Pujabarshiki Magazines

সম্পাদক সমীপেষু: পুজোর স্মৃতিটুকু

নব্বইয়ের দশকে বাজার অর্থনীতির প্রভাব এবং এই শতকে সমাজমাধ্যমের আত্মপ্রকাশ অন্য অনেক কিছুর মতো পুজোসংখ্যার আবেদনকে ম্লান করতে শুরু করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:১৬
Share:

পূজাবার্ষিকী। —ফাইল চিত্র।

ঈশা দাশগুপ্তের ‘পুজোর গন্ধ আর পূজাবার্ষিকী’ (৭-১০)-র সূত্রে বলতে চাই পুজো ও তার অনুষঙ্গে যা কিছু আছে, তা সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায়। তার জন্য স্মৃতিকাতরতা, রোমন্থন এক সময় আমাদের প্রিয়জন হয়ে ওঠে। তার পরে প্রয়োজন বিচার-বিশ্লেষণ পাল্টে যাওয়াকে বুঝে নিতে। যার জন্য বিষয়টিকে অর্থনীতি, সমাজ-নীতি, সময়ের চাহিদার মধ্যে দিয়ে দেখতে হয়। এ ভাবে বুঝে না নিলে সত্যাসত্য স্বীকার করা হবে না। আরও কিছুকাল কেবল কুহকী আশায় কাটবে।

Advertisement

নব্বইয়ের দশকে বাজার অর্থনীতির প্রভাব এবং এই শতকে সমাজমাধ্যমের আত্মপ্রকাশ অন্য অনেক কিছুর মতো পুজোসংখ্যার আবেদনকে ম্লান করতে শুরু করে। ‘ফেস্টিভ্যাল ওয়েলবিয়িং’-এ আমোদ, বিনোদন নব নব রূপে ফোনের পর্দায় আসতে থাকে। এবং জন গণ মন ভেসে যেতে থাকে উপভোক্তার পরিশ্রমসাধ্য অভিনিবেশ, মনোযোগের বাধ্যতা না থাকায় ও তৎক্ষণাৎ উপভোগ্য হওয়ায়। পুজোর লেখা অনুভবী পাঠক ভিড়ে ভিড়তে না পারা সম্প্রদায়কে লেখার মান অনুযায়ী দু’দণ্ড বা অনন্তের স্বাদ দিয়েছে, যা আমোদপ্রমোদ নয়, আনন্দ ছিল। পুজোর অবকাশে পাঠকরা তখন অনেকেই বই হাতে নিয়েছিলেন বিনোদন মুঠোবন্দি করার ভুবনস্পর্শকটি না থাকায়। মুঠোযন্ত্র তখন থাকলে তার অমোঘ মন্ত্রে আনন্দের চেয়ে প্রমোদে মন ঢেলে দিত, ঢলে যেত এখনকার মতোই। এবং তৎকালেই আজকের মতো পুজোসংখ্যার দশা করুণ সুরে বাজত। এই পরিবর্তনে অর্থনীতি, সমাজবোধ, মনুষ্য চাহিদার ভূমিকা আছে, তবে দোষ কার‌ও নয়।

‘অর্থনীতি ও রাশিবিদ্যার তত্ত্ব ভিন্ন কথা বলতে পারে’ এই কথাটি লিখে প্রবন্ধকারই তাঁর প্রবন্ধের শেষে সেই সঙ্কেত দিয়েছেন। সেই সঙ্কেত ভেদ সহজেই করা যায় যদি কোনও প্রথম সারির বাংলা সংবাদপত্রের প্রকাশিত পুজোসংখ্যাগুলির গত দু’দশকের মুদ্রণ ও বিক্রি সংখ্যার তথ্য নেওয়া যায়। ব্যক্তিগত জীবনে সংবাদপত্র বিক্রিতে পেশা নয়, নেশায় ছিলাম। সেই স্মৃতিকে মেলাতে প্রতি বছরই বাড়িতে দিতে আসা আমার একদা সহকারীর কাছে পুজোসংখ্যা তত্ত্বতালাশ করি। এ বছর সে জানাল একটি সংখ্যার অর্ডারও সে পায়নি। হয়তো অন্য কেউ পেয়েছে। তবে, নিশ্চিত কম পেয়েছে।

Advertisement

পুজোসংখ্যার নবমী নিশি সমাগত। দশমী না আসা পর্যন্ত যা হারিয়ে যায়, তা আঁকড়ে বসে থাকব। কিন্তু তা-ই বা কত আর!

মানস দেব, কলকাতা-৩৬

বিলুপ্তির পথে

বাঙালির দুর্গোৎসব শেষের পথে। কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রতিমা দর্শনের জন্য মণ্ডপে মণ্ডপে উপচে পড়েছে ভিড়। সারা বাংলা জুড়ে, এমনকি রাজ্যের বাইরে, বিদেশেও ডাকের সাজে সুসজ্জিত প্রতিমা, কারুকার্য দর্শকদের নজর কেড়েছে। থিম পুজোর রমরমার মধ্যেও শোলার সাজের শুভ্রতা বাঙালিকে মুগ্ধ করে। সাবেক ডাকের সাজের দুর্গা মা-কে ধরে রাখতে মুঠোফোনে হাজারো ক্লিক। কিন্তু, এই শিল্পকর্মের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে যুক্ত ‘মালাকার’ সম্প্রদায়ের মানুষদের সম্পর্কে আমবাঙালি জানে কতটুকু?

বাংলার লোকসংস্কৃতির ইতিহাস ঘাঁটলে খুঁজে পাওয়া যায় এই মালাকার সম্প্রদায়ের সুদীর্ঘ ইতিহাস। বাংলার সামাজিক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লোকায়ত মানুষের আচার-আচরণ, শুভ অনুষ্ঠান, বার-ব্রত-পার্বণ, দেব-দেবীর পূজানুষ্ঠান। বাংলায় এক সময় আর্থিক প্রয়োজনের তাগিদেই বিভিন্ন লোকশিল্পের সূত্রপাত ঘটে। মধ্যযুগে এক শ্রেণির পল্লি-শিল্পীরাই নিজেদের হাতে তৈরি করা শিল্পবস্তু বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন ‘দাদন’ বা ‘সিধা’ উপার্জনের আশায়। পরবর্তী কালে, এঁরাই ‘মালি’, ‘মালাকার’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁদের এই শিল্পকর্ম বৃহৎ আকার ধারণ করে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যযুগে ‘মালি’ কিংবা ‘মালাকার’ সম্প্রদায়ভুক্ত শিল্পীরাই গৃহস্থের বাড়িতে ফুলের সামগ্রী জোগান দিতেন।

এ ছাড়াও, মন্দিরে ফুলের জোগান দেওয়া, দেব-দেবীর প্রতিমায় ফুলের মালা দেওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ ছিল মালাকারদের। দেব-দেবীর গলায় যে ফুলের মালা দেওয়া হত, তা সুতোয় বাঁধা হত না। ফুলের মালা বাঁধা হত কলা গাছের ছিলকা দিয়ে। মালাকার ছাড়া অন্য কারও গাঁথা মালা পবিত্র বলে বিবেচিত হত না। এই বিশ্বাস, প্রথা আজও গ্রামবাংলায় মানুষের মনে গেঁথে রয়েছে। বিয়েতে কনের মাথার খোঁপা বাঁধা, খোঁপার এক দিকে বেল ফুল, অন্য দিকে গোলাপের কাজ মালাকারদেরই ছিল। ভোর থেকে উঠে স্নান সেরে, শুদ্ধ পোশাক পরে এই শিল্প-কাজে ব্যস্ত থাকতেন তাঁরা। ফুলের মালা ছাড়াও, মধ্যযুগে মালাকার সম্প্রদায়ভুক্ত শিল্পীরা রাজবাড়িতে, সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে এবং অভিজাত ভূ-স্বামীদের বাড়িতে শোলা দিয়ে নির্মিত নানা রকমের শিল্প-সামগ্রী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বিভিন্ন প্রথাগত আচার অনুষ্ঠান, মন্ত্র-তন্ত্র, পূজা-পার্বণ, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, বিয়ে, অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে শোলার শিল্প-সামগ্রী পুরো মধ্যযুগে খুব প্রচলিত ছিল। শোলা দিয়ে মালাকারেরা তৈরি করতেন ফুলঘর, চূড়া, টোপর, চাঁদমালা, নানা রকমের খেলনা, টিয়াপাখি, কাকাতুয়া, হনুমান, ময়ূর, হাতি, ঘোড়া, পাখি, পুতুল, দেবদেবীর মূর্তি প্রভৃতি শিল্প-সামগ্রী। এই শিল্পকর্ম আজও বংশপরম্পরায় তাঁরা করে চলেছেন।

ফুলঘর, মুকুট, চূড়া বিভিন্ন পূজানুষ্ঠানে; টোপর, মউড় বিয়েতে ব্যবহৃত হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে কন্যার মাথায় যে মুকুট থাকে, তাকে বলে মউড়, তেমনই বরের টোপর হল মুকুট। অন্নপ্রাশন, বিয়েতে শোলার টোপর ব্যবহৃত হয়। মালাকার সম্প্রদায়ের শিল্পীরাই শোলা দিয়ে এমন মুকুট তৈরি করেন। এই মুকুট কিংবা মউড়ে থাকে নিখুঁত শিল্পকর্মের বুনট, সৌন্দর্যচেতনার প্রকাশ। ধৈর্য এবং অধ্যবসায় না থাকলে এই সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম রপ্ত করা কঠিন।

আজ তাঁদের এই জীবিকা সঙ্কটের মুখে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির প্রসার, সামাজিক পরিবর্তন, লোকশিল্প সম্পর্কে মানুষের উন্নাসিকতা, উদাসীনতা মালাকার সম্প্রদায়ের মানুষের শিল্পকলাকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সৌন্দর্যচর্চায় প্রাকৃতিক উপাদান কমে গিয়ে তার জায়গা নিয়েছে কৃত্রিম ফুল ও জিনিসপত্রের ব্যবহার। এখন শোলার উৎপাদনও কমে গিয়েছে। তাই বেশি দাম দিয়ে শোলা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন মালাকারেরা। শোলা-শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার এও এক লড়াই। এই সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যার যে ৭২ শতাংশের জীবিকা নির্বাহ হয় এই শিল্পকর্ম থেকে, তাঁদের বর্তমানে উপার্জনের হাল মোটেই ভাল নয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দুর্গাপুজোর সময়টুকু ছাড়া বছরের বাকি সময়ে ২৬.১৯ শতাংশের মাসে উপার্জন পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার টাকা, ৩২.৩ শতাংশ মাসে মাত্র তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করেন। আর, মাত্র ১৩.২২ শতাংশ মানুষের আয় দশ হাজার টাকার বেশি। তা ছাড়া, এই কমতি আয়ের পিছনে মধ্যস্বত্বভোগীদের দায় কম নয়। মালাকারদের তৈরি করা শিল্প-সামগ্রীর ৫৮.২২ শতাংশ তাদের দ্বারাই বাজারমুখী করা হয়। বছরের পর বছর জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও মালাকারদের হাতে তৈরি সামগ্রীর দর বাড়েনি। পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুরে বহু মালাকার পরিবারের বাস। তাঁদের কথায়, এক সময় শুধুমাত্র এই কাজ করেই তাঁদের সংসার চলত। দুর্গাপুজোর সময় দম ফেলার ফুরসত পেতেন না। কিন্তু, করোনার সময় থেকে কাজের বরাত মিলছে নামমাত্র। তাই, মালাকার পরিবারের এখনকার প্রজন্মের সদস্যদের মধ্যে বিকল্প রোজগারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে।

দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর ‘আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’-এর স্বীকৃতি পেয়েছে কয়েক বছর আগেই। এই পুজোকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার ব্যয়-বিনিময় হয়। বাংলার আবহমান সংস্কৃতি, লোকশিল্পকে যাঁরা এখনও আগলে রেখেছেন শোলার গয়না, শিল্প-সামগ্রী তৈরি করে, তাঁদের পাশে দাঁড়াক সরকার। তা হলে, এই শিল্পীদেরও আগামী পুজো ভাল কাটবে।

অরুণ মালাকার, কলকাতা -১০৩

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement