বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে হলে আঞ্চলিক বাংলাকে সেই অঞ্চলের অন্তত কথ্যভাষা হিসেবে সমীহ করতে হবে। প্রতীকী ছবি।
শিশির রায় সঠিক মন্তব্য করেছেন যে, “শুধু লেখকদের কাছে নয়, বাংলা ভাষা আজ সমস্ত বাঙালির কাছে নিরাপত্তা এবং আশ্রয় প্রার্থনা করছে” (নিজভূমে শরণার্থী, ১৯-২)। বাংলা ভাষার বৈচিত্রকে আমরা স্বীকার করি না। অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমাদের কলকাতার সরকারি অফিসে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা কয়েক জন কর্মচারী নিজেদের কথোপকথনে গ্রাম্য ভাষা ব্যবহার করতেন। তাঁদের প্রতি কলকাতার বাবুদের অপরিসীম অবজ্ঞা দেখেছি। যদিও তাঁরা তা উপেক্ষা করতেন। তাঁরা যে কলকাতার বাংলায় অদক্ষ, তা নয়। তাঁরা নিশ্চয়ই নিজেদের ভাষায় কথা বলে তৃপ্তি পেতেন। আমরা এমন মানুষদের শ্রদ্ধা করি না, অবজ্ঞার যোগ্য, ‘অশিক্ষিত’ বলে মনে করি। ভাবনার এত দুর্বলতা ক্ষমা করাও অন্যায়।
সব মানুষই চিন্তাভাবনা করে নিজের ভাষায়, অর্জিত ভাষায় তার ঠিক কুলায় না, প্রকাশ যে ভাষাতেই হোক না কেন। যে বাংলা ভাষায় আমাদের সাহিত্য ও কবিতা রচনা হয়, পত্র লেখা বা সরকারি কাজকর্ম হয়, কথ্যভাষা হিসেবে সেই ভাষার দাপট বেশি দেখা যায়। অবশ্য সেই দাপটও ক্রমশ ম্রিয়মাণ ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষার দাপটে।
তাই বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে হলে আঞ্চলিক বাংলাকে সেই অঞ্চলের অন্তত কথ্যভাষা হিসেবে সমীহ করতে হবে। এই বৈচিত্র থেকে শক্তি আসবে। এর ফলে শুধু ভাষাগত নয়, আঞ্চলিক বিবিধ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে এক একতাবোধের বাতাবরণ সৃষ্টি হবে। ইংরেজি ভাষার ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি। তা ছাড়া ইংরেজি ভাষা প্রায় বিশ্ব ভাষা। ইংরেজি জানলে অনেক লাভ, সে কথা সত্যি। কিন্তু শুধুমাত্র ইংরেজি জানা মানুষকে বিদ্বান ভাবার মতো ঔপনিবেশিক সমীহকে বর্জন করতে না পারলে আমাদের হীনম্মন্যতা যাবে না।
ভাষা যদি তার ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে, সমাজ জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে ভাবনার বিকাশ ব্যাহত হবে। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপিত হয়েছে, কিন্তু কোনও কার্যকর ব্যবস্থা করা হয়নি। এই রাজ্যে যে এক জন ভাষামন্ত্রীর দরকার, এ কথা বহু বার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলতে শুনেছি। পশ্চিমবঙ্গের রূপকাররা এই প্রস্তাবকে আমল দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
দুর্গেশ কুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
ভাষার গতি
‘নিজভূমে শরণার্থী’ পড়ে দুঃখ হল। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলা ভাষার হীন দশার জন্যে আমরা যেমন দায়ী, তেমনই দায়ী ভাষা-রাজনীতি। সাধারণ মানুষের স্বভাব উপরমহলের দিকে চেয়ে থাকা, আর রুটিন মেনে নিজের কাজ করে যাওয়া। ভাষাটি যে অবহেলার পাঁকে ডুবে যেতে বসেছে, সে দিকে খেয়াল রাখার অবকাশ বা সুযোগ তার নেই। লেখকদের সৌজন্যে ভাষা নদীর মতো বেগবতী হয়ে ওঠে, কিন্তু বহুভাষী দেশে সরকারি ভাষার দৌরাত্ম্যে আঞ্চলিক ভাষা সরস্বতী নদীর মতো মজে যেতে পারে।
এক শ্রেণির সচ্ছল বাঙালি গোটা বাংলা বাক্য বলতে চান না। বিজ্ঞাপনের ভাষার মতো ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে একটি বাক্য বলেন, যেন মাতৃভাষার চেয়ে উন্নত এক প্রকাশভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করে ফেলেছেন। এঁদের ছেলেমেয়েরা ততোধিক বাংলা-বিমুখ। অতি প্রয়োজন ব্যতীত মিশ্র ভাষার ব্যবহার অপসংস্কৃতি। বাংলা ছবির শিল্পীরাও সাক্ষাৎকারে গোটা বাংলা বাক্য বলতে চান না। ভুলে যান যে, বাংলা ভাষার ছবিতে অভিনয় করেই তাঁর পরিচিতি। অভিনয়ের বাইরে তিনি এক আন্তর্জাতিক ভাষার প্রচারক।
বাংলা গানের প্রদর্শনী-অনুষ্ঠান জমানোর জন্যে বাঙালি শিল্পীকে হিন্দি গান গাইতেই হয়। যেন বাংলা গানের সেই শক্তি নেই। নজরুল সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থেকে যান, কিন্তু তাঁর অনেক গানে আসর জমানোর ঈর্ষণীয় শক্তি আছে। পুরনো শিল্পীদের অনেক গান বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে, আমরা ভুলে যাব আঙুরবালা-ইন্দুবালার গান। ভুলে যাব গিরিশ ঘোষের থিয়েটারের গান। প্রদর্শনী-অনুষ্ঠানের জৌলুসে হারিয়ে যাবে এক দিন সন্ধ্যা-হেমন্ত-গীতা দত্ত-ভূপেন হাজরিকা।
অনেক উপভাষা বাংলার গৌরব। প্রায় প্রতিটি জেলার কথ্য ভাষার নিজস্বতা আছে। শহুরে হওয়ার অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষায় সে সব ভাষা মানুষ বলেন না। শুধু কিছু গানের মাধ্যমে আমরা সেই সব মিষ্টি ভাষা শুনতে পাই। সংখ্যালঘু-ভাষার গবেষক বলতে পারবেন, কী ভাবে সবলের চাপে দুর্বলতর ভাষা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ এ সব মেনে নিতে বাধ্য হন।
ইংরেজি-হিন্দির প্রতি সম্মান জানিয়ে বলতে চাই যে, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি মাধ্যমে যে ভাষা চলে, তার মধ্যে যদি বাংলার পরিচয় শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে, তা হলে আরব্য রজনীর সিন্দুকে বদ্ধ সুন্দরীর দশা হতে বিলম্ব হবে না বাঙালির মাতৃভাষার।
তরুণ কুমার ঘটক, কলকাতা-৭৫
সরকারের দায়িত্ব
শিশির রায় বাংলা ভাষা রক্ষার দায় সাধারণ মানুষের উপর ন্যস্ত করে সরকারকে দায়মুক্ত করেছেন। ভাষা ব্যাপারটি দলীয় রাজনীতি বা দেশনীতির অংশমাত্র। জনগণ এ নিয়ে একটা ব্যাপক আন্দোলন করবে আর তা সফল হবে, এ কথা ভাবা যুক্তিযুক্ত নয়। ভাষাভিত্তিক রাজ্য ভারতের ঘোষিত নীতি হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী, বিশেষত মিশনারি স্কুল ও ‘এডুকেশন মাফিয়া’-র চাপে মাতৃভাষার কণ্ঠরোধ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কুড়মালি, রাজবংশী, কোচ এবং আরও স্থানীয় ভাষায় লেখাপড়া শেখার কথা বলেন। কিন্তু বাংলা আবশ্যিক করার কথা বলেন না।
শিশিরবাবু মনে করেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতেই লিখিত বাংলার রীতি প্রচলিত হয়েছে। লিখিত বাংলা ও তার শব্দাবলি ভারতচন্দ্রের কালে ও তারও পূর্বের মঙ্গলকাব্যে সুনির্দিষ্ট ছিল। রবীন্দ্রনাথের সীমিত ধারণা নিয়ে বাঙালিদের একাংশ ভাষার উন্নতির প্রয়াস করেছেন, তাতে ভাষার ভিত্তি নড়ে গিয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর কালে, বিশেষত বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে, তা সংস্কৃত বর্জনের উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশকে নকল করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। সিলেট বা চট্টগ্রাম ভারতের বাইরে। আমাদের ভৌগোলিক অধিকারের বাইরের শব্দভান্ডার নিয়ে আমরা কেন মাথা ঘামাব? মূলত রাঢ় ও উত্তরবঙ্গ নিয়েই আমাদের ভূগোল, ভাষার সম্পদও এখান থেকেই আহরণ করতে হবে।
তুষারকান্তি চৌধুরী, উত্তরপাড়া, হুগলি
বাংলাই মাধ্যম
বাংলার রাজ্যপাল বাংলা ভাষা শেখা শুরু করেছেন। বিরোধীদের একাংশ যে ভাবে তার বিরোধিতা করেছেন, তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘ভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে, আর আমরা বাংলা ভাষাকে রক্ষার পরিবর্তে নষ্ট করছি। বেশির ভাগ বাঙালি শিক্ষক এবং শিক্ষিত মানুষ সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করছেন, এবং প্রচার করছেন যে, বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করলে চাকরি পাবে না, স্মার্ট হবে না। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যে। এক জন সরকারি স্কুলশিক্ষক তাঁর সন্তানকে নিজের স্কুলে ভর্তি না করে যদি দূরের স্কুলে ভর্তি করেন, তবে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, নিজের স্কুলের উপর তাঁর ভরসা নেই, এবং পাশাপাশি তিনি নিজেও ভাল করে পড়ান না। তা হলে সমাজের বাকি মানুষ কী করে ওই স্কুলের উপর ভরসা করবেন? একের পর এক সরকারি বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ হতে থাকলে বাঙালির বাংলা ভাষা স্ব-মহিমায় টিকে থাকবে তো? আমরা প্রত্যেকে সন্তানকে প্রাথমিক পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমেই পড়াব, এবং অন্যদের উৎসাহিত করব, এই হোক প্রত্যেক ভাষা দিবসের শপথ।
রামমোহন চক্রবর্তী, নবদ্বীপ, নদিয়া