—ফাইল চিত্র।
‘শিক্ষার মেকি সৌধ’ (৫-৭) শীর্ষক প্রবন্ধে চিকিৎসক কুণাল সরকার মেডিক্যাল পরীক্ষায় দুর্নীতি বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি আলোয় ফেরার সন্ধানও দিয়েছেন। নবপ্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার অদূরদর্শিতা, পরীক্ষা পরিচালনায় এনটিএ-র ব্যর্থতার জন্যে। চিনের ‘গাওকাও’-এর ঠিক পরেই আসে আমাদের ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সির নাম। অথচ, এনটিএ-র পরীক্ষা পরিচালনায় দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে এল এ বারের প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারিতে।
আমেরিকার এডুকেশনাল টেস্টিং সার্ভিস বা ইটিএস-এর আদলে এনটিএ-কে গড়ে তুলেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। অথচ, এনটিএ-কে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তাই গোড়া থেকেই এনটিএ পঙ্গু। যেখানে ইটিএস-এ ২০০ জনেরও অধিক স্থায়ী কর্মী আছেন, সেখানে এনটিএ-র স্থায়ী কর্মী-সংখ্যা দু’-ডজনের আশেপাশে। স্বাভাবিক ভাবেই শুরু থেকে বিতর্কের কেন্দ্রে এনটিএ।
২০২২ সালে পরীক্ষা গ্রহণের দিন সিকিয়োরিটি চেক-এর নাম করে কেরলের একটি পরীক্ষাকেন্দ্রে মেয়েদের অন্তর্বাস পর্যন্ত খুলতে বাধ্য করা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের তরফে। যা নিয়ে এনটিএ-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল। ২০২০ সালে মধ্যপ্রদেশের এক ছাত্রী নিট পরীক্ষায় মাত্র ৬ নম্বর পেয়ে আত্মহত্যা করে। পরবর্তী কালে জানা যায়, তাঁর স্কোর হয়েছিল ৫৯০। একই বছরে অপর এক পরীক্ষার্থী অত্যন্ত খারাপ ফলাফলের জন্য পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করে। শেষে দেখা যায়, সে সর্বভারতীয় স্তরে ‘এসটি’ শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম। এ ধরনের দৃষ্টান্ত পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ঘোর সন্দেহ সৃষ্টি করে।
এ বছর নিট পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের জন্য বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এনটিএ তথা শিক্ষা মন্ত্রকের এমন শিথিলতা মেনে নেওয়া যায় না। পরীক্ষার্থীর তুলনায় আসনসংখ্যা কম হওয়ায় নিট একটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। এ ধরনের পরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দেশের মানবসম্পদ গড়ে তোলার স্বার্থ। কিন্তু কোথায় কী! প্রশ্ন ফাঁস কেলেঙ্কারিকে লঘু করে দেখানোর প্রয়াসে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই তাঁর বিবৃতি ঘন ঘন পরিবর্তন করেছেন। হয় তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন না, অথবা তিনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেয়েছিলেন। এই আবহে শিক্ষার্থীরা কতটুকু নিরাপদ, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
জয়েন্ট ফিরুক
কুণাল সরকার নিজে দীর্ঘ কাল চিকিৎসা পেশায় যুক্ত থাকায়, নিট পরীক্ষায় অনিয়মের বিস্তারিত তথ্য পাঠকের দরবারে তুলে ধরতে পেরেছেন। এক দল পরীক্ষার্থী ‘নিট উত্তীর্ণ’ না হয়েও শুধু ‘নিট অ্যাপিয়ার্ড’ হয়ে শূন্য পেয়েও বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বেসরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ করে নিলে, এ দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় ধীরে ধীরে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থান শূন্য হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। এর ফলে ‘ঘুষের জোর’-এ ছেলেমেয়েকে চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ করে দিতে সচেষ্ট হবেন আরও অনেক বিত্তবান অভিভাবক। শূন্য পাওয়া ছেলেমেয়েরাও গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে রোগী দেখার ছাড়পত্র পেয়ে চিকিৎসকদের ভিড়ে মিশে যাবেন। রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতা এঁদের কতটুকু থাকবে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকছে। এক জন সাধারণ রোগীর পক্ষে কোনও মতেই বোঝা সম্ভব নয়, তাঁর সামনে চিকিৎসকের ডিগ্রি নিয়ে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি কেমন চিকিৎসক। আজ যখন এক জন প্রথিতযশা চিকিৎসকের কাছেই ভারতের মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থা ‘মেকি সৌধ’ বলে মনে হচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষের কাছে তা আতঙ্কের বিষয়।
স্বাস্থ্য পরিকাঠামো চালু রাখতে চিকিৎসকের ঘাটতি অবশ্যই মেটাতে হবে। তবে তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে ডাক্তারি পড়ানোর দায়িত্ব বেসরকারি উদ্যোগপতিদের হাতে তুলে দিতে চাইছে, তাতে দুর্নীতি বাড়তে থাকবে বলে আশঙ্কা। পরীক্ষাব্যবস্থায় ছিদ্র খুঁজে নিয়ে নিজেদের কোচিং সেন্টারের ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ যদি না থাকে, তা হলে দুর্নীতিগ্রস্ত কোচিং সেন্টারগুলির ব্যবসা চলবে কী করে? মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষা-সহ উচ্চশিক্ষার যাবতীয় পরীক্ষা শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে পরিচালনা করতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ করা দরকার। দুর্নীতিগ্রস্ত বাস্তুঘুঘুদের খুঁজে বার করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করতে হবে।
২০১৩ সালে সর্বভারতীয় ‘নিট’ শুরুর আগে প্রতিটি রাজ্যে মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষা যে ভাবে নেওয়া হত, সেই ভাবে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষমতা রাজ্যের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার যে দাবি প্রবন্ধকার তুলেছেন, তা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। তাতে এত দিন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক বোর্ডগুলির অধীনে মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়াশোনা করা মেধাবীরা যে ভাবে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ করে নিতে পারছিল, ভবিষ্যতেও তা পারবে। ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় দখল কম থাকার কারণে মেডিক্যালের প্রবেশিকা পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ার ভয় এড়াতে পারবে।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
ছাঁকনি চাই
কুণাল সরকারের ‘শিক্ষার মেকি সৌধ’ ও অজয়কুমার রায়ের ‘পরীক্ষাব্যবস্থায় ভরসা ফেরাতে’ (৫-৭)— এই দুই উত্তর-সম্পাদকীয়ের পরামর্শ কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দল যত দ্রুত কার্যকর করতে পারবে ততই মঙ্গল। প্রবন্ধদ্বয় স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে দুর্নীতিজনিত ব্যাপক ও গভীর দুর্বলতা। এই দুর্বলতার সংস্কারে উভয় প্রবন্ধই গুরুত্ব দিয়েছে সরকারি ব্যবস্থাকে, যা ১৯৯০-উত্তর বিশ্বায়ন ও বাজারব্যবস্থায় যথেষ্ট অবহেলিত হয়েছে। কার্যত ১৯৮০ সাল থেকে বিগত চার দশকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমস্ত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে অসরকারি ব্যবস্থার আগ্রাসনকে। অর্থাৎ, প্রবন্ধদ্বয় অনুযায়ী এই অব্যবস্থার সংস্কারে আপাতত কিছু পথ খোলা আছে। প্রথমত, বর্তমান সরকারকে জাতীয় উচ্চশিক্ষানীতি নিয়ে দ্রুত ও সাহসী পদক্ষেপ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় ‘ভরসা’ ফেরাতে অপরাধীকে দ্রুত বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, উচ্চশিক্ষায় অনাবশ্যক রাজনৈতিক আনুগত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে দক্ষতা ও মেধাকে অগ্রাধিকার দিতে শাসক ও বিরোধী, উভয়পক্ষকে হাতে হাত মিলিয়ে এগোতে হবে, যাতে আগামী দিনে এমন অপরাধ কমে।
তবে কিছু কথা এই দুই প্রবন্ধে প্রবন্ধকার আলোচনা করেননি। উচ্চশিক্ষা এক প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক আন্তর্জাতিক পদ্ধতি। বর্তমানে এককালীন কোনও শংসাপত্রই চূড়ান্ত নয়। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের সমাজ শিক্ষক ও চিকিৎসকের মূল্যায়ন করতে ভয় পায়। একই সঙ্গে এ দেশের মতো এক সুপ্রাচীন দেশে অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে যোগশাস্ত্র, ন্যাচারোপ্যাথি, ইউনানি, কবিরাজি, হোমিয়োপ্যাথি ইত্যাদি নিয়ে সরকারি আয়ুষ মন্ত্রক শুরু হয়েছে। পাশাপাশি জ্যোতিষবিদ্যাকেও (অ্যাস্ট্রোলজি) জ্যোতির্বিদ্যার (অ্যাস্ট্রোনমি) আধারে চালু করার চেষ্টা হয়েছে।
সব মিলিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি হয়েছে। এই ফাঁক ও ফাঁকির অবৈজ্ঞানিক অবকাশে এবং অব্যবস্থা ও দুর্নীতির প্রশ্রয়ে বাজারে এখন প্রচুর জাল, অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত চিকিৎসক ও শিক্ষক জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। প্রকৃত শিক্ষক চিকিৎসক তাঁদের উপযুক্ত মর্যাদা পান না। তাই এখন থেকে নতুন ও পুরনো সব শিক্ষকের জন্য নিয়মিত যোগ্যতা নির্ধারণের পরীক্ষা প্রচলন হওয়া দরকার। উন্নত দেশে রোগী ও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত নথি সংরক্ষণ রাখার ব্যবস্থা আছে যা থেকে মূল্যায়ন করা যায়। বর্তমানে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি নিবিড় যন্ত্রব্যবস্থায় এই তথ্যভিত্তিক মূল্যায়নের প্রয়োগ অত্যন্ত দ্রুত কার্যকর হতে পারে। একটা ছাঁকনির অবশ্যই দরকার।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি