চিত্তরঞ্জন দাশ
‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ (কলকাতার কড়চা, ৪-১১) শীর্ষকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পর্কে লেখা হয়েছে ‘‘বিপ্লবীদের আইনি সহযোগিতা করতেন বিনা খরচে। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় সিংহের মতো লড়াই করে শ্রীঅরবিন্দ ও বারীন ঘোষকে ছাড়িয়ে আনলেন।’’ ঠিকই, প্রচলিত মিথ বলে, চিত্তরঞ্জন বিনা পারিশ্রমিকে আলিপুর বোমার মামলাটি লড়েছিলেন। কিন্তু এই মামলায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা পাওয়া বোমা-বিশারদ বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো)-র লেখা ‘বাংলায় বিপ্লবী প্রচেষ্টা’ বই অন্য কথা বলে।
ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী যে বোমা ছুড়েছিলেন, তা তৈরি করেছিলেন হেমচন্দ্র, যাঁর বই থেকে জানা যায়, ‘‘অরবিন্দবাবুকে সমর্থন করবার প্রথমে ভার নিয়েছিলেন মি. ব্যোমকেশ। তিনি আইনের মার-পেঁচে আমাদের মোকদ্দমা হাইকোর্টে তুলে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। বিফল হলো। কম ফীতে হাইকোর্ট ছেড়ে নিম্ন আদালতে আটকে থাকতে রাজি হলেন না। তখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে ধরা হলো। তিনি এককালীন অগ্রিম ছ’হাজার টাকা এবং মোকদ্দমা শেষ করতে ১২ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন।... সে যাবৎ লক্ষ টাকা পূর্বোক্ত ব্যারিস্টার সাহেবকে বিদায় দিতে ব্যয়িত হয়ে গেছল। অথচ সেই দিনই ছ’হাজার টাকা চাই। কারণ পরদিন মোকদ্দমা চলবার কথা ছিল। শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয়ের মুখে পরে শুনেছি, একজন সহৃদয় মাড়োয়ারী ভদ্রলোককে বলা মাত্রই ছ’হাজার টাকা তক্ষুণি দিয়েছিলেন।’’
ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন যে কেবলমাত্র অরবিন্দের হয়েই এই মামলায় লড়েছিলেন সে কথা অরবিন্দের ভাই বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের আত্মজীবনী ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’তেও আছে। লিখছেন, ‘‘অরবিন্দের পক্ষে ব্যোমকেশ চক্রবর্তী ও কে এন চৌধুরী উকিল নীরোদচন্দ্র চ্যাটার্জ্জিকে বাহন বা সহযোগী করিয়া দণ্ডায়মান; মোকদ্দমা কিন্তু দু’পা হাঁটিতেই পট পরিবর্ত্তন হইয়া উক্ত ব্যারিস্টারদ্বয়ের স্থান গ্রহণ করিলেন দেশবন্ধু দাশ। বাকি বড় ও চুণাপুঁটিগুলির পক্ষে হইলেন ব্যারিস্টারের মধ্যে পি মিত্র, ই পি ঘোষ, এস রায়, জে এন রায়, আর সি ব্যানার্জ্জি, আর এন রায়।’’ বিচারক বিচক্রফ্ট-এর রায়ে অরবিন্দ-সহ ১৭ জন বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করলেও, বারীন ও উল্লাসকরের ফাঁসি এবং হেমচন্দ্র-সহ ১০ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের হুকুম জারি হল। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলে, সাত মাস পরে ফাঁসির হুকুম রদ হয়ে বারীন ও উল্লাসকরের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়। অন্যদের সাজা কিছু কমে গেলেও, হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো) ও উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বজায় থাকে। মানসিক ভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় সরকার উল্লাসকর দত্তকে ১৯২০-তে মুক্তি দেয়। ১৯২১-এ প্রিন্স অব ওয়েলস ভারতে আসার ঘটনাকে উদ্যাপন করতে গিয়ে সরকার বেশ কিছু রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়। দীর্ঘ ১২ বছর আন্দামানের সেলুলার জেলে সশ্রম কারাদণ্ডের পর অবশেষে মুক্তি পান বারীন, হেমচন্দ্র ও উপেন্দ্রনাথ। অতএব ‘‘চিত্তরঞ্জন বারীন ঘোষকে ছাড়িয়ে আনলেন’’, তথ্যটি ঠিক নয়।
পীযূষ রায়
কলকাতা-৩৪
দেশবন্ধুর দৃষ্টি
‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (৭-১১) শীর্ষক পত্রটিতে যে ভাবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়েছে, ইতিহাসের নিরিখে তা এলোমেলো মনে হয়। প্রথমেই জানা দরকার, কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য চিত্তরঞ্জন যে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন, তারই ফসল হল ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই চুক্তি। বলা হয়, হিন্দু মুসলমান দু’পক্ষকেই মিলেমিশে স্বরাজের জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং তা অধিগত হলে তবেই চুক্তিটি হবে কার্যকর। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে কোকনদে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে চুক্তিটি খারিজ হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু চিত্তরঞ্জনের প্রতিক্রিয়াটিও লক্ষণীয়, "you can delete the Bengal Pact from the resolution, but you cannot delete Bengal from the History of the Indian National Congress... Bengal will not be deleted in this Unceremonious fashion. If you do, Bengal can take care of itself." তবে বহু সদস্যের নিস্পৃহ মনোভাবের কারণে চুক্তিটির বাস্তব গতিও প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯২৪-এ সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয়, সেখানে অকাট্য যুক্তিতে তা ‘পাস’ করানো হলেও, গাঁধী, লালা লাজপত রাই, মদনমোহন মালবীয় প্রমুখ সম্মতি দেননি। অনেক প্রাদেশিক নেতাও বিরোধিতা করেন। কটাক্ষ করে এও বলা হয়, প্রাদেশিক কংগ্রেস যখন জাতীয় কংগ্রেসের শাখাবিশেষ, এমন স্বীকৃতির কোনও দাম নেই। কেননা সেখানে আগেই এটি রদ হয়ে গিয়েছে।
১৯২৪-এ মেয়র পদে অধিষ্ঠিত হয়ে চিত্তরঞ্জন সুভাষচন্দ্র বসুকে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান কর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে পত্রলেখক চিত্তরঞ্জনের বিরুদ্ধে দু’টি অভিযোগ এনেছেন: জাতিবিদ্বেষ, মফস্সল-বিরোধিতা। মেদিনীপুরের কাঁথি নিবাসী মাহিষ্য বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকে অপমানিত হতে হয়েছিল ঠিকই, তবে তাতে চিত্তরঞ্জনের কোনও দায় নেই। তাঁর মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র জাতিবিদ্বেষ এবং নগরভিত্তিক উচ্চমার্গীয় মনোভাব থাকত, তবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শাসমল স্বরাজ্য দলে নাম লিখিয়ে কি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারতেন? এও মনে রাখা দরকার, স্বরাজের স্বার্থে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষজনকেও তখন চিত্তরঞ্জন আপন করে নিয়েছিলেন। এমনকি, সশস্ত্র বিপ্লবীদের কট্টর দেশপ্রেমকে কাজে লাগাবার জন্য কংগ্রেসে তাঁদের অন্তর্ভুক্তিও চাইতেন।
আসল কথা, ১৯২৬-এ কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে গাঁধীবাদী শাসমল সন্ত্রাসবাদের কড়া নিন্দা করেন। সেখানে উপস্থিত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রতিনিধি সংস্থা ‘কর্মী সঙ্ঘ’-র কিছু সদস্যের চাপেই শাসমলকে সে দিন প্যান্ডেল ছেড়ে চলে যেতে হয়। অপমানিত শাসমল প্রাদেশিক কংগ্রেস থেকে পদত্যাগও করেন। তবে পুত্রের অভিযোগ, জাতপাতের কথা তুলে তাঁকে তখন অপমান করা হয়। মফস্সলবাসী হওয়ার কারণে কটাক্ষও করা হয়। এ ব্যবহার অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু এর সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের সম্পর্ক কোথায়? তিনি তো ১৯২৫-এই গত হয়েছেন।
মেয়র হওয়ার পর চিত্তরঞ্জন বেঙ্গল প্যাক্টকে অনুসরণ করেই কাজে মন দেন। চাকরির শূন্যপদে শতকরা ৭৫ ভাগ মুসলমানের নিয়োগ হয় (দ্র: বঙ্গভূমি ও বাঙালির ইতিহাস, ড. নীতিশ সেনগুপ্ত)। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে তাঁর প্রবল জনপ্রিয়তা লক্ষ করা যায়। স্বরাজ না আসায় অন্যত্র প্যাক্টটির বাস্তবায়ন তেমন ভাবে সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সুভাষকে কারাবন্দি করে রাখা হয়। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জনও মারা যান। পরে ইচ্ছাকৃত ভাবে কৃষ্ণনগরের অধিবেশনে বেঙ্গল প্যাক্টকেও বাতিল করা হয়। আশাহত হয়ে তখন থেকেই অনেক মুসলমান সদস্য কংগ্রেস ত্যাগ করতে থাকেন। দু’তিন বছরের মধ্যে, যে সোহরাওয়ার্দি, তমিজুদ্দিন প্রমুখ চিত্তরঞ্জনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তাঁরাও কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যান। এই সব কারণে বেঙ্গল প্যাক্ট যখন ভাল ভাবে আত্মপ্রকাশ করারই সুযোগ পেল না, তার প্রেক্ষিতে চিত্তরঞ্জনকে বিদ্ধ করা কি সমীচীন?
দেশবন্ধু-কন্যা অপর্ণা দেবীর পর্যবেক্ষণটি স্মরণীয়, ‘‘যদি সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানকল্পে কংগ্রেস ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বা লালা লাজপত রায় ও ডাক্তার এম এ আনসারি কৃত প্যাক্টে ত্বরায় দৃঢ় মনোনিবেশ করতেন তা হলে পিতৃদেবের মৃত্যুর পরই সাম্প্রদায়িক সমস্যা তীব্র ভাবে কখনও দেখা দিত না। কারণ সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানকল্পে স্বরাজ্য পার্টির হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই প্রবল চেষ্টিত ছিলেন, কিন্তু পিতৃদেবের মৃত্যুতে স্বরাজ্য পার্টি স্তিমিত হয়ে গেল। তৃতীয় শক্তি এ সুযোগ গ্রহণে তৎপর হয়ে উঠল এবং তারা এতে সফল হয়েছিল কি না তা দেশবাসীর বিচার্য’’ (মানুষ চিত্তরঞ্জন, প. ব. বাংলা আকাদেমি, পৃ. ১৯৯)।
বাণীবরণ সেনগুপ্ত
শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।