Dhaki

সম্পাদক সমীপেষু: ঢাকির সমাদর

বাংলায় কয়েক লক্ষ ঢাকি রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই আমাদের রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। প্রায় প্রত্যেকেই অত্যন্ত গরিব।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:০৮
Share:

বাংলায় কয়েক লক্ষ ঢাকি রয়েছেন।

অতিমারির ফলে লকডাউনের কারণে গত দু’বছর ধরে দুর্গাপুজোর আয়োজনে খামতি লক্ষ করা গেছে। পুজোর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে যে মানুষগুলো, যেমন— শাড়ি-কাপড়ের ব্যবসায়ী, ডেকরেটার, মৃৎশিল্পী, তাঁরাও বরাতের অভাবে কষ্টে পড়েছেন। এমনকি যাঁদের ছাড়া পুজোর কথা ভাবাই যায় না, সেই ঢাকিরাও চরম আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হন।

Advertisement

বাংলায় কয়েক লক্ষ ঢাকি রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই আমাদের রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। প্রায় প্রত্যেকেই অত্যন্ত গরিব। অনেকেই বছরের বাকি সময়টা অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে দিন গুজরান করেন। পুজোর সময়ে এঁরা কিছু বাড়তি টাকা আয় করবেন বলে নিজেদের পরিবার ছেড়ে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে আসেন। গত বছর পুজোর আগে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে কয়েকশো অসহায় ঢাকিকে বায়নার অপেক্ষায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।

এ বার পরিস্থিতি কিন্তু গত দু’বছরের মতো অতটা ভয়াবহ নেই। সুতরাং, ফের বরাত আসতে শুরু করেছে। কলকাতা-সহ অন্যান্য পার্শ্ববর্তী জেলা থেকেও পুজোর উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই ফোনের মাধ্যমে বেশির ভাগ অর্ডার চলে এসেছে। স্বভাবতই ঢাকিদের মনে খুশির হাওয়া বইছে। অতিমারির অভিশাপ কাটিয়ে অবশেষে চলতি বছরের দুর্গোৎসব আশীর্বাদ হয়ে ফিরবে ওই সমস্ত গরিব ঢাকির পরিবারে। এর পাশাপাশি রাজ্য সরকার কর্তৃক যদি তাঁদের বিশেষ কিছু আর্থিক অনুদান কিংবা এককালীন ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে এই পরিবারগুলোর জীবনে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা ফিরতে পারে।

Advertisement

আমরাও তো সবাই পারি, আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁদের সাহায্য করতে, যাতে পুজোর দিনগুলো রঙিন থেকে রঙিনতর হয়ে ওঠে।

সৌরভ সাঁতরা, জগদ্দল, উত্তর ২৪ পরগনা

হারানো বোল

আজকাল যে কোনও উৎসবের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে মহিলা ঢাকিদের সমবেত ঢাকবাদ্য। মহিলারা ঘরকন্না ছেড়ে স্বাধীন ভাবে ঢাক বাজিয়ে দু’-পয়সার মুখ দেখছেন, ভিনরাজ্য থেকেও মহিলা ঢাকিদের দল ডাক পাচ্ছেন। দুর্গাপুজো আসছে, তাই তাঁদের দম ফেলার ফুরসত নেই এখন। সংসারের কাজ গুছিয়ে সন্ধ্যা হলেই রিহার্সালে আসতে হচ্ছে তাঁদের। আশ্বিনের মাঝামাঝি দুর্গাপুজো থেকে একেবারে কালীপুজো পর্যন্ত টানা বায়না পাবে প্রায় সমস্ত মহিলা ঢাকির দল। শুধু উৎসবে নয়, যে কোনও শোভাযাত্রা, ভোট পরব, সবেতেই এখন তাঁদের প্রচুর চাহিদা। দেখে বেশ সন্তুষ্ট হচ্ছি। মহিলারা রোজগার করলে স্থানীয় বাজারে বিক্রিবাটা বাড়ে। স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।

তবে একটি কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। মহিলা ঢাকিরা ঢাক বাজাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের সমবেত বাদনের মান তেমন ভাল হচ্ছে না। ঢাকবাদ্যির মূল ‘পাগলা ছন্দ’ মুখ থুবড়ে পড়ছে। এমনিতেও এখন দেখা যায়, ঢাকিরা ঢাক কাঁধে নিয়ে নেচে-নেচে ঢাক বাজালেও, ঢাকবাদ্যির ব্যাকরণ বা শাস্ত্র কিছুই অনুশীলন করতে পারেন না। শুধুমাত্র যন্ত্রটিকে কাঁধে ঝুলিয়ে বোল তোলেন তাঁরা।

মনে রাখতে হবে, ঢাকের বাদ্যির নিজস্ব কিছু তাল, মাত্রা, বোল আছে। ঢাকের বাদ্যির এক অন্য ঘরানাও আছে। যাঁরা নামকরা পণ্ডিত ঢাকি, তাঁরা অনায়াসে বিলম্বিত লয় বাজাতে পারেন। ঢাকের সমবেত বা একক ‘বিলম্বিত লয়’ যে কী মধুর হয়, তা যাঁরা শুনেছেন তাঁরাই জানেন। যে কোনও পুজো উৎসবের বিভিন্ন মুহূর্তে ঢাকের বোল ভিন্ন হয়। ঠাকুরের ঘট আনতে যাওয়া, আরতি, বলিদান, বিসর্জন সবেতে ভিন্ন ভিন্ন ঢাকের বাজনা আছে। গাজনের বাজনা আর দুর্গাপুজোর বাজনা এক নয়। আরতির বাজনা আর ঠাকুর জাগানোর বাজনা এক নয়। সবেতেই পৃথক ধারা, তাল, সুরের বাজনা আছে। সেই বাদ্যি কখনও চার মাত্রা, কখনও আট মাত্রা, কখনও ষোলো মাত্রার হয়ে থাকে। বোলগুলো পরিস্থিতি মোতাবেক বদল হয়।

বাঁকুড়া-পুরুলিয়া জুড়ে আরতির ঢাকবাদ্যি অনেকটা মহাপ্রভু আরতির গানে শ্রীখোল বাদ্যির সুরে। ঢাকের কাঠি যেন কথা বলে— ‘ঢাক বাজে, ঢোল বাজে, বাজে করতাল’। তবলাতে যেমন কাহারবা তাল আছে, ঠিক তেমনই কাহারবা তালে ছন্দ মেনে চলে এই বাজনা। আরতির এই বাজনাকে শ্রুতিমধুর করতে কাহারবা-র মাঝে দ্রুত লয়ের দাদরার টুকরো বাদ্যি ঢাকিরা বাজিয়ে থাকেন। অপূর্ব মধুময় লাগে সেই বাদন। বলিদানের বাজনা, ‘দেন দেন দেন ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং’। ঘট আনতে যাওয়ার বাজনাতে ঢাকের কাঠি বলে— ‘মাকে আনতে যাবো গো, বড় নদীর কূলে’। বাজনাটা শুনতে লাগে, “ঢ্যাঢেং ঢ্যাঢেং ধা ট্যাং ঢ্যাঢেং/ নাকে দেনা দেন ট্যাটেং ট্যাটেং/ নাক দেনা দেন নাক দেনা দেন নাক দেনা দেন/ তাকুড় তাকুড়।’ গাজনের বাজনা, ‘তাল গাছে দুটো ঠ্যাং, ভক্ত নাচে ঠ্যাঠাং ঠ্যাং।” অথচ, অনেক ঢাকির ঢাকবাদ্যিতে এখন বাজনার রকমফের সে ভাবে শোনাই যায় না। সব কিছুতেই যেন একটাই বোল বাজে, “ঢ্যাঢেং ঢ্যাঢেং ঢ্যাংটি পেটেন/ নাক দনাদন ঢ্যাংটি পেটেন।”

ঢাকের কাঠি প্রথম বোল তোলে ঢ্যাং কুড় কুড় কেরামতিতে। ঢাকের বোল কাঠিতে আনতে দীর্ঘ তালিম লাগে। এই প্রকার যে কোনও বাজনা বাজাতে দুটো হাত, হাতের চেটো, হাতের তালু, হাতের আঙুল অবশ্য প্রয়োজনীয় হয়। ঢাক বাদন নির্ভরশীল দুটো কাঠির উপর। তাই ঢাক বাজানো ভীষণ জটিল। ঢাক কাঁধে নিলেই ঢাকি হওয়া যায় না। ঢাক বাজাতে হলে সুরজ্ঞান, তালজ্ঞান, স্থিরতা, ধৈর্য, সর্বোপরি শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা অবশ্যই দরকার পড়ে।

আক্ষেপ এটাই যে, ঢাকের প্রাচীন, উচ্চাঙ্গের বাদ্য ও বোল ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। পণ্ডিত ঢাকিরা উপেক্ষিত থাকছেন, তেমন বায়না পাচ্ছেন না। তাঁদের বিকল্প কাজে নামতে হচ্ছে। অতীতে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি ঢাক বাজলেও তার আওয়াজ কানে আসত। এখন দু’শো মিটার দূরে দশটি ঢাক এক সঙ্গে বাজলেও কানে সে ভাবে আসে না। কারণ, এখন আর ‘কষে’ বা ‘গমক’ তুলে খুব কম ঢাকিরাই ঢাক বাজান।

অতীতে ঢাকের খোল তৈরি হত আম, জাম প্রভৃতি শক্ত গাছের গুঁড়ি থেকে। ঢাকের সেই খোলের ওজন হত ২৫-৩০ কেজির উপর। ছাগলের চামড়া দিয়ে তালা ছাউনি হত, বিপরীত প্রান্তে গরুর চামড়া দিয়ে তৈরি হত মোটা তালা। ওই তালাটি ঢাকবাদ্যিকে গম্ভীর করত। ভারী কাঠের খোলের পরিবর্তে মাটির খোল ব্যবহার শুরু হয় চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের পর থেকেই, ওজন হত ১৫-২০ কেজি। কাঠের ঢাকের বাদ্যির মতো সুন্দর না হলেও তা মন্দ হত না। সে সব হারিয়ে গিয়ে এখন যত্রতত্র টিনের ঢাক বাজছে। বাজনার মিষ্টতা উড়ে গিয়ে টিন বাজানোর মতো শব্দ হয়। কেনা প্লাস্টিকে প্রস্তুত তালা, বাঁশের বাতার বেড়ি বাদ দিয়ে সরু ধাতুর বেড়ি, চামড়ার বাঁদি হটিয়ে নাইলন বা প্লাস্টিকের বাঁদি ঢাকের গঠনকে অপূর্ণ করেছে। ফলে বাংলার ঢাকের বাদ্যি এখন ক্ষয়িষ্ণু শিল্পধারা।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এক্তেশ্বর, বাঁকুড়া

পুজোয় রক্তদান

দুর্গোৎসব থেকে শুরু করে সমস্ত উৎসব এবং গ্রীষ্মকালীন দাবদাহের সময় পর্যন্ত রাজ্যের সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে প্রায়ই রক্তের অভাব দেখা দেয়। তাই যে সমস্ত পুজো কমিটি রাজ্য সরকারের অনুদান পেয়েছে, তাদের একটি করে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করার আবেদন জানাই। যারা অনুদান পায়নি, তারাও এই কাজে এগিয়ে আসুক। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও রক্তদান শিবিরের ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। পুজোর দিনগুলি আনন্দময় হয়ে উঠুক রক্তদান শিবিরের আয়োজনে। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পুজোমণ্ডপ আলোকিত হোক। সরকারি ভাবেই প্রতিটি পুজো কমিটির জন্য নির্দেশিকা জারি করা হোক রক্তদান শিবিরের আয়োজন করার জন্য।

জয়দেব দত্ত, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement