করতে থাকে! নিজের অবদমিত সেই আক্রোশেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বৌবাজার, সল্টলেকের মতো ঘটনায়! যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাসক দল ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদেও সুবিধা তোলে অনেকে! সম্প্রতি চোপড়া এলাকায় বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত থাকার অভিযোগে এক মহিলাকে বাঁশের কঞ্চির গোছা দিয়ে মারধরের অভিযোগ উঠে এসেছে তাজিমুল হক নামক এক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে!
এ সব ক্ষেত্রে পুলিশকে সক্রিয় পদক্ষেপ করতে হবে! শাসক দলের লোক হলেও অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ খতিয়ে দেখে মারধরে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করতে হবে! আর আমাদের মতো যারা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ, তাদের সব সময়ই একটা কথা মাথায় রাখতে হবে— কোনও অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না! পুলিশ-প্রশাসনের প্রতি আস্থা ও ভরসা রাখতে হবে! সন্দেহভাজনের উপর নিজেদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে!
সৈকত কর্মকার, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
অ-সুস্থ সমাজ
সংবাদপত্রের মাধ্যমে বেশ কয়েক দিন ধরে জানতে পারছি ছেলেধরা গুজবের জেরে গণপ্রহার চলছে বিভিন্ন জেলায়। অনেক ক্ষেত্রেই তার ফলে মৃত্যুও ঘটছে। মোবাইল চুরির অভিযোগে কলকাতার ছাত্রাবাসে গণপ্রহারে মৃত্যু হয়েছে ইরশাদ আলমের, আবার ঝাড়গ্রামে বেড়াতে গিয়ে চোর সন্দেহে মারধর করায় মৃত্যু হয়েছে সৌরভ সাউয়ের। এই ভয়ানক হিংসাত্মক ঘটনা থেকে মহিলারাও বাদ যাননি। চাকদহ ব্লকের দুবড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে ছেলেধরা সন্দেহে বাড়ি বাড়ি ঘুরে জিনিস বিক্রেতা দু’জন মহিলাকে জনগণ মারধর করে।
মানুষ এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে কেন? কাউকে সন্দেহ হলে স্থানীয়রা পুলিশকে জানাতে পারেন বা তাঁকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। কিন্তু রাগ বা হিংসার বশবর্তী হয়ে কোনও রকম প্রমাণ ছাড়াই মানুষকে বেধড়ক মারা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। অবাক হচ্ছি, উপস্থিত জনতার মধ্যে কি কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন না? যখন কাউকে প্রহার করা হচ্ছে, তখন অন্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেন কেন? এই গোষ্ঠীবদ্ধ অত্যাচার এক সামাজিক ব্যাধি। ছেলেধরা বা চোর সন্দেহে সাধারণ পোশাক পরিহিত মানুষজন, গরিব অচেনা লোককে দেখামাত্রেই গণরোষের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে। ছেলেধরা সন্দেহে ধৃত ও প্রহৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে কোনও অপহৃত শিশুকে এখনও অবধি পাওয়া যায়নি, অথচ তাঁরা গণরোষের শিকার হলেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পঞ্চায়েত, প্রশাসন ও সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে এই ব্যাধি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। না হলে সুস্থ সমাজ তৈরি কখনও সম্ভব নয়।
রতন নস্কর, সরিষা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
গুজব রাজ্য
বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকার পর আবার রাজ্যে কয়েকটি জায়গা ছেলেধরা গুজবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গুজব কত মারাত্মক, ক্ষতিকর, তা আমরা অতীতে দেখেছি। এখন সমাজমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সত্য না জেনেই কিছু মানুষ সমাজমাধ্যমে বিভিন্ন রকমের পোস্ট করে গুজব ছড়াচ্ছেন। এখনও পর্যন্ত যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে শিশু পাচারের যোগ থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই সব ঘটনা পুলিশ-প্রশাসনকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সমাজমাধ্যমে যাঁরা সত্য না জেনে গুজব ছড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ-প্রশাসন মাইক হাতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করুক— কেবল ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে মারধর না করে যেন পুলিশকে খবর দেয়। একমাত্র পুলিশ-প্রশাসনের নিবিড় নজরদারি, সমাজমাধ্যমে যাঁরা গুজব ছড়াচ্ছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও মারধরের ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানই ছেলেধরা গুজবে রাশ টানতে পারে।
অপূর্বলাল নস্কর, ভান্ডারদহ, হাওড়া
অমানবিক
একের পর এক গণপ্রহারের ঘটনা ঘটেই চলেছে কলকাতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কখনও চোর, কখনও ছেলেধরা এই অভিযোগে কতিপয় মানুষের অমানবিক প্রহারে প্রাণ হারাচ্ছেন, আহত হচ্ছেন অনেকে। বেশ কয়েক দিন যাবৎ বৌবাজার, সল্টলেক, বারাসত, কসবা, তিলজলায় গণপ্রহারের সংবাদ মিলেছে। জেলাগুলিতেও লাগামছাড়া ভাবে বাড়ছে নিজের হাতে আইন তুলে গণপ্রহারের শাস্তিবিধান। আইনকানুন, সামাজিক অনুশাসন, কিছুই এই অসুখ ঠেকাতে পারছে না।
কোথা থেকে আসে এত তিক্ততা? দিনকয়েক আগের বৌবাজারের ছাত্রাবাসে এক টিভি মেকানিককে মোবাইল চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠার ২৪ ঘণ্টাও কাটেনি, পরের দিনই সল্টলেকে মোবাইল চুরির অভিযোগে বেধড়ক মারধরে আহত হন প্রসেন মণ্ডল। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এই দু’টি ঘটনার আগে বারাসত, কাঁকুড়গাছি, কসবা-সহ বিভিন্ন জায়গায় শিশু চুরির অভিযোগ বা শিশু চুরি গিয়েছে গুজবকে কেন্দ্র করে একাধিক বেপরোয়া গণপিটুনির ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এই হিংস্রতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ, অবদমিত রাগ ও আক্রোশ। সংসার বা কর্মক্ষেত্রের সমস্যা মানে এই নয় যে, অসহায় মানুষ পেলে তাঁর উপর রাগ দেখিয়ে ভিতরে থাকা আক্রোশ মিটিয়ে নেওয়া যাবে। দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্তদের বেশির ভাগেরই বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। অল্পবয়সিরা ভাবছেন, বাস্তব জীবনেও বোধ হয় হিংস্রতা দেখানোই টিকে থাকার একমাত্র রাস্তা। প্রশাসনের উচিত এখনই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করা, কোনও রং না দেখে।
উৎপল মুখোপাধ্যায়, চন্দননগর, হুগলি