২১ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে সেজে ওঠে। ফাইল ছবি।
বিগত ২১ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজ্য সরকার আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বাংলা ভাষাতে কেন বিজাতীয় (সাম্প্রদায়িক) শব্দ প্রবেশ করেছে, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন (পানি, আম্মা-র হয়ে সওয়াল মমতার, ২২-২)। ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ এবং স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার সকল ভারতবাসীরই আছে। কিন্তু একটি জনসভায় এমন মন্তব্য করার আগে শুভাপ্রসন্নবাবুর আরও দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তিনি দু’টি শব্দ উল্লেখ করেছেন— পানি এবং দাওয়াত। আমার কাছে দু’টি বাংলা অভিধান আছে— রাজশেখর বসু প্রণীত চলন্তিকা এবং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বঙ্গীয় শব্দকোষ। ‘পানি’ শব্দটি দু’টি অভিধানেই উপস্থিত, যার পশ্চিমবঙ্গের বাংলাতে প্ৰচলিত অর্থ জল। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বানানভেদে ‘পাণি’ শব্দটিকেও উল্লেখ করেছেন এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে তার ব্যবহার উল্লেখ করেছেন— “যৌবন রাধে পাণির ফোঁটা।” ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে রেভারেন্ড কে কে জি সরকার সঙ্কলিত প্রবাদমালা গ্রন্থেও রয়েছে সুপ্রাচীন প্রবাদ “ধান পান পানি, এ তিন আশ্বিনে চিনি।”
মূল বিষয়টি হল শুভাপ্রসন্ন তাঁর মন্তব্য দ্বারা ভাষার বহমানতাকে অস্বীকার করেছেন। ইংরেজরা যাকে বলে ‘ব্রিঞ্জল’, আমেরিকান ইংরেজিতে তাকে বলে ‘এগপ্ল্যান্ট’। এই নিয়ে তাদের কোনও বিবাদ নেই, কেউই কাউকে সাম্প্রদায়িক বলে গালি পাড়ে না। ময়মনসিংহ অঞ্চলে সকালবেলাকে বলে বেইন্যা বেলা, রাঢ়বঙ্গে বৃহদাকার মশাকে বলা হয় ডাঁশ। কয়েক বছর পূর্বে টাকি ঘুরতে গিয়েছিলাম। রিকশাচালককে পঞ্চাশ টাকার নোট দিতে বলেছিলেন, “খরচা করে দিন”। আসলে তিনি খুচরো করে দিতে বলেছিলেন। সমস্যা হল, শুভাপ্রসন্ন যে শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন, তা এক বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষের পরিচয় প্রকাশ করে। বর্তমানে, মানুষের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা আমরা প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছি। বিভিন্ন সমাজমাধ্যমের মধ্য দিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য যখন নিমেষে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, তখন শুভাপ্রসন্নর মতো ব্যক্তির কাছে একটি সুচিন্তিত এবং সঠিক পথপ্রদর্শন কাম্য ছিল।
আশ্চর্যজনক হল, শুভাপ্রসন্ন তাঁর প্রদত্ত উদাহরণের মধ্যে ‘ট্র্যাফিক’, ‘মেডিসিন’ বা ‘ডিসকাউন্ট’-এর মতো কোনও শব্দ ব্যবহার করেননি, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কথ্য ভাষায় যেগুলি বহুল প্রচলিত। অথচ, এগুলির পরিবর্তে চলিত বাংলা আছে।
রাজর্ষি সেনগুপ্ত, কলকাতা-১২৫
শুদ্ধতার বিতর্ক
‘মিলনের ভাষা’ (১-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের প্রেক্ষিতে এই পত্র। এ বারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের সরকারি মঞ্চে বাংলা ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা যত না ভাষা নিয়ে বিতর্ক, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক বিতর্ক। আপাতদৃষ্টিতে এই বিতর্ক দেখে মনে হতে পারে, বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা থেকে হয়তো এর উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কা হয়, হয়তো অন্য এক সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষই এই বিতর্ককে চালনা করছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাই যে, তিনি শক্ত হাতে এই ব্যাপারটার মোকাবিলা করেছেন।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এই ধরনের বিতর্কে যেখানে সবচেয়ে আগে প্রতিক্রিয়া দেন, সেখানে তাঁরা এ বার ভীষণ ভাবে সাবধানী। এটাও কি এক ধরনের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা? অদ্ভুত লাগে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেই ভাষার আন্তর্জাতিকতা নিয়ে বিতর্ক! পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই অন্য ভাষা থেকে নতুন নতুন শব্দ প্রবেশ করেছে, এবং এটা চলতে থাকবেই, কারণ ভাষা চিরপরিবর্তনশীল। এই ব্যাপারটা বোঝার জন্য বুদ্ধিজীবী হতে হয় না। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত মানুষরাও কী করে এ ধরনের বিতর্ক তৈরি করতে পারেন, সে প্রশ্ন থেকে যায়। ভাষাবৈচিত্রের তথ্য জানার পরও কী করে ভাষাতত্ত্বের বিষয়ে একগুঁয়েমি বজায় থাকে? মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের মানুষদের মধ্যেও এমন ধরনের মনোভাব সত্যিই আশ্চর্য করে।
আমাদের বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস বহু প্রাচীন। পৃথিবীতে আজ প্রায় ৩২ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। প্রায় আটশো বছর ধরে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম শাসনের ফলে বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি প্রভাব পড়েছিল। তবে এই দুই ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার শব্দও যেমন— জাপানি (চা), ফারসি (অদলবদল), আরবি (কলম), তুর্কি (উজবুক), পর্তুগিজ (আনারস), ইংরেজি (গ্লাস) ইত্যাদি নানাবিধ ভাষা কথ্য বাংলা ভাষার মধ্যে প্রবেশ করেছে। শিল্পীর অভিযোগ কিন্তু বাংলা ভাষার আরবিকরণের দিকে ইঙ্গিত করে। বাংলা ভাষায় প্রায় চার হাজারের উপর আরবি শব্দ আছে। এই ধরনের শব্দগুলো কিন্তু কোনও মতেই বাংলা ভাষার মানের হানি ঘটায়নি বা শক্তিহ্রাস করেনি। বরং বলা যেতে পারে, তা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। আরবি শব্দের অনুপ্রবেশ সহজাত।
বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের আত্তীকরণ নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক সত্য। ভাষা হল সমাজের এবং জাতির এক শক্তিশালী হাতিয়ার। তাকে আমরা যে ভাবে ব্যবহার করব, সেই অনুযায়ী মানুষ তার ফল পাবে। সাম্প্রদায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ভাষাকে ব্যবহার করা হলে এক সময় ভাষা মানুষের শত্রু হয়ে উঠতে পারে। সাধারণ মানুষ এ কথা সহজে বুঝতে পারে। ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের কাছে কেন ব্যাখ্যা করতে হয়?
অশোক বসু, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
আধিপত্যবাদ
‘বাংলা ভাষার জন্য অঙ্গীকার’ (২২-২) শীর্ষক প্রবন্ধে অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যখন ওপার বাংলায় ভাষা আন্দোলনের আগুন জ্বলছে, এপার বাংলায় ওই সময় ৪ জুলাই বিধানসভায় হিন্দিতে ভাষণ দেওয়ার জন্য অনুমতি চাওয়া হচ্ছে মাননীয় অধ্যক্ষের কাছে। প্রসঙ্গত, একুশের ভাষা আন্দোলনও কিন্তু শুধুমাত্র মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা থেকে জন্ম নেয়নি, এর পিছনে কাজ করেছে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে উর্দু ভাষার অগ্রাধিকারের আতঙ্ক। ইংরেজ আমলে ইংরেজি না শিখে চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার পুরনো অভিজ্ঞতা কাজ করেছিল এ ক্ষেত্রে। জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার আগ্রাসী রাজনীতি মেনে নিতে পারেননি পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশের নাগরিকেরা।
ভাষার জন্য গড়ে-ওঠা গণ-আন্দোলনকে বিচার করতে হবে নির্মোহ ভাবে। ভারতের প্রেক্ষাপটে হিন্দি ভাষা রাষ্ট্র পরিচালকের তত্ত্বাবধানে জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের আধিপত্যবাদী রাজনীতিকেই নির্দেশ করে, যেখানে শুধু ভাষার প্রেক্ষিতেই যেন তৈরি করতে চাওয়া হয় সমান্তরাল একটি সাম্রাজ্য। আপত্তিটা তাই হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে নয়, হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ইটালীয় ভাষায় একটি শব্দ আছে, ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’। এর অর্থ হল, বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ। মোটামুটি দ্বাদশ থেকে বিংশ শতাব্দী, এই সময়ের পরিধিতে ইটালি, ফ্রান্স, তুরস্ক এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বেশ কিছু ভাষার একটি মিশ্রিত রূপকেই নাম দেওয়া হয় ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’। অর্থ করা হয়েছিল, একটি দেশের বাসিন্দা নিজস্ব মাতৃভাষা ছাড়াও অন্য যে ভাষা অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করার জন্য ব্যবহার করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যদি ভাষা নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিন্যাসের সমীকরণ আলোচনা করা যায়, তবেই হয়তো সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।
ভাষার দিক থেকে সংখ্যালঘুদের বরাবরই ভাষাগত সংখ্যাতত্ত্বে এগিয়ে থাকা জনজাতির এই চাপিয়ে দেওয়া বা দখল করে নেওয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান, এবং সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইলে আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভোগাটা খুবই স্বাভাবিক।
পার্থপ্রতিম কুন্ডু কলকাতা-৫৬