ছবি: সংগৃহীত
গুন্ডামির চরমতম নিদর্শন দেখল জেএনইউ। ভাড়াবৃদ্ধির আন্দোলনে মাথাব্যথা তো হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকারের। অর্থনৈতিক বৃত্তের বাইরে থাকা কিছু দুষ্কৃতীর কেন? ভাড়াবৃদ্ধির আন্দোলন এখানে নিমিত্ত মাত্র, আসলে এরই সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র আবার নিজের কব্জির জোর প্রমাণ করতে চাইল, উগ্র দক্ষিণপন্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে।
আমার বন্ধুস্থানীয় অনেক যুবকের মধ্যেও দেখি, যারা সুস্থ চিন্তা কিংবা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে তাদের ‘বুদ্ধুজীবী’ বলে দাগিয়ে দিয়ে তীব্র আক্রোশ প্রকাশ করে, কেউ ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপে জনপ্রিয়তার লোভে, কেউ বিজেপি আইটি সেলের পরোক্ষ মদতে, অর্থলোভে। কারণ পাকিস্তান বা সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে ছদ্ম দেশাত্মবোধের টনিক খেয়ে কখন এরা রাষ্ট্রের অনুগত দাস হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রও ঠিক এটাই চায়, দেশপ্রেমে অন্ধ আবেগমথিত এক প্রজন্ম, যাদের থাকবে আনুগত্য না মানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার মানসিকতা। তাতে লাভ দুটো। এক, শিক্ষার মেরুকরণ করে ইউনিয়নের দাপটে আরও আরও অনুগত সৃষ্টি করা; দুই, রাষ্ট্রের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা।
বাস্তবিক মোদী সরকার এই বিষয়ে আংশিক সফলও। মানুষ আর মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেওয়া অর্থনীতি নিয়ে ভাবছে না, বেকারত্বকে নব্য যুবসমাজ জীবনের অঙ্গ হিসেবেই ধরে নিয়েছে, মূল্যবৃদ্ধিকেও তারা বিধাতার ললাটলিখন বলেই ভাবতে চায়। জীবনের স্বাদ-আহ্লাদকে তারা ভাঙচুর, মারদাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক উদ্দীপনার মতো অপ্রয়োজনীয় পরিসরে ছোট করে নিয়েছে। উগ্র দক্ষিণপন্থী এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা একনায়কতন্ত্রের কাছে এ যে চূড়ান্ত সাফল্য, বহু বছর আগে হিটলার তা প্রমাণ করেছে।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই পরিস্থিতির মধ্যে ছায়া খুঁজে পেয়েছেন প্রাক্-নাৎসি জার্মানির। আশঙ্কা অমূলক নয়। একের পর এক লাইব্রেরিতে বোম ফেলা ছিল নাৎসিদের কর্মসূচির অঙ্গ। ১৯৩৯ সালে ওয়ারশ-এর ‘জাময়স্কি লাইব্রেরি’তে পর পর বোমা নিক্ষেপ করে নাৎসিরা, যে-সব বই বাঁচে, ১৯৪৪-এ সেগুলোতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, ১৯৪১-এ সার্বিয়ার একমাত্র ন্যাশনাল লাইব্রেরিটি ধ্বংস করে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বই নষ্ট করা হয়। বার্লিনের রাস্তায় স্তূপীকৃত পোড়া বইয়ের গন্ধ সে সময় নাক-সওয়া হয়ে গিয়েছিল জার্মানদের, আমাদের দেশেও সত্যজিৎ যে-ছবি এঁকেছিলেন ‘হীরক রাজার দেশে’তে (ছবিতে একটি দৃশ্য), উদয়ন পণ্ডিতের বই পুড়িয়ে।
অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখ বন্ধ করা, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের মারধর করে জেলে পুরে দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে প্রতিবাদী কণ্ঠের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া এ সবই বরাবর দক্ষিণপন্থী আগ্রাসন প্রতিষ্ঠার অত্যন্ত গোড়ার কর্মসূচি।
বিশেষ করে মেধা-তালিকায় উপরের দিকে থাকা ইউনিভার্সিটিগুলি এদের প্রাথমিক লক্ষ্য। সম্প্রতি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতেও ফিরোজ খানের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছিল, মুসলিম অধ্যাপক বলে তিনি সংস্কৃত পড়াতে পারবেন না! রোহিত ভেমুলার স্মৃতি আজও স্পষ্ট। ঘটনা এটাই, এইচসিইউ, জেএনইউ, যাদবপুর, বিএইচইউ প্রতিটিই প্রতি বছর ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম দশের মধ্যে স্থান করে এসেছে।
সায়ক সিংহ
কলকাতা-১১০
ক্ষিতিমোহন
বিশ্বজিৎ রায় ‘ধর্ম যখন সহজ সম্পর্ক’ (২৯-১২) শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘‘মধ্যযুগের হিন্দু-মুসলমানের অশাস্ত্রীয় অনুভবের ধর্মে নানা মত-পথ মিলেমিশে গিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রিক-সামাজিক অনুশাসনের তলায় হানাহানি মারামারির বাইরে গড়ে উঠেছে পারস্পরিকতার সহজ সম্পর্ক। সেই সহজ সম্পর্কের ইতিহাসকার ক্ষিতিমোহন সেন।’’
ক্ষিতিমোহন সেন যখন কাশীতে ছিলেন, দাদু-কবীরের ভজন শুনেছেন সাধুদের কণ্ঠে। সন্তদের বাণী তাঁকে বুঝিয়েছেন ঠাকুর্দার বন্ধু সুধাকর দ্বিবেদী। নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত এই মানুষটির গভীর জ্ঞান ছিল জ্যোতিষশাস্ত্র ও গণিতে। সন্তদের সাধনার মর্মের কথা তিনিই ক্ষিতিমোহনের কাছে উদ্ভাসিত করেন।
ক্ষিতিমোহনকে সন্ত মতে দীক্ষা দিয়েছিলেন দু’জন মিলে: কাশীর পণ্ডিত ঈশানচন্দ্র বিদ্যারত্ন, আবদুল রসিদ। ঈশানচন্দ্রের সঙ্গেও যোগাযোগ হয় সুধাকর দ্বিবেদীর মাধ্যমে। ক্ষিতিমোহনের যখন দীক্ষা হয়, তাঁর বয়স চোদ্দো মাত্র। ক্ষিতিমোহন লিখেছেন, ‘‘ঘটনার দুর্বিপাকে যে পথে অগ্রসর হইলাম সে পথের সন্ধান কিছুই নাই,
এ সময়ে আমাদেরই দেশের নিরক্ষর স্তরের মধ্যে নিহিত ঐশ্বর্যের সন্ধান যেন পাইলাম। স্পষ্ট মনে পড়ে সে বছরের সেই পুণ্য তারিখ খ্রিস্টাব্দ ১৮৯৫, দিন ২রা ফেব্রুয়ারি। সেই দিন আমি সন্তমতী সাধকের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করি।’’
ক্ষিতিমোহনের ঠাকুর্দা রামমণি শিরোমণি ছিলেন বিভিন্ন শাস্ত্রে পণ্ডিত। তিনি ঢাকার সোনারঙ্গা গ্রামের অধ্যাপনা ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সে কাশীতে বসবাস শুরু করেন, কাশীতে গিয়েও অধ্যাপনা ছাড়েননি। ছাত্রদের কাছে ভাগবত শুনতে শুনতে তাঁর মৃত্যু হয়। এমন বংশে জন্মগ্রহণ করে ক্ষিতিমোহনের কবীরপন্থী হওয়া ও সন্ত মতে দীক্ষা নেওয়ার ঘটনা বর্তমান সময়ের ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির এই ক্রান্তিকালে রৌদ্রকরোজ্জ্বল উদাহরণ বইকি।
আসলে তাঁদের পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ছিল না। ক্ষিতিমোহন লিখেছেন, ‘‘প্রায় ষাট বছর পূর্বে কাশীতে বাস করেও আমরা দেশে পূর্বপুরুষের বাসস্থানে এলাম। ঘর-দুয়ার করে দেশের আড্ডাটা জমিয়ে তুললাম। যদিও কাশীধাম আমরা তখনও ছাড়িনি। কাজেই
দেশে এসে যত দিন বাস করতাম আমার গতিবিধি ছিল টোলে ও চতুষ্পাঠীতে, আর আমার দাদার কাছে আসর বসত ফারসীভক্তদের। অনেক মুসলমান সজ্জনও তাঁর আসরে আসা-যাওয়া করতেন।’’
ক্ষিতিমোহন প্রকৃত অর্থে ছিলেন এক জন পরিব্রাজক। এক বার কাশ্মীরে কবি ইকবালের সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয় হয়েছিল, ইকবাল তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘কাশ্মীরে মুসলমান ধর্ম প্রচার করেছিলেন সুফী প্রেমিক ভক্তের দল। তাদের ষোলোটি গদি বা আখড়া কাশ্মীরে ছিল। তাই কাশ্মীরে হিন্দুমুসলমানে এমন প্রেমভক্তির যোগ। বাংলার বাউলদের মতো বহু ভক্ত কাশ্মীরে আছেন। তার মধ্যে লালদেদ এক জন।’’
১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে হিন্দি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় স্বাগতভাষণে ক্ষিতিমোহন বলেন, ‘‘ভারতবর্ষে যুগের পর যুগ দেখা গিয়েছে ধর্মের পাশে ধর্ম, মতের পাশে মত বিরাজমান।
কেহ কাহাকেও নিঃশেষ করে নাই, বরং একে অন্যকে অনুপ্রাণিত করিয়াছে। অন্যকে মারিয়া গ্রাস করিয়া আপনি স্ফীত হইয়া উঠিবার রাক্ষসী বৃত্তিটা অভারতীয়, বাহির হইতে আমদানী করা। কাজেই এইরূপ সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্রের কথা বুঝিতে আমাদের দেশের লোকের পক্ষে কঠিন হইবে না।’’
বর্ষবরণের এক অনুষ্ঠানে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনের ফলে যে সাঙ্ঘাতিক ক্ষতি হচ্ছে তা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মস্জেদে/ ও তোর ডাক শুনে সাঁই চলতে না পাই—/ আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে মুরশেদে।’’ উচ্চারণ করেছেন কবীরের দোঁহা, ‘‘হিন্দু কহত হৈ রাম হমারা/ মুসলমান রহিমানা/আপস মে দৌউ লড়ে মরত হৈ/ মরম কোই নহিঁ জানা।’’
ক্ষিতিমোহন বলেছিলেন, ‘‘প্রদীপ যেমন মৃৎপাত্রে যতদিন সীমাবদ্ধ ততদিন সে সুখেই থাকে। যেই মুহূর্তে সে আলোক পরিবেশনের দ্বারা আপনাকে বহুদূরে ব্যাপ্ত করিতে চায় তখন হইতে তাহাকে আপন সকল সঞ্চয় ক্ষয় করিয়া পলে পলে জ্বলিয়া মরিতে হয়। অথচ এই ব্যাপ্তি ছাড়া তাহার সার্থকতাই নাই।’’ এখন আমরা দেশের সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি, ধর্মীয় বিভেদকামীদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করতে প্রদীপের আলোর মতো সম্প্রীতির ব্যাপ্তি ছড়াতে শান্তিকামী জনগণ একজোট হচ্ছেন।
পঙ্কজ পাঠক
বর্ধমান
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।